Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য দূরীকরণ দিবসে মৃদুল শ্রীমানী

maro news
আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য দূরীকরণ দিবসে মৃদুল শ্রীমানী

দরিদ্রের রবীন্দ্রনাথ

আজ আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য দূরীকরণ দিবস। এই দিনটি ইউনাইটেড নেশনস ১৯৯২ থেকে পালন করে চলেছেন। সারা পৃথিবীতে গরিব মানুষ ভয়াবহ রকমের বঞ্চনার শিকার। একদিকে যেমন অনাহার ও অপুষ্টি, চিকিৎসার অপ্রতুলতা তার চিরসঙ্গী, তেমনি শিক্ষার অভাব তাকে পঙ্গু করেছে। এরসাথে জোটে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ - ১৯৪১) তাঁর জীবৎকালে গরিবের কষ্ট, তার উপর সামাজিক অর্থনৈতিক শোষণ, উচ্ছেদের মতো বিষয়গুলির দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
অর্থনৈতিক পরিচয়ে জমিদারি ছিল তাঁর জীবিকা। সামাজিক পরিচয়ে তিনি ছিলেন এলিট শ্রেণীর লোক।
পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলায় শিল্পোদ‍্যোগের প্রথম যুগের কাণ্ডারী। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলার নবজাগরণের ও ব্রাহ্ম ধর্ম আন্দোলনের দিকপাল ব‍্যক্তিত্ব। মেজদাদা সত‍্যেন্দ্রনাথ ছিলেন আইসিএস ও জজসাহেব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও তারুণ্যের দিনে পারিবারিক আয়োজনে ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করতে গিয়েছিলেন। সুতরাং আর্থসামাজিক প্রশ্নে গরিবানা উপলব্ধির বাস্তব সুযোগ তাঁর গড়ে ওঠার দিনগুলিতে ছিল না।
কিন্তু গরিব হলে তবেই গরিবের দুঃখ অনুভব করা যাবে, হিসেবটা কিন্তু সে রকম নয়। গরিবের দুঃখ বুঝতে একটা সহৃদয় আর সংবেদনশীল মন লাগে। আর লাগে মানবতাবাদে গভীর বিশ্বাস। এগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিল। তার উপরে ছিল যুক্তিবাদে আস্থা।
আমার কথা শুরু হোক অন্নকষ্টের প্রসঙ্গ দিয়ে।
ইংরেজ আসার আগে যে এদেশের নিম্নকোটির মানুষ খুব ভাল করে খেয়ে পরে বাঁচত, এটা আদৌ সত‍্যি নয়। ন‌ইলে ফুল্লরা চণ্ডীকে বলবে কেন, আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ‍্যমান, কিংবা চর্যাপদের কবি বলবেন, হাঁড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী। অন্নকষ্টের চূড়ান্ত কথাটা যেন বলে গিয়েছে ঈশ্বরী পাটনী। দেবীর কাছে বর চাইবার সুযোগ এলে ঈশ্বরী পাটনী বলেছে আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।
আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমে দেখতে পাচ্ছি, ছুটি গল্পের ফটিককে। মাখন আর ফটিক, বিধবা মায়ের দুই নাবালক ছেলে। টানাটানির সংসার। আর্থিক টানাটানির জ্বালাতেই ফটিকের মা ফটিকের বয়সোচিত দুষ্টুমিকে সহ‍্য করে উঠতে পারেন না। মামা নিয়ে গেল ফটিককে। ফটিকের মা ভেবেছিলেন অন্নসংস্থানের বুঝি একটু সুরাহা হল। সে যে কত বড় ভুল ছিল, তা ছুটি গল্পটা পড়লে স্পষ্ট হবে।
রতন ছিল একটা ছোট মেয়ে। তার বাবা মা ছিলেন না। অনাথা বলাই যায়। রতন পোস্ট মাস্টারের বাসায় গৃহকর্ম করে দিত। বিনিময়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, দুইবেলা চারিটি চারিটি  খাইতে পাইত। রতন রান্না করতে পারত না। পোস্টমাস্টার নিজেই রাঁধতেন। রতন জল এনে দিত । বাসন মেজে আনত। আর রাতের বেলা গোটাকতক রুটি গড়ত। পোস্ট মাস্টার রতনকে স্নেহ করতেন। কিন্তু আর্থিক সামাজিক অবস্থানের ভিন্নতার কারণে তা দয়া বা করুণায় পর্যবসিত হয়ে র‌ইল। রতন অবশ‍্য সে দয়া বা করুণা মেনে নিতে আপত্তি করেছে।
