" স্রোতস্বিনী বসুমল্লিক...মৃত্তিকা মাহাতো...গতকাল... নিষিদ্ধ এলাকায়...লুনার আওয়ার বা চান্দ্র সময় যখন প্রায় শেষ হয়ে সোলার আওয়ার বা সূর্য সময় শুরু হতে চলেছিল...
তখন,মেন্টরের পারমিশন না নিয়েই তোমরা তোমাদের স্পেশাল পাওয়ার ইউজ্ করে ছিলে? কোনো মিথ্যে কথা বলার চেষ্টা করবে না... যথেষ্ট প্রমাণ আছে..."
"প্রিস্ট টাইরেসিয়াসের, পুরুষ ও নারীর দুরকম আওয়াজ বেরোনো গম্ভীর গলার স্বর আমাদের কানে আছড়ে পড়ার সাথেসাথেই ...আমাদের মাথার অনেক উপরে ভাসমান ডায়াসটা তার রাজকীয় চেয়ারগুলোতে বসে থাকা প্রফেসর সহ আমাদের চোখের লেভেলে নেমে এসে স্থির হয়ে দাঁড়ালো।
" চুপ করে তাকিয়ে থেকে কোনো লাভ নেই...ইউ মাস্ট স্পিক আউট"
"পাওয়ার ব্যবহার করার কথাটা তো পরে...আগে বলো, ঐ সময়ে সাউথের ঐ নিষিদ্ধ গ্রাউন্ডে...তোমরা কি করছিলে? তোমরা জানো?ওই 'ময়দান' গ্রাউন্ডের জঙ্গল আর ইসপ্যামার নিষিদ্ধ মিউজিয়াম তোমাদের জন্য কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারতো?"
প্রিস্টেস অহনার গলায় রাগ ছাড়াও উদ্বেগ মিলেমিশে গেল....
"প্রথম এলে...এদের নিয়ে এটাই সমস্যা... হঠাৎ করে এত কিছু পেয়ে গিয়ে দিশাহারা হয়ে যায়....কলকাতায় কত মানুষ থাকেন...যদি কোনো অঘটন ঘটতো!!তারা যদি কমপ্লেন করতেন!!...তাছাড়া পাওয়ার ব্যাকফায়ার করে ওদের নিজেদেরও তো মারাত্মক ক্ষতি হতে পারতো!!! নাঃ হাই প্রিস্টেস আপনি এদের এই অপরাধ লাইটলি নেবেন না...এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার...যাতে আর কোনো ফ্লেজলিং এই সাহস না করে..."
"না না প্রিস্ট টাইরেসিয়াস... আমি মোটেই এই ব্যাপার টা হাল্কা ভাবে নিচ্ছি না... আসলে সমস্যা হলো একবার সুপার পাওয়ার ডিটেক্টেড হওয়ার পর ওদের তো আর ফ্যামিলিতে ফেরৎ পাঠানো যায় না... আমি ওদের হয় আ্যান্টার্কটিকা ইসপ্যামাতে পাঠাবো আর না হয় আফগানিস্তান ইসপ্যামাতে পাঠিয়ে দেবো যেটাকে রিফর্মেটরি ইসপ্যামাও বলে..কত ঘাড়ত্যাড়া অবাধ্য ফ্লেজলিং ওখানে গিয়ে সিধে হয়ে গেছে। আজ আমরা আমাদের মধ্যে অনিন্দিতার কনসর্ট.... অসীম শক্তিধারী...অবতার চন্দ্রমৌলিকেও পেয়েছি... আমি আশা করবো উনিও আমার সাথে একমত হবেন,যদিও হাই প্রিস্টেস হিসেবে, এই ইসপ্যামাতে আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত... আমার সবচেয়ে খারাপ লাগছে কাল আমি নিজে থেকে স্রোতস্বিনীর মেন্টর হলাম..তার পরেও... ছিঃ এত অবাধ্য আর ইনসোলেন্ট এরা...কালও আমার মুখের উপর কথা বলার সাহস দেখিয়েছিল...আর তারপর এই ঘটনা"
আমার মনে হল... অবতার চন্দ্রমৌলি আর অনিন্দিতা একে অপরের দিকে অর্থবহ ভাবে তাকালেন আর অনিন্দিতা কথা বলে উঠলেন...
