Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় কৌস্তভ যোদ্দার

maro news
।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় কৌস্তভ যোদ্দার

তুলসী দিদা

প্রাচীনকালের রীতি অনুযায়ী আচার-বিধী দেখে সমাজের মোড়ল মাথারা পদবী দিয়েছিল 'কাক'। কিন্তু কালের পরিবর্তনে তাদের পদবী 'মন্ডল'এ এসে দাঁড়ায়। গ্ৰামের সবাই তাই তুলসী কাক নামেই বেশি চেনে। কিন্তু আমি তাকে তুলসী দিদা বলেই ডাকতাম। যদিও তিনি কোন সম্পর্কের আত্মীয়ের মধ্যে ছিলো না, কিন্তু আমাদের খুব ভালোই যত্ন করতো তবে আমাকে একটু বেশিই.. এই তুলসী দিদার বাড়ি ছিল আমার বাড়ির পাশেই। এবার এনার একটু শারিরীক বিবরণ দেওয়া যাক- উচ্চতা ৩-৪ফিট, ওজনটা ১মোন৫০ কেজি এর একটু কম হবে হয়তো, গায়ের রং শ্যামলা বর্ন, চুল বয়সের কোপে একটু কমই হয়ে গেছিল ,তবে হ্যাঁ চোখের আর মুখের ক্ষমতা কিন্তু কমেনি। শরীরটা অতিরিক্ত ভারী হওয়ায় অসুখ লেগেই থাকত তেমন কোন কাজই করতে পারতনা। একটা অপছন্দের বিষয় হলো দিদা কোন কথা সাত- পাঁচ কান না করে থাকতে পারতো না। এই তুলসী দিদার ছয় মেয়ে ছিল। তবে ছেলে না থাকায় গ্ৰামের লোকের কাছে কথায় কথায় খোঁটা সহ্য করতে হতো।এই ছয় মেয়ের মধ্যে পাঁচ মেয়েকে দাদু নিজের হাতে বিয়ে দিয়ে গেছিলেন। যার মধ্যে চতুর্থ তম মেয়েটি দুর্ভাগ্যবশত স্বামীর বাড়ি থেকে ফেরত এসে বাবার কাছেই থাকতো। আর ছোট মেয়েটিকে অর্থাৎ ষষ্ঠতম মেয়েটিকে বিয়ে না দিয়েই দিদা সহ দুই মেয়েকে রেখে দাদু স্বর্গপথে রওনা দিয়েছিলেন। দাদুর বারো বিঘা জমির ধান দুই মেয়েই সামলাতো, বেশ সুখেই ছিল। কিন্তু ছোট মেয়েটার বিয়ে নিয়ে দিদা একটু বেশি চিন্তিত ছিলো কারন সে গুনের দিক দিয়ে অতীব সুন্দর হলেও রুপে একটু কমই ছিল। যারজন্য সম্বন্ধ খুব কম‌ যায়গা থেকেই আসত। আর আসলেও, রুপের দিক দিয়ে বিচার করে মাথা নেড়ে অসম্মতি প্রদান করে চলে যেত।ফলোত দিদা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো এমন সময় আমাদের বাড়ির প্রতিমা নির্মান কারীর সঙ্গে তার দুঃখের কাহিনী খুলে বলতে এক সম্বন্ধের খোঁজ দেন শুধুমাত্র ছেলেটার মাথায় চুল নেই। প্রতিমা নির্মানকারী এর চেষ্টায় ছোট মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে তুলসী দিদা ও চতুর্থ তম মেয়ে অর্থাৎ অর্চনা অনেক চিন্তা থেকে নিজেদের মুক্ত মনে করেন। তবে ছোট মেয়েটার বিয়ের পর দিদাকে আগের তুলনায় একটু বেশি কাজ করতে হতো কারণ অর্চনা নামক মেয়েটি ছিল অলস প্রকৃতির। ওদিকে বিবাহিত ছোট মেয়েটিও খুব একটা সুখে ছিলনা।
