Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় সংগ্রামী লাহিড়ী

maro news
।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় সংগ্রামী লাহিড়ী

স্নেহ অতি বিষম বস্তু

সল্টলেকের বাড়িতে আজ তুমুল হৈচৈ| ছেলেমেয়েদুটো কারোর কথাই তাহলে শুনলো না? সল্টলেকের ছেলেটা আর নিমতার মেয়েটা| একজন সদ্য খড়্গপুর-ফেরত, চাকরিতে ঢুকেছে মোটে কয়েকমাস| আরেকজনের তো কলেজই শেষ হয়নি| এমন অবাধ্য তো এরা ছিল না আগে? এতো করে বারণ করলেন দুই বাড়ির চার অভিভাবক! সল্টলেকের কর্তা তো আকাশ থেকে পড়েছিলেন, “তোরা দুজন 'একলা একলা' বেড়াতে যাবি? সে কী? একলা বেড়াতে গেছিস কখনো? থেকেছিস তো খড়্গপুরে, কলকাতা শহরটাই চিনিস না ভালো করে| না না, ওসব চিন্তা মাথা থেকে বার করে দে| হানিমুন কি পালিয়ে যাচ্ছে নাকি?” কথাটা খুব মিথ্যেও নয়| খড়্গপুর থেকেই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে চাকরি| বাইরের দুনিয়ার কোনো ঝড়ঝাপ্টা তো সামলাতে হয় নি? ওদিকে নিমতা থেকে ফোনে উদ্বেগ ঝরে, "হারিয়ে যাবে, নির্ঘাত হারিয়ে যাবে| মেয়েকে কী কখনো আমি একলা ছেড়েছি? সবসময় সঙ্গে করে কলেজে পৌঁছে দিয়েছি আবার অফিস ফেরত তুলেও এনেছি| ওর মায়ের সঙ্গে গেলেও আমার টেনশন হতো| সে কিনা যাবে হানিমুনে? একটা অর্বাচীন ছেলের সঙ্গে? তাও কী হয়?” এই একটি ব্যাপারে সল্টলেক আর নিমতার কোনো মতবিরোধ নেই| তিলমাত্র আস্থা রাখা যায় না এদের ওপর| জানেই বা কী আর বোঝেই বা কী? আগে বড় হোক তারপর হানিমুনে যাবে'খন| তা এমনই নাছোড় যে কারোর কথায়ই কান দিল না? সেই গোঁ ধরে বসে রইলো? প্রথমে অবশ্য দুজনেই দমে গিয়েছিল| একটু যে ভয় করে নি, তাও নয়| হাজার হলেও বড়দের কথা শুনেই তো চলেছে এতকাল| শেষে কলেজপড়ুয়াই ঝেড়েঝুড়ে উঠে হাল ধরলো, "যাবোই আমরা|" ফোনে ধরলো বাবা-মাকে, "বিয়ে তো দিয়েছো আমার, তাহলে?" "সে মনে করেছি তাই বিয়ে দিয়েছি| তাই ব’লে এত বড় লায়েক হয়ে যাওনি যে নিজেরা নিজেরা হানিমুনে যাবে|” বাবা-মা ধমকে দিলেন| কলেজপড়ুয়ার আরোই জেদ চেপে গেল| যাবেই সে, মানে তারা| খড়্গপুর তখনো দ্বিধায়, "বেড়াতে গেলে কতকিছু ব্যবস্থা করতে হয়, ট্রেনের টিকিট, হোটেল বুকিং, আরো যেন কী কী সব| কে করবে ওগুলো?" "আমি করবো| তুমি শুধু দেখে যাও|" খড়্গপুর নিশ্চিন্ত| যাক বাবা, বাঁচা গেছে| কী করে কী করতে হয় অতসব খবর সে রাখে না| জায়গা বাছা হলো| সমুদ্দুর দুজনেরই খুব পছন্দের| চাঁদিপুর কলকাতা থেকে খুব দূরে নয়| বেশি লোকের ভিড়ভাট্টাও নেই| থাকবার জায়গা অল্পই| খোঁজখবর করে তার মধ্যেই একটা কটেজ বুক করে ফেললো কলেজপড়ুয়া| সে সব ছিল না-ইন্টারনেট, না-মোবাইল ফোনের যুগ| এক রাতে খড়্গপুর অফিস থেকে ফিরে সবে ব্রিফকেসটি নামিয়েছে, পেছন থেকে চোখে হাতচাপা পড়লো| "চোখ বুজে বলো তো দেখি হাতে কী?" "না দেখে কী করে বলবো? তুমিই বলো|" "টিং টং, চাঁদিপুরের ট্রেনের টিকিট! এই যে" দুখানি টিকিট চোখের সামনে দোলে| "চাঁদিপুরের ট্রেনের টিকিট? কে কাটলো? মানে..." "কেন, আমি? স্টেশনে