Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় অমিতাভ রায়

maro news
।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় অমিতাভ রায়

ছায়াহীন

তনুময় কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পরে চিলেকোঠার ঘরে উঠে গিয়েছিল। ঠিক করেছিল সংসারের কোনো ব্যাপারেই ও আর থাকবে না। ছাদের টবগুলোয় বিভিন্ন ফুলের গাছ বসিয়ে ছাদের চেহারাটাই বদলে দিয়েছিল। ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে মানুষজন এবং প্রকৃতির যতটুকু দেখা যায়- সেটার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। বউ- ছেলে আর বউমা খেয়ালি এই লোকটাকে তার মতো করেই বাঁচতে দিল। খাবার দেওয়া ছাড়া পারতপক্ষে তনুময়কে ডিস্টার্ব করতোনা। গ্রীষ্মকালে একটু অসুবিধে হতো বটে, তবে সেটাকে খুব একটা গ্রাহ্য করতো না তনুময়। বইপত্র আর ফুলের গাছ নিয়েই ব্যস্ত ছিল ও। মাসে একবার শুধু পেনশনের টাকা আনতে বেরতো। পেনশনের টাকা বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে, আবার নিজের ডেরায় ফিরে যাওয়া। এই ছিলো ওর রুটিন। আর প্রতিদিন ভোরবেলায় বাড়ির কেউ ওঠার আগে নীচের বাগানে একটু হাঁটাচলা করতো। বেশ ছিলো তনুময়। কিন্তু, একদিন হঠাৎ একটা জিনিস দেখে ও চিন্তিত হয়ে পড়লো।
ব্যাপারটা কি - তা খুলেই বলা যাক। একদিন হঠাৎ তনুময়ের মনে হলো, কিছু একটা যেন ঠিক লাগছে না। ও তখন ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে শীতের বিকেলে চারদিকের প্রকৃতির শোভা উপভোগ করছিল। মনে কেন খটকা লাগছিল তা প্রথমে বুঝতে পারেনা তনুময়। তারপর ওর খেয়াল হল, ওর ছায়া পড়ছে না। ব্যাপারটা কিরকম হলো! মনে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে তনুময়ের। সন্ধেবেলায় আলো নিভিয়ে হাত দিয়ে ছায়াবাজির চেষ্টা করে দেখলো ও। না, দেওয়ালে হাতের ছায়াই পড়ছে না। চিন্তিত তনুময় রাতে বউমা খাবার দিতে এলে, বউমাকে সমস্যাটার কথা বলে। বউমা শুনে কোনো উত্তর না দিয়ে নীচে নেমে গেল। বউমার মুখটা যেন কেমন হয়ে গিয়েছিল। কিছুই খেতে পারলো না তনুময়। একটা লোকের ছায়া নেই- সেটা কি ভালো হলো? মোটেই না। বউকে কি বলবে? না! বলা উচিত হবে না। বউয়ের সঙ্গে সম্পর্কের আর কি অবশিষ্ট আছে। মাঝেমধ্যে দেখা হয়- এইমাত্র।
রাতে ঘুম হলো না। সকালে অনেকদিন পরে বাইরে বেরলো তনুময়।বন্ধু অসীমের ছেলে ডাক্তার- তার চেম্বারেই গেল। অসীমের ছেলে অলোক ওকে দেখে হেসে বসতে বললো। তনুময় সবিস্তারে ওর ছায়া না থাকার কথা জানালো। ওকে কি পাগল মনে হচ্ছে? অলোক কিন্তু গুরুত্ব দিয়েই সব শুনলো। যদিও ওর মুখে এক অদ্ভুত সহানুভূতির ছাপ। তারপর বলল,"ছায়া তো একসময় না একসময় চলেই যায় মেসোমশাই। ভাববেন না একদম। মানিয়ে নিন।" মানিয়ে নেওয়া কি যায়! তনুময় বলে," ছায়া কি আর কোনরকমেই ফেরত পাওয়া যাবেনা।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে অলোক বলে,"মেরুদন্ড না থাকলে, নতুন মেরুদন্ড তৈরি করে দিতে পারি। কিন্তু, ছায়ার ক্ষেত্রে ডাক্তারিবিদ্যা কিছু করতে পারবেনা।" হতাশ হয়ে ফিরে এলো তনুময়। সারা রাস্তায় নিজের ছায়া দেখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। না! ছায়াটা একেবারেই গিয়েছে!