এবার দিদার দু-একটি মজাদার ঘটনার বিবরণ দেওয়া যাক- তুলসী দিদার দুটো বিশালাকৃতির কুল গাছ ছিল, শীতের সময় এই কুল গাছের কুল বিক্রি করেই দু মা-বেটির সংসার চলে যেত । দাদু বেঁচে থাকাকালীনও এ দু -গাছে কুল হতো, তবে বিক্রিটা এত বেশি হতনা, দানে বেশিটা চলে যেত। গ্ৰামের কচি কাচার দল কুল পাড়তে চাইতো কিন্তু দিদা আর অর্চনা পিসির কড়া পাহারায় কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারতনা, অর্চনা পিসি কুল চুরি দেখতে পেলে গাল দিত আর সেইসঙ্গে বাড়িতে গিয়ে তাদের বাবা-মা এর কাছে নালিশ জানিয়ে আসত, আর দিদা দেখতে পেলে শুধু গাল দিত কারন দিদা বয়সের কোপে আর শরীরের ভারে ভালো করে হাঁটতে পারতনা। তাই কচিকাচারা অর্চনা পিসির না থাকার সূযোগটাই বেশি খুঁজতো। একদিন পিসির অবর্তমানে কচিকাচার দল কুল পাড়তে এসেছিল, দিদার শত গালকেও উপেক্ষা করে মহানন্দে আপন কাজে ব্যাস্ত ছিল তারা। দিদা যখন মুখে না পারতো তখন ঢিল ছুড়ে মারতো, সেদিন ও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। কিন্তু দূর্ভাগ্য বশত ঢিলটা গিয়ে লেগেছিল দিদার নিজের পোষা মুরগির গায়ে। মুরগির মাথা দিয়ে তখন রক্ত বের হচ্ছে দিদা তো আরো রেগে লাল। দিদা কচিকাচাদের উদ্দেশ্যে একগুচ্ছ গাল দিতে দিতে মুরগিটাকে সুশ্রষা করে অবলা প্রানিটাকে স্বর্গের দুয়ার থেকে সেবারের মতো ফিরিয়ে এনেছিল।
গ্ৰামবাসীদের জল অপচয়ের প্রতিশোধ নিতে টিউবওয়েলে তালা-চাবি ঝুলিয়ে আমাদের জল অভুক্ত থাকার দ্বিতীয় মজাদার ঘটনার বিবরণটা দেওয়া যাক। তুলসী দিদার বাড়ির সামনেই ছিল টিউবওয়েল, আর সেখান থেকেই প্রায় সমস্ত গ্ৰামবাসী পানীয় জল নিয়ে যেত আবার কেউ কেউ স্মানও করতো।আর এই স্মান করতে গেলে এক তীব্র সমস্যা দেখা দিত , সমস্যাটা হলো টিউবওয়েলর পাশেই ছিল দিদার গোয়াল; আর স্মান করলে ছিটে ফোটা জল গোয়ালে যেত কিন্তু দিদা এটাকে টেনে আরও বৃহৎ আকৃতিতে পরিনত করতো আর হেঁকে লোক জড়ো করতো। মোদ্দা কথা দিদা কারোর টিউবওয়েলে স্মান করা সহ্য করতে পারতো না, কিন্তু দিদা নিজেই টিউবওয়েলের জলে'ই স্মান করতো। সেদিন ছিল বুধবার। এক দশ বছরের শিশু সেদিন স্কুলে যাওয়ার জন্য স্মান করছিল। অন্য সবার মতো সেও স্মান করতে গিয়ে কিছু জল দিদার ‌গোয়ালে পড়েছিল তবে অন্য সবার মতো ছিটে ফোটা নয় , একটু বেশিই...। দিদা তো দেখতে পেয়ে হইহই-রইরই কান্ড। তার চেঁচামেচিতে গ্ৰামের লোক এসে জড়ো হয়েছে, বাচ্চাটা ভয়ে তার মায়ের পিছনে গিয়ে লুকিয়েছে। গ্ৰামের নিত্য টিউবওয়েলে স্মান করা ব্যাক্তিবর্গের শায়াস্তা করতে দিদার আদেশে ঝোলানো হলো এক বড় তালা, যার চাবি দিদা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে। ফলত স্মান করা তো দূরের কথা জল নেওয়ার ও