Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় সুতপা মুখার্জী

maro news
।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় সুতপা মুখার্জী

মঙ্গলমূর্তি

"গনু, তোমায় কতবার বলেছি বাবা যখন মায়ের সাথে কথা বলবে তখন এঘরে আসবেনা?"-নীলের কথার রুক্ষতা স্পর্শ করে আট বছরের গনুকে। হ্যাঁ, গনুর ওই একটাই নাম। সন্তান সুস্থ, স্বাভাবিক হলে ভালো নাম দেওয়ার যেমন হুড়োহুড়ি পড়ে যায় গনুর মতো হলে ততটাই হতশ্রদ্ধার ব্যাপার হয়ে যায়, তাই গনুর শুধুই মায়ের দেওয়া একমাত্র নামটাই আছে, একমাত্র মায়েরই ভালোবাসার মতো। আর কেউ গনুকে জড়িয়ে ধরে না, বুকের ওম দেয়না, মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে গনু মা মা গন্ধ পায়, ঠিক শরতের শিউলি ফুলের মতো। গনু শিউলি ফুল খুব ভালোবাসে, কিন্তু সে তো সারাবছর থাকেনা, ঠিক মায়ের মত। মা সারাদিন গনুকে আদরে ভরিয়ে রাখে বুঝতেই দেয়না গনু অন্যদের থেকে আলাদা, কিন্তু বাবা ফিরলেই মায়ের মুখটা অন্যরকম হয়ে যায়, বাবা মা কে খুব বকে, গনু জানে ওর জন্যই মাকে বকুনি খেতে হয়, ও তো আট বছরের অন্য বাচ্চাদের মতো নয়, ওর আচরণ এখনো চার বছরের বাচ্চার মতো, ও এরকমই থাকবে, বাবা রোজ বলে, গনু শুনেশুনে সব বুঝে ফেলেছ। বাবা বলে গনুকে তো বাবা চায়নি, মা ই জোর করে গনুকে এনেছে, তাই গনুর সব দায়িত্ব মায়ের। মা তো সবই করে, কিন্তু বাবার যেন কিছুই পছন্দ হয়না। বাবা এসে পড়লে মায়ের আর গনুর আর একসাথে থাকা হয়না। গনুর খুব কষ্ট হয় বিনিমাসির কাছে থাকতে। বাবার একটা ভালো ছেলে চাই, বাবার মত, যাকে বাবা অফিস পার্টিতে নিয়ে যেতে পারবে, পাশে নিয়ে শোবে, ন্যাপি পাল্টাবে, আর সেটা হওয়ার জন্য মা আর গনুও রোজ প্রার্থনা করে। সেই ছেলেটা হলে তো বাবা আর মাকে গনুর কাছ থেকে নিয়ে নেবেনা। আর মায়ের অফিস মা কবেই ছেড়ে দিয়েছে গনুর জন্য। মা বলে- গনু আমার স্পেশাল চাইল্ড, সবার চেয়ে ভাল, সেরা। আজ গনেশ চতুর্থী, আজকের দিনে গনু হয়েছিল, মানে আজ ওর জন্মদিন। বাবা তো গনুর জন্মদিন করা পছন্দ করেনা, তাই মা গনেশের মূর্তি আনে, পূজো হয়, আর তার ফাঁকে গনুর জন্মদিনটাও পালন হয়ে যায়। গনু লাড্ডু খেতে খুব ভালবাসে, পায়েসও। আজ বাড়িতে পুজো, ব্যাস্ততার মাঝেই মা গনুকে পরিপাটি করে সাজিয়ে দিয়েছে। পুজো চলছিল, হঠাৎ গনু দেখে বাবার পাঞ্জাবীতে একটা মোমবাতি পড়ে গেছে, আগুন জ্বলছে পাঞ্জাবীর পিছন দিকটায়। মা, বাবা দুজনেরই চোখ বন্ধ, হাত জোড়া, বোধহয় গনুর ভাইয়ের আসার জন্য প্রার্থনা করছে। গনু আওয়াজ করতে করতে হাত দিয়ে থাপ্পড় দিতে লাগল আগুনে, নিভে গেল আগুন, আর তক্ষুনি বাবা কিছু না বুঝে গনুকে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিয়ে বলল-"জীবনে বিরক্তি ধরিয়ে দিল, বিকলাঙ্গ ছেলে, একটা দিন শান্তি পেলামনা।" গনু ফোঁপাচ্ছিল, মা গনুকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে ছিল, মায়ের চোখে জল দুর্গা প্রতিমার বিসর্জনের সময়ের মুখের মত। তখনই মায়ের চোখ পড়ে বাবার পোড়া পাঞ্জাবীর দিকে, তাড়াতাড়ি গনুর হাতদুটো মেলে ধরে মায়ের কিছু বুঝতে বাকি থাকেনা। গনুর হাতে ততক্ষণে দগদগে ফোস্কা। মা কিচ্ছু না বলে গনুকে কোলে নিয়ে ডাক্তারকাকুর চেম্বারের দিকে হাঁটা দেয়। বাবা কেমন হকচকিয়ে গিয়েছিল যখন বিনিমাসি বলেছিল-"খুব বেঁচে গেলেন দাদা, ভাগ্যিস গনু ঠিক সময় আগুনটা নিভিয়েছিল। আহা, ওই ছেলের বুদ্ধি থাক না থাক কত টান, মায়া। হাত পুড়িয়ে বাবাকে বাঁচিয়েছে।" দু হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে গনু সেদিন আরামে ঘুমোচ্ছিল-আজ পাশে মা শুয়েছে। তখন কত রাত কে জানে! গনুর মাথায় কিরকম একটা সুড়সুড়ি লাগছিল, তারপর একফোঁটা বৃষ্টি পড়ল ঘরের মধ্যে? গনু চোখ মেলে দেখল বৃষ্টি নেই, পাশে মা ঘুমোচ্ছে, এবার মাথার ওপর দিকে তাকিয়ে দেখল বাবা। বাবার হাত গনুর মাথায়, ফোঁটাফোঁটা জল বাবার গাল বেয়ে গনুর কপালে এসে পড়ছে। গনু মুখ দিয়ে একরকম আওয়াজ করল, এটা কষ্টের আওয়াজ, মা জানে। মা ধড়ফড় করে উঠে বসল, আর বাবাকে দেখে চমকে গেল। কেউ কোনো কথা বলছিল না। গনু দু হাত বাড়িয়ে দিল। গনুর ছোট্ট বুকের খাঁচায় ভালবেসে বন্দী হল ওর মা বাবা। গনু মনেমনে গনেশকে ধন্যবাদ দিল। এবারের জন্মদিনের সেরা উপহার দেওয়ার জন্য। ….. গনপতি আমাদের আশেপাশেই থাকেন, প্রয়োজন -শুধু অনুভব করে তাকে সমাদর করার।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register