চাকরি পেয়েও এদেশের মানুষের সমস্যা ঘোচে না। কেননা, বেতন দেওয়া হয় অতি সামান্য। এতটাই তা শীর্ণ, যে চাকুরিজীবী লোকটিকে আরো কোনো বাড়তি উপায়ের সন্ধান রাখতে হয়। অর্থনীতির ভাষায় একে ছদ্মবেকারত্ব বলে। সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানিটির কথা বলেন রবীন্দ্রনাথ। বাসা ভাড়া করে কলকাতায় থাকেন লোকটি। বাসায় দেওয়ালে টিকটিকি থাকে। তার তো ভাড়া লাগে না। ভাড়ার টাকাটা দিতে নিম্ন আয়ের মানুষের বেশ গায়ে লাগে, সে কথাটা কৌশলে ধরিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ টিকটিকির বিনা ভাড়ায় থাকতে পারার প্রসঙ্গ এনে। ঘরে আলো জ্বালানোর সামর্থ্যটুকুও নেই। শিয়াল দহ স্টেশনে সন্ধ‍্যাটুকু কাটিয়ে সে দায় মেটে। নিজের ঘরে রান্নার আয়োজনটুকুও করতে পারে না লোকটি। দত্তদের বাড়িতে ছেলে পড়িয়ে কোনোমতে খাওয়াটুকু জোটে। ছদ্মবেকারত্ব যে ঠিক কি, তা এই কবিতাটি পড়লে বুঝতে আর বাকি থাকে না।
মোক্ষম মোচড়টি দেন শেষের দিকে। লোকটি এই গরিবানার মধ‍্যে বিবাহিত জীবনকে এনে ফেলতে চায় না। যাকে মনে মনে ভালবাসে, তাকেও বিবাহ করে গৃহলক্ষ্মী করার সাহস পায় না সে।  এক আশাহীন ভবিষ্যতের ছবি দেখান রবীন্দ্রনাথ।
গ্রামে তারা ছিল মানুষ। শহুরে ভদ্রলোকের বাড়িতে এসে হল চাকর। সেকালে গ্রামের পাঠশালাতে যে শিক্ষক তা করত, তেমন মানুষকে ও শহরের ভদ্রলোকের বাড়িতে এসে চাকরের কাজ নিতে হয়েছে। অন্নাভাব ছিল এতটাই প্রখর।
খোদ ঠাকুর বাড়িতেই এহেন উদাহরণ খুঁজে দেখান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জীবনস্মৃতির পাতায় তার প্রমাণ মিলবে।
চাকরের আরো গল্প বলেন পু্রাতন ভৃত‍্য কবিতায়। এইসব ভৃত‍্যদের জীবনটা দুর্বিষহ, নিরাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত। ব‍্যক্তি জীবনের কোনো সম্ভ্রম তো তার নেইই, প্রাইভেসিটুকুও নেই। তার গায়ে যখন খুশি হাত তুলে নিগ্রহ করা যায়। শহরের ইঁটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় একধরণের দাসব‍্যবস্থা চিরে চিরে দেখাতে থাকেন তিনি।
গরিবের গরিবানা যেমন করে দেখাতে পারেন রবীন্দ্রনাথ, তেমনি দেখান তাকে করুণার ছলে তার মেরুদণ্ডটুকু ভেঙে দেবার গল্প। মধু আর বিধু দুই বালক, আশ্বিনের মাঝামাঝি পূজার বাজনা বেজে উঠলে কি কি করতে থাকে, দেখান তিনি। তাদের বাবা ভদ্রকৃষক। প্রকৃতির উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল কৃষি ব‍্যবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে ব‍্যক্তি কৃষক কতদূর বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তা চিন্তাশীল মানুষ মাত্রেই অনুভব করতে পারেন।
এই অবস্থায় বালক গুপীর বাবা জনৈক রায়বাবু করুণা করার ছলে মধুর বাবার সামাজিক সম্মান হনন করেন। মধু শিশু, সে বুঝতে পারে না, একটা সাটিনের জামা পরে নিজের সহোদর দাদার ছিটের জামাকে ব‍্যঙ্গ করা কতদূর প্রতিক্রিয়াশীল। তার মা এই অসম্মানে চোখের জলে ভাসতে থাকেন।
মারধোর নয়, বঞ্চনা নয়, গরিবের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করা যায়, তাকে আত্মসম্মানবোধ হতে ভ্রষ্ট করলে।
(আজ প্রথমাংশ।)
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register