" কিন্তু মিরান্ডা...আমরা এখনো ওদের কথা শুনিনি কিন্তু...এ ব্যাপারে ওদের মতামতও তো আমাদের নেওয়া দরকার... "
"বলো ফ্লেজলিং....এ ব্যাপারে তোমাদের কি কিছু বলার আছে?... আমাদের এত সময় নেই...তোমরা এই অন্যায় করেছ না করো নি??"
অনিন্দিতা সোজাসুজি আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
"আমি আর মিট্টি দুজনেই অনিন্দিতার কথায় ইতিবাচক ভাবে মাথা নাড়লাম..."
"ব্যস হয়েই তো গেল...ওরা তো দোষ স্বীকারই করে নিলো...এরপর আর তো কিছু বলার কোনো মানেই হয় না " মিরান্ডার স্বরে দৃঢ়তা ও নিশ্চয়তা.....
"কেন করলে এরকম?তোমরা নতুন... এখানকার নিয়ম-কানুন গুলো ভালো করে জানার আগেই এরকম একটা কাজ করে ফেললে!!"
অনিন্দিতার বিষন্ন কোমল স্বরে আমার গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে গেল... আমি দেখলাম মিট্টির চোখ দিয়েও টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে...ও কোনোরকমে গলাটা একটু পরিস্কার করে বলতে চেষ্টা করলো....
"ম্যাডাম আমরা...আমরা....বাধ্য হয়ে..."
"মৃত্তিকা মাহাতো...যা বলবে স্পষ্ট করে বলো..."
মিরান্ডার কঠিন স্বর যেন চাবুকের মত ধেয়ে এল আমাদের দিকে...
"বাধ্য হয়ে মানে?কে বা কি তোমাদের বাধ্য করেছিল?যে আমাদের না জানিয়ে তোমরা এ রকম একটা কাজ করে ফেললে!!কি মনে করো তোমরা নিজেদের??!!!"
"ম্যাম...আমরা....মানে রিজ...আসলে রুক..."
"না মিট্টি না..."
আমি মিট্টির হাত চেপে ধরলাম...মিট্টি জলভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল।
"তাহলে তোমাদের কিছু বলার নেই..এটাই ধরে নেবো তো?"
মিরান্ডা বাকিদের দিকে তাকালেন...
"আমাদের তাহলে আর কিছু করার নেই...ইসপ্যামার রিট্রিবিউশন রুল অনুযায়ী ওদের দুজনকে আফগানিস্তানের রিফর্মেটরি ইসপ্যামায় ট্রান্সফার করার জন্য আমি ব্যবস্থা করছি...আর ওদের গার্ডিয়ানদের ও সেটা ইনফর্ম করে দেওয়া হবে। স্রোতস্বিনী,মৃত্তিকা... তোমরা দুজন তোমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিও..."
আমার পাশ থেকে মিট্টির ফোঁপানি শুনতে পেলাম...আর তারপরই পিছন থেকে ডাইকোর চিৎকার...
"ম্যাম,স্যার... এ ব্যাপারে আমাদেরও কিছু বলার আছে...কাল ওদের সঙ্গে আমরাও ছিলাম ম্যাম...প্লিজ আমাদেরও কিছু বলতে দেওয়া হোক..."
"বালক... তুমি সম্মুখে আসিয়া বাক্যবিনিময় করো...অত দূর হইতে উহা শোভন নহে.." অবতার চন্দ্রমৌলির প্রতিধ্বনিময় সুরেলা গম্ভীর কন্ঠ গমগম করে বেজে উঠলো...জানিনা, এটা উনি কোন ভাষায় কথা বললেন...শুনতে তো বাংলার মতই...ভাবতে ভাবতেই আমি দেখলাম ডাইকো লাফিয়ে সামনে চলে এসেছে...
"আমার সম্মানীয় প্রফেসরস..প্রিস্টস আর প্রিস্টেসরা...আমরা কাল সবাই রুল ভেঙে নিষিদ্ধ জায়গায় গিয়েছিলাম..