জো নেই। তাই সবার বাড়িতে যতটুকু সঞ্চিত জল ছিল সেটুকু দিয়েই সবাইকে সেদিনের মতো কাজ সারতে হয়েছিল। যেমন তার খারাপ গুন ছিল তেমনি আবার বেশ কিছু ভালো গুনও ছিল। আমাদের গ্ৰামের খবর দাতা ছিলেন তিনি, সাংবাদিকদের মতো দিদাও খবর বিলি করে বেড়াতো। কারো সাথে ঝামেলা করলে পরদিন কথা না বলে থাকতে পারত না, কথা না বলতে চাইলেও যেচে কথা বলতো। এরকম বিচিত্র ধরনের মানুষ ছিলে দিদা। এভাবেই দিদা আর অর্চনা পিসি বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু কদিনের মধ্যে পিসি নিজের জীবনের নতুন সঙ্গী খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, এবং পেয়েও গেছিলো। তখন দিদাকে একাকী রেখে নতুন সঙ্গী কে সঙ্গে নিয়ে চলে গেছিলো গ্ৰামান্তরে। দিদার সঙ্গে কোনো যোগাযোগই রাখেনি, সেই থেকে দিদা একা একাই থাকতো। কোনো সমস্যা হলে আমাদের বাড়ির সবাই যতটুকু পারতো সাহায্য করতো। হঠাৎ একদিন দিদা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, কিন্তু অন্য সময়ের মতো সাধারণ ওষুধে সারছিলো না। মেয়েদের সংবাদ দিতে সবাই এসে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করতে ধরা পড়ে ব্লাড ক্যান্সার। হয়ে গেছিলো শয্যাশায়ী‌ জীবন্মৃত , ডাক্তারের মতানুযায়ী তাকে সেবা শুশ্রূষার জন্য একজনকে থাকার প্রয়োজন, কিন্তু মেয়েদের মধ্যে নিজের সংসার ছেড়ে কেউ থাকতে নারাজ । গ্ৰামের কোন এক বৃদ্ধ পরমার্শ দিলো -' যদি মাসিক বেতনে কোন বিধবা মহিলাকে বলা হয় তাহলে হয়তো সে কাজটি করতে পারে।' মেয়েরা তখন একের পর এক সমস্যা মেলে ধরে বোঝাতে চাইলো কারোর কাছে টাকা নেই। বৃদ্ধ তখন বলিল 'বারো বিঘা জমি থেকে এক বিঘা বিক্রি করে যদি তোমাদের মায়ের..' বৃদ্ধের কথা থামিয়ে এক মেয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো -'তাহলে তো প্রত্যেকের ভাগে দু বিঘা করে জমি হবে না!' বৃদ্ধ কোন কথা না বলে সেখান থেকে মাথা নিচু করে বিদায় নিল। ইতিমধ্যে তুলসী দিদার এক নাতি দিদার কাছে যেতে চাইলো , তৎক্ষণাৎ তার বাবা মুখের মুখোশ সরিয়ে বললো- 'বাবু, তোমার দিদার কাছে যেওনা । ওই রোগ তোমার ও হতে পারে, তুমি আমার একমাত্র ছেলে।' এইসব কথা শুনে নির্বাক কন্ঠে দিদার চোখ দিয়ে অঝরে জল ঝরতে লাগলো। মেয়ে- জামাই দের কানাঠুসি বাক্যালাপ শোনা গেল। দিদার বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তাতে উঠতেই ভেসে আসলো মেয়েদের সমবেত ক্রন্দন। কিছুক্ষনের মধ্যেই কানে বাজলো কাঠ কাটা কুড়ালের আওয়াজ, আর সমস্ত গ্ৰাম ছড়ালো পাড়া প্রতিবেশীদের সমালোচনার ঘুড়ি।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register