বাড়ি ফিরে নিজেকে কয়েকদিন ঘরের মধ্যে বন্দী করে রেখে দিল। শুধু বউমা খাবার দিয়ে যেতো। সে খাবার ছুঁতোই না তনুময়। না খেয়ে অবশ্য বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি তনুময়ের। না খাওয়া ব্যাপারটা যেন ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে ওর। এর মধ্যে চারিদিকে ভোট নিয়ে হইচই চলছে। ভোটের দিন সকাল সকাল ভোটকেন্দ্রে গিয়ে উপস্থিত হল তনুময়। বেশ লাইন পড়েছে। লাইন দিয়ে যখন ভেতরে ঢুকতে পারলো, তখন একটু দুঃখিত হয়েই পোলিং অফিসার বলল, "দাদু, আপনি তো ভোট দিতে পারবেন না।" বিস্মিত চোখে তনুময় তাকায় পোলিং অফিসারের দিকে। বলে," আমার ভোটার কার্ড আছে, আমি এসেছি, তবু কেন ভোট দিতে পারবো না? আমার তো একটাই সমস্যা- আমার ছায়া নেই। আমার ভোট কি কেউ দিয়ে দিয়েছে?" পোলিং অফিসার আবার একটু দুঃখ দুঃখ ভাব করে বলে,"আসলে কি জানেন তো- যার ছায়া নেই, তার ভোটও নেই।" মনের দুঃখে ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এলো তনুময়। বাড়ি ফিরে এসে নিজেকে আবার চিলেকোঠার ঘরে বন্দী করে রেখে দিল তনুময়। এখন ও খায়না বলে বউমাও খাবার দিতে আসেনা।
পেনশনের নির্দিষ্ট দিনে ব্যাঙ্কে যাওয়ার জন্য অনেকদিন পরে বেরলো তনুময়। রাস্তায় ভোলা পাগলের সঙ্গে দেখা। ছেলেটা ব্রিলিয়ান্ট ছিল। কিন্তু, কোনো কারণে পাগল হয়ে গিয়েছে। ভোলা পাগলা বলল, "মেসোমশাই কেমন আছেন?" তনুময়ের দুঃখের কথা শুনে ভোলা পাগলা হাসতে হাসতে বলল, " ভালোই হয়েছে মেসোমশাই। ছায়া থাকলেই দুর্নীতি থাকে! আপনি বেঁচে গেছেন।" এই বলে ভোলা পাগলা হাসতে হাসতে চলে গেল। ব্যাঙ্কের দিকে এগিয়ে গেল তনুময়। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার কিছুক্ষণ বিস্মিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,"আপনাকে তো আর পেনশন দেওয়া যাবে না।" বিদ্রুপের সুরে তনুময় বলে,"কেন? ছায়া নেই বলে?" ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সহানুভূতির চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,"ঠিকই ধরেছেন। আমাদের দেশের এরকমই নিয়ম।" আর সহ্য হচ্ছেনা তনুময়ের। রাগ দেখিয়েই বেরিয়ে এলো তনুময়। ফেরার পথে ও শেষ চেষ্টা করে নিজের ছায়া দেখার। কিন্তু, ছায়ার একবিন্দুও দৃশ্যগোচর হয় না। যদিও অন্যান্য লোকেদের সঙ্গে দিব্যি তাদের ছায়া যাচ্ছে! তনুময় লোকজনকে না দেখে, তাদের ছায়া দেখতে থাকে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাগের সঙ্গে একটা চিন্তাও কুরে কুরে খায় ওকে। একজন পুরুষের যদি রোজগার না থাকে- তবে সংসারে তার দামও নেই। কেউ তাকে