তাই তার জন্য যদি শাস্তি হয়...সেই শাস্তি শুধু ওদের দুজনের নয়... আমাদের সবারই প্রাপ্য...আর প্রফেসরস্... সেল্ফ ডিফেন্সের জন্য... নিজের প্রিয়জনদের বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য পাওয়ার ব্যবহার করা নিশ্চয়ই অত বড় অপরাধ নয়..প্লিজ?"
"সেল্ফ ডিফেন্স মানে??তোমরা কি ঐ গ্রাউন্ড পেরিয়ে মিউজিয়ামে চলে গেছিলে!!!কি সর্বনাশ..ওখানে কত ভয়ঙ্কর... নিষিদ্ধ আর সাঙ্ঘাতিক জিনিস রাখা আছে...যেগুলো কি যে ভয়ানক সর্বনাশা....যেগুলোর পাওয়ার সম্পর্কে তোমাদের কোনো আইডিয়াই নেই!!" অনিন্দিতা আর প্রিস্টেস অহনা দুজনেই যেন শিউরে উঠলেন
এবার অবাক হওয়ার পালা আমাদের
" আমরা তো কোনো মিউজিয়ামে যাইনি ম্যাম..! আমরা তো শুধু ঐ ঘাসজমি আর জঙ্গলেই রুক...ইয়ে মানে এমনি আর কি... গিয়েছিলাম...."
মিট্টি সামলে নিয়ে ভয়ে ভয়ে আমাদের দিকে তাকালো...
"তাহলে এ্যাটাকের প্রশ্ন আসছে কেন"?মিরান্ডার গলায় অসম্ভব রাগ আর ক্ষোভ
"ম্যাডাম...আসলে আমরা ওখানে গিয়ে কতগুলো অদ্ভুত আর ভয়ঙ্কর দেখতে ছেলেমেয়েদের সামনাসামনি হয়েছিলাম...তারাই আগে আমাদের হিংস্র ভাবে আ্যাটাক করেছিল...আর আমাদের প্রাণে মেরে ফেলারও চেষ্টা করেছিল... আমাদের এক বন্ধু রিজওয়ান এখনও সাঙ্ঘাতিক আহত...এই দেখুন ম্যাম..."
সমীর রিজের দিকে তাকাতেই রিজ ওর দগদগে ক্ষত সমেত আহত পা'টা সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরলো.... আমি অবাক হয়ে দেখলাম...কখন যেন আমাদের সব বন্ধুরা একসঙ্গে আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে...
"শাট-আপ্ জাস্ট শাট-আপ... সামান্য ফ্লেজলিং... তোমাদের এত বড় সাহস...আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলো...!! বন্ধুদের বাঁচাতে গিয়ে আমার ইনস্টিটিউট কে ম্যালাইন করার চেষ্টা করছো... আমি ভালোই বুঝতে পারছি....পাওয়ার ইউজ্ করার জন্যই এই ছেলেটির পায়ে এরকম হয়েছে....আরো বেশি কিছু হলে কি সর্বনাশ হত কে জানে...তোমরা এত শয়তান!!! তোমাদের সবকটাকে কি করে শায়েস্তা করতে হয়,আমি খুব ভালোই জানি...ইউ পিপল্ ওয়েট আ্যান্ড ওয়চ..."
মিরান্ডা প্রিস্টলি এত জোরে চিৎকার করে উঠলেন....যে আওয়াজ টা আমাদের মাথার ভিতরে ধাক্কা মেরে আমাদের কিরকম বেসামাল হতবুদ্ধি করে দিল.... দেখলাম অন্য প্রফেসররাও সবাই উঠে দাঁড়িয়েছেন... শুধু চন্দ্রমৌলি শান্ত ভাবে বসে আছেন....
"আরে মিরান্ডা...শান্ত হও...ওরা বাচ্ছামানুষ.... কি বলছে.. কেন বলছে..."
"আমরা কেউ মিথ্যে কথা বলছি না ম্যাম..." প্যাম কাঁপা কাঁপা গলায় বললো
"ওরা খুব হিংস্র আর ভয়ঙ্কর ছিল... আমি তো ওদের দেখে অজ্ঞান ই...." প্যাম পুরো কথা শেষ করার আগেই মিরান্ডা আবার চেঁচিয়ে উঠলেন...