গিয়ে কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে কেটে নিলাম| সীটও রিজার্ভ করে নিয়েছি| আর হোটেল তো আগেই বুকড|" "হোটেলও বুকিং করে ফেলেছো? কি করে করলে?" "এ আর এমন কী কথা! কয়েকদিন ধরে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনগুলোতে চোখ রাখছিলাম| এই করেই পেয়ে গেলাম একটা কটেজ| খুব নিরিবিলি, জানো? সমুদ্রের একদম ধারে, কয়েকটা ছোটছোট কটেজ| নাম শান্তিনিবাস| এই তো, গতকাল-ই বালিগঞ্জে গিয়ে তার মালিকের সঙ্গে দেখা করে বুকিংএর টাকা দিয়ে এলাম| ব্যাস, এবার সব ব্যবস্থা পাকা|" খড়্গপুরের চোখে মুগ্ধ, বিহ্বল দৃষ্টি, "তুমি, মানে, তুমি এতকিছু পারলে? একা একা? সত্যি, তোমার তুলনা নেই!" কলেজপড়ুয়ার ছাতি ফুলে ছাপ্পান্ন, কিন্তু চোখে লজ্জা ঘনিয়ে আসে, "ধেৎ|" বলেই আবার তেড়েফুঁড়ে ওঠে, "এবার কিন্তু তোমায় একটু নড়েচড়ে বসতে হবে| বাবা-মা যতই বলুক না কেন, হানিমুনে আমরা যাচ্ছি| আর সে কথাটা তোমায় পষ্ট করে ওঁদের বলে দিতে হবে|" বৌ এত কিছু করতে পারে দেখে খড়্গপুরও এবার উৎসাহ পেয়েছে, "নিশ্চয়ই, বলবোই আমি এবার| দেখে নিও তুমি|" হানিমুনের সব ব্যবস্থা যে যে নিজেরাই করে নেওয়া যায়, তা কী সে স্বপ্নেও ভেবেছে? তবে ছুটির ব্যবস্থাও তো তাকে করতে হবে? গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিকে কে কবে হানিমুনের ছুটির দরখাস্ত করতে দেখেছে? যা থাকে বরাতে, দিয়ে দিল ছুটির অ্যাপ্লিকেশন| কী আশ্চর্য, এক কথায় মঞ্জুর| বস আবার ঘরে ডেকে বললেন "খুব আনন্দ করে এস"| খড়্গপুর তো খুশিতে দিশাহারা| কলেজপড়ুয়ার আবার অন্য চিন্তা| ক্লাস কামাই করলেও নোটসএর যোগান রাখতে হবে| ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাসে নোটস-ই ভগবান, নোটস-ই মা সরস্বতী| কার্বন পেপার পৌঁছে গেল ল্যাবমেটএর কাছে – ‘নোটস নেওয়ার সময় খাতার পাতার নিচে শুধু একটু গুঁজে দিস ভাই, তাহলেই হবে|’ ব্যাস, এবার সব আয়োজন সম্পূর্ণ| শুধু অভিভাবকদের জানাতে হবে| খড়্গপুরই বোমাটা ফেললো| সংবাদটি পরিবেশন করলো যাবার তিনদিন আগে, খাবার টেবিলে| বজ্রপাত হলো সঙ্গে সঙ্গে| ভেটকীর পাতুরি ফেলে সল্টলেকের কর্তা দৌড়োলেন ফোনের কাছে| নিমতায় জানাতে হবে এক্ষুণি| দুটো সদ্য-অ্যাডাল্ট ছেলেমেয়ে চাঁদিপুরের সমুদ্দুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে চলেছে| কোনোমতে যদি আটকানো যায়| কর্ত্রী দোলাচলে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না কী বলা উচিত| কিছুই করা গেল না| অবশেষে শনিবারের কু-ঝিক-ঝিক ট্রেন, চাঁদিপুরের বালুকাবেলায় ছোট্ট কটেজ| সমুদ্দুর কাছেই তবে মাঝেমাঝেই সে 'টুকি' বলে পালিয়ে যায় অনেক দূরে| পড়ে থাকে বিরাট এক ভেজা বালির মাঠ| মহানন্দে চলছে সকাল বিকেল বেড়ানো| সমুদ্র সরে গেলে বালিতে কিলবিল করে জেলিফিশ, ছড়িয়ে থাকে শামুক-ঝিনুক-শঙ্খের দল | কুড়িয়ে কুড়িয়ে জমায় তারা| সরে যাওয়া সমুদ্রের পথ ধরে দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় যতদূর