Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় উত্তম চক্রবর্ত্তী

maro news
।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় উত্তম চক্রবর্ত্তী

জগনবাবুর শ্মশান বৈরাগ্য

ভোরেই জগনবাবুর ঘুমটা ভেঙে গেল। কে যেন বাইরে থেকে ডাকছে। ঘুমের আড়ষ্টতা কাটিয়ে আবারও শুনতে পেলেন ডাক টা। নাহ্ ,অগত্যা বিছানা ছেড়ে সদর দরজা খুলতেই দেখলেন, দরজার ওপারে গ্রামের মাতব্বর ছেলে বটু। ইদানীং ইঁট বালি বিক্রি করে দুটো পয়সা করেছে বলে মাতব্বর হয়ে উঠেছে। বটু বলল, চটপট তৈরী হয়ে নিন। শ্মশানে যেতে হবে। জগন বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কেন রে বটু ? বটু আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বলল, এ মা, আপনি জানেন না, গত রাতে নিরন বাবু মারা গেছেন? বড্ডো উপকারী লোক ছিল নিরন। গ্রাম কেন, অঞ্চলের সকলের কথা ভাবতো। বয়স কতই বা হবে। না, দীর্ঘশ্বাস ফেলে জগনবাবু শ্মশানে যাওয়ার জন্য তৈরী হতে লাগলেন। দড়ির খাটিয়ায় নিরনের মৃতদেহ। নির্বিকার। শ্মশান যাত্রীদের একটানা বল হরি হরিবোল জগনবাবুর ভিতরটা মোচড় দিতে লাগলো। কাঁসাইয়ের পাড়ে মৃতদেহ নামিয়ে ছেলেরা চুলা তৈরীতে ব্যস্ত। জগনবাবু কাঁসাইপারে বুড়ো বট গাছটার তলায় এসে বসলেন । একাকী । তাকিয়ে দেখতে লাগলেন, শেষ শয্যা নির্মানের কৌশল। দেখতে দেখতে শরতের বেলা বাড়তে লাগল। চুলা নির্মাণ শেষ হলে ঘাটের লৌকিক ক্রিয়া কর্ম শেষে পাঁচ ছয় জন ছোকরা মৃত নিরনকে শ'য়ে চাপিয়ে চুলার নীচে আগুন ধরিয়ে দিল। চিতা ছেঁড়া টায়ারের কল্যাণে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। নিরনের ভাই দু হাঁটুর মাঝে মাথা নামিয়ে হুপহুপিয়ে কাঁদতে লাগল। বট গাছের তলায় বসে জগন বাবু ওপারে বাসুডি -কলাবনীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন, কাঁসাইয়ের ওপারেও কারা যেন শব দাহ করতে এসেছে। জগনবাবু মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন পৌলমীর দিকে। নাহ্, ওখানেও পৌলমীর ঘাটে চলছে মড়া পোড়ানোর তোড়জোড়। একদিনে এত মানুষ মারা গেল! আর ভাবতে পারছেন না। চোখ বুজে বুড়ো বট গাছে ঠেস দিয়ে বসলেন। মনে মনে ভাবলেন ,এই তো সংসার। মাত্র কয়েকটা বছর বেঁচে থাকা। তার মধ্যে কত হানাহানি, জমি জিরাত, সম্পদ নিয়ে কত ঝগড়াঝাঁটি। অথচ একমূহুর্তে সব কেমন ছেড়ে চলে যেতে হয়। তাঁর নিজেরও জমি জায়গা নিয়ে ভাইদের সাথে কম ঝামেলা হয়নি। ভাই গুলো বেকার। কত কষ্টের মধ্যে দিন গুজরান করে। অথচ তিনি শিক্ষকতা করে রিটায়ারের প্রভূত টাকা পেয়েছেন। নিজে ভালো খান, ছোট ভাইগুলোর দু বেলা ভালো করে জোটেও না ।ছোটবেলায় মা সব ভাইবোনদের কত যত্ন করে খেতে দিতেন। ভাই বোনেরা একসাথে বসে খাওয়ার আনন্দ ছিল। আজ ভাই দের সাথে তুচ্ছ সম্পত্তি নিয়ে মুখ দেখা দেখি পর্যন্ত বন্ধ। শ্মশানে বসে জগনবাবু ভাবেন, কি হবে এই অসার সম্পত্তিতে। তার চেয়ে আজ ভাইদের ডেকে সব বিবাদের অবসান ঘটিয়ে আবার একসাথে বসে খাবো। সব সুখ দুঃখ ভাগ করে নেব। বেলা প্রায় পড়ে এসেছে। উত্তরে সাগেন পাহাড়ে সূর্যের আলো ঠিকরে আসছে। শরতের হাল্কা হাওয়ায় ধান গাছ গুলো তে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। জগনবাবু নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন চাঁদড়ার ওপারে সাগেন পাহাড়ের দিকে। মাস্টার মশাই ,ও মাস্টার মশাই -- বটুর ডাকে জগনবাবু তার দিকে ঘুরে বসলে , বটু বলে, চলুন বাড়ী । দাহ কাজ শেষ। একবুক বৈরাগ্য নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন জগন মাস্টার। বাড়ীতে ঢুকতেই জগনবাবুর স্ত্রী ছুটে এসে বললেন, ---- দেকো, কান্ডি ট দেকো তুমার ভাইদের। ঢের কইরে বারণ করার পরহেও হামদের দুহাত জাইগার উপরে গুড়হা-বেড়হা তুইলছ্যে। তুমি নাই থাকাতে উয়ারা বতর পাইয়্যে গেছে। তখনও জগনবাবুর ছোট ভাই পাঁচিল তুলতে ব্যস্ত। জগনবাবু হাঁক দিয়ে বললেন, বদনা পাঁচিল বন্ধ কর। তাই যদি তুলবি আগে মাপজোপ কর। বদনা ততোধিক জোরে বলল, আমার মাপ জোপ করা আছে। জগনবাবুর স্ত্রী বললেন, বইলল্যেই হবেক্। হামদের দু হাত জাইগা তুমরা দখল লিচ্ছ। ইটা মান্যে লিব নাই। বদন কাজ বন্ধ না করলে জগনবাবু ঘরে ঢুকে কাছেই পেলেন টাঙ্গিটা। দুহাতে তুলে নিয়ে বদনার দিকে তেড়ে গেলেন। বদন গুড়াবেড়া ছেড়ে ছুটতে লাগল। টাঙ্গি হাতে তাড়া করছেন জগনবাবু। পিছনে পড়ে রইল জগনবাবুর শ্মশান বৈরাগ্য।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register