"স্টপ দিজ ননসেন্স...তোমরা সবাই একসাথে প্ল্যান করে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে গল্প বলছো....একে তো সবাই রুল ভেঙেছ... তোমাদের প্রত্যেককে তার জন্য শাস্তি পেতে হবে...আর তার উপর আবার মিথ্যা কথা... তোমাদের এই গল্প আমরা কেউ বিশ্বাস করছি না....ইসপ্যামা ইজ দ্য সেফেস্ট প্লেস ইন দ্য হোল ওয়ার্ল্ড...আর তোমরা দুজন....তোমাদের ব্যবস্থা....গেট লস্ট...কালই আগে তোমাদের দুজনকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে
তারপর বাকিদের কি করবো...ভেবে দেখবো "
আমি একবার ভাবলাম... আমার কাছে যে হারটা আছে সেটা ওনাদের দেখাই... কিন্তু হাই প্রিস্টেসের অভিব্যক্তি দেখে আমার সিক্সথ সেন্স বললো...এতে বিশেষ কোনো লাভ হবে না উনি বিশ্বাসও করবেন না....
এইসব ভাবনার মধ্যেই দেখলাম... অনিন্দিতা আর প্রিস্টেস অহনা মিরান্ডাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করতে কিন্তু মিরান্ডার এক্সপ্রেশন বলে দিচ্ছিল উনি কিছু শুনতে নারাজ...
"প্লিজ তোমরা আমাকে রিকোয়েস্ট কোরোনা...রুল ইজ রুল...তারপর ওরা বানিয়ে বানিয়ে ভয়ঙ্কর মিথ্যে কথা বলেছে...এটা পুরো ইসপ্যামার রেপুটেশনের জন্য ক্ষতিকর...না...হাই প্রিস্টেস হিসেবে আমি এটা কোনোভাবেই স্পেয়ার করতে পারবোনা.."
"ইহারা মিথ্যা বলিতেছে কিনা তাহা এক্ষণেই প্রমাণিত হইবে..."
অবতার চন্দ্রমৌলি কখন যেন উঠে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে এসেছেন
আর.... আমরা সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখলাম ওনার কপাল থেকে একটা সার্চলাইটের মত তীব্র আলোর রেখা বেরিয়ে এসে আমাদের সবার মধ্যে সবথেকে সামনে থাকা সমীরের কপাল স্পর্শ করেছে সোজা
ঐ অবস্থাতেই চন্দ্রমৌলি বাঁ হাতটা অদ্ভুত ভাবে নাড়ালেন....আর আমাদের মাথার খানিকটা উপরে একটা হালকা আবছায়া যেন জলের ঢেউ দিয়ে বানানো .... সিনেমার স্ক্রীনের মত একটা পর্দা দুলতে.... কাঁপতে লাগলো....আর তাতে সমীরের মাথা থেকে কয়েকটা বিভিন্ন রঙের সুতোর মত আলোর রেখা গিয়ে পড়লো....আর সেই অদ্ভুত জলের তৈরি পর্দাতে আমরা সবাই নিজেদের দেখতে পেলাম...
যেন কেউ আমাদের কালকে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা ভিডিও রেকর্ডিং করে সমীরের মাথায় স্টোর করে রেখেছিল...আর আজ সেটার রিপ্লে দেখানো হচ্ছে...
আমাদের আর প্রফেসরদের অবাক বিস্মিত চোখের সামনে একের পর এক ভেসে উঠতে লাগলো....প্যামের অজ্ঞান হওয়া...রিজের পায়ে সেই মেয়েটির কামড়ে ধরা...ডাইকোকে আর একটা অদ্ভুত মেয়ের আক্রমণ, আর এসব আটকাতে গিয়ে আমার আর মিট্টির ট্রান্সফর্মেশন...আরো বাকি সব কিছু...
তবে একটা জিনিসে আমি খুবই অবাক হয়ে গেলাম...আবার এটাও ঠিক যে কিছুটা নিশ্চিন্তও হলাম....যখন দেখলাম চোখের সামনে ঘটতে থাকা গতকালের পুরো ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনরাবৃত্তি তে সব কিছু দেখা গেলেও... কোথাও রুকসানা কে দেখা যাচ্ছে না!!!!
0 Comments.