খুশি| একটু দূরে গেলে জেলেদের বসতি| জাল ফেলে তারা মাছ ধরে | তাদের থেকে কেনা হলো সদ্য-ধরা সমুদ্রের মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া| কটেজে নিয়ে এসে রাঁধুনীকে বলা হল রান্না করে দিতে| এও জীবনে প্রথম| নিজেরা বাজারে গিয়ে মাছ কেনা, সেই মাছ আবার রান্না করিয়ে খাওয়া! এত বিস্ময় তারা রাখবে কোথায়? আনন্দের বেলুনে প্রথম ছোট্ট একটি পিন ফুটলো - পাশের কটেজে লোক| একজন-দুজন নয়, বেশ কয়েকজন ছেলে একসঙ্গে| ভব্যতার ধার ধারে না| হৈহুল্লোড়, চেঁচামেচিতে নির্জন সৈকত চমকে চমকে ওঠে| খড়্গপুর ভীত হলেও কলেজপড়ুয়া অদম্য, “ওরা আছে ওদের মত, আমরা আছি আমাদের মত| কী এসে গেল তাতে?” কিন্তু এসে গেল অনেক কিছু| বেরোলেই তীব্র সিটির আওয়াজ, বালুকাবেলায় লেখা - বৌদি, আই লাভ ইউ ইত্যাদি| এবার কলেজপড়ুয়ার মনোবলেও চিড় ধরেছে| ব্যাপারটা ঠিক সুবিধের ঠেকছে না| দুজনে পরামর্শ করে, কাল স্টেশনে গিয়ে দেখতে হবে ফেরার টিকিট পাওয়া যায় কিনা| বিকেলে ম্যানেজারের কাছে শুনলো অন্যপাশের কটেজটাও বুকিং হয়ে গেছে| আসছেন সরকারী এক হোমরাচোমরা| সঙ্গে আবার 'ফ্যামিলি'| মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো দুজন| নির্জনবাসের দফা-রফা| দুনিয়াশুদ্ধ লোকের কি চাঁদিপুরেই বেড়াতে আসার দরকার পড়লো? ঠিক এখন? এই সময়? রাত্তিরে দুজন বেজারমুখে ডিনার সারছে| টাটকা মাছের ঝোলভাত, কিন্তু তাও বড় বিস্বাদ| পাশের কটেজে তালা খোলার আওয়াজ| টুকরো কথা ভেসে আসছে – ‘ইয়েস স্যার, জো হুকুম হুজুর, আপনি যেমনটি বলবেন|’ হোমরাচোমরা বলে কথা! পরদিন সকাল| কলেজপড়ুয়ার মনে মেঘের মেলা| ব্যাগপত্র গোছাতে হবে| আগে স্টেশনে গিয়ে দেখা যাক, ট্রেনের টিকিটটা এগিয়ে নেওয়া যায় কিনা| দুজনে 'একলা' বেড়ানো তাহলে সত্যিই সহজ নয়| খড়্গপুর ঘরে ঢুকলো| বিস্ফারিত চোখ, "বাইরে গিয়ে দেখো একবার|" কলেজপড়ুয়া কৌতূহলী হয়| কি ব্যাপার? বাইরে বেরিয়ে দেখে খোদ সল্টলেকের গৃহকর্তা দাড়ি কামাচ্ছেন| দুপাশে দুজন অধস্তন কর্মচারী| একজন আয়না ধরে আছে, অন্যজনের হাতে গরম জলের বাটি| কর্ত্রীও উপস্থিত| বাগানে বসে আয়েস করে চুমুক দিচ্ছেন চায়ের কাপে| এদের দুজনকে দেখলেন| কোনো অভিব্যক্তি ফুটলো না মুখে| হোমরাচোমরাও নির্বিকার| কে কোথাকার দুটো পুঁচকে ছেলেমেয়ে - ফিরেও তাকালেন না| গুটিগুটি পায়ে ঘরে ঢুকে এলো খড়্গপুর-কলেজপড়ুয়া| এখন যেন ঠিক অতটা ভয় আর করছে না| ট্রেনের টিকিট বদলাবারই বা দরকার কী? ওই কয়েকটা ধেড়ে খোকার উৎপাত? ফুঃ, ওরা তো এক ধমকেই ঠান্ডা! কলেজপড়ুয়া হাঁপ ছাড়ে, “বাব্বা, বুকটা সত্যি ঢিপঢিপ করছিলো|” খড়্গপুর মিষ্টি একটু কুটুস কামড় দেয়, "তাই নাকি? তুমি না বীরাঙ্গনা?” “তা হলেও… যাক বাবা, এখন নিশ্চিন্দি|” একগাল হাসি দুজনেরই মুখে| অভিভাবকদের স্নেহচ্ছায়ায় মধুচন্দ্রিমার বাকি দিনগুলো তাহলে নিঃশঙ্কচিত্তেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে|
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register