- 32
- 0
ভয়ের পর্দা সরলেও অজ্ঞতার পর্দা সরে যাওয়া তখনো বাকি ছিল মেয়েটার। আরো কবছর সময় লাগল। ততদিনে আরো অনেক বই পড়েছে সে, এগিয়ে গিয়েছে উচ্চশিক্ষার রাস্তায়। ঠাকুরমার ঝুলিও পড়েছে, অজস্রবার। আর প্রতিবার নতুন করে চিনতে পেরেছে চরিত্রদের। আজকাল তার দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই রাক্ষসী রানী। সে চোখে লোভ নেই, খিদে নেই, বরং একটা চাপা যন্ত্রণা আছে। যেন বলতে চায়, "এখন বুঝেছ তো, আমি কে? আমি ঠিক কেন রাক্ষসী রানী? রাজার বুড়ো বয়সের ছোটরানী আমি, যতদিন রাজা আছে আমার ঠাটবাট ঠিক ততদিনের। রাজা গেলেই প্রাসাদের রাজনীতি গিলে খেত আমায়। হয়ত পুড়িয়ে দিত রাজার মৃতদেহের সঙ্গে, কারণ বড় 'লক্ষ্মীরানীকে' তো বাঁচতে দিতে হবে, সে যে লক্ষ্মী, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নীতিবোধে সাজানো। আমি তো তা নই, তাই তো আমার মূলোর মত দাঁত, কুলোর মত কান, লকলকে জিভ, সে এমনিতে থাক বা না থাক। আসলে আমি স্বামী পুত্রের বাইরে গিয়ে নিজেরটা ভেবেছি, আমার লোভ রক্ত মাংসের থেকেও বেশি ক্ষমতার, যা একটা পুরুষমানুষের থাকলে তার প্রশংসা হয়। আর আমি হয়ে যাই রাক্ষসী, যাকে নিজের অস্তিত্ব, ক্ষমতা বাঁচাতে বীভৎস হতে হয়েছে। কিছুটা আমি নিজে হয়েছি, বাকিটা বানিয়েছে সমাজ, নয় তো রাজপুত্রদের জয় দেখানো যায় না। আচ্ছা বলো তো, সব গল্পই তো পড়েছ, আমি কি সেই 'মানুষদের' থেকেও খারাপ যারা সদ্যোজাত শিশুদের ছাইগাদায় পুঁতে দিল, বা মুখে নুন দিয়ে জলে ভাসিয়ে দিল? নাকি আমি সেই ভাইদের মত যারা উপকারী ভাইকে স্রেফ ঈর্ষা র জন্যে সমুদ্রে ফেলে দিল? আসলে কি জানো, লক্ষ্মী, বেচারি, দুয়োরানীদের জন্যে আহা করতে মানুষ ভালোবাসে, আর যে নিজের জন্য