পুছবে না। ছেলে- বউ- আত্মীয়স্বজন কেউ তাকে গুরুত্বই দেবে না। ছায়াহীন মানে অর্থহীন- আর অর্থহীন মানে গুরুত্বহীন! যেদিন বউয়ের হাতে ও মাইনে বা পেনশনের টাকা তুলে দেয়- সেদিনই বউয়ের মুখে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠতে দেখে তনুময়। এখন বউকে কিভাবে পেনশনের টাকা না পাওয়ার কথা জানাবে- তা ভেবে পায়না তনুময়। কিন্তু, বলতে তো হবেই। বউকে কথাটা বলতেই বউ কাঁদতে শুরু করে দিল। তনুময় ভেবেছিল বউ রাগ করবে। কিন্তু, তা তো হলো না! বরং বউ হাপুসনয়নে কাঁদছে। তা দেখে নিজেরই দুঃখ হলো তনুময়ের। নিজেরও কান্না পেয়ে গেল ওর। রুদ্ধকণ্ঠে বলল,"জানো - আমার ছায়া নেই?" বউ সান্ত্বনা দিয়ে বলে,"রাস্তায় যত লোক দেখছো- তাদের অনেকেরই ছায়া নেই।" "আমার পেনশন নেই, ভোট নেই।" বউ বলল,"শুধু তা কেন? তোমার রেশন নেই, তোমাকে কেউ চিঠি লিখবে না, কেউ ফোন করবে না- এমন কি..."। বউ আর পুরোটা না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যায়। "এমন কি মানে?" তনুময়ের প্রশ্ন শুনে বউ আবার কাঁদতে শুরু করে। বিরক্ত হয়ে তনুময় বেরিয়ে আসতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লো বউয়ের কথা শুনে। "আসলে ছায়াহীন লোকেদের কিচ্ছু থাকে না। বউ-ছেলে-বাড়ি-কিচ্ছু না।" তনুময় আর দাঁড়ায় না। মন খারাপ করে গালে হাত দিয়ে ছাদে চুপ করে বসে থাকে তনুময়। বউ এরকম বলতে পারলো! হঠাৎ ওর মনে হয়, বেঁচে আর কি লাভ? ছাদ থেকে লাফ দেয় তনুময়। নীচে পড়ার সময়ে ভাবে, ব্যাস সব শেষ। কিন্তু, শেষ কোথায়! ওর তো একটুও লাগেনি। চারদিকে তাকিয়ে দেখে তনুময়। কেউ দেখেনি তো? নিঃশব্দে ওপরে উঠে আসে ও। সন্ধেবেলায় ছাদে বসে বিমর্ষ তনুময় ভাবে, ছায়া হারিয়ে যাওয়ার পরে ওর অবস্থা কতখানি করুণ হয়ে গিয়েছে। এমনকি আত্মহত্যা করার ক্ষমতাও ওর নেই। "দাদুভাই! দাদুভাই!" ঠিক দাদুর মতোই গলা না? তাইতো? পাশেই তো বসে আছে দাদু! "দুঃখ পাসনা দাদুভাই। একদিন না একদিন সবাইকেই নিজের ছায়া হারাতে হয়। চ, আমাদের সঙ্গে চ। ঐ দেখ তোর দিদিমা,তোর বাবা- মা -দিদি -সবাই যে তোর অপেক্ষাই করছে।" তার মানে কি? এরা সবাই তো মৃত! তাহলে কি ও...! আর ভাবতে পারে না তনুময়। "যা, নীচে গিয়ে একবার সবাইকেই দেখে আয় শেষবারের মতো।" তনুময় সবাইকেই দেখে এলো। বউয়ের ঘরে ওর একটা প্রমাণ সাইজের ছবি। তাতে একটা ফুলের মালা ঝুলছে। আগে খেয়াল করেনি ও। "চল, আর মায়া বাড়াস না।" শেষবারের মতো নিজের চিলেকোঠার ঘরের দিকে একবার তাকালো তনুময়। দরজায় একটা বড়ো তালা লাগানো রয়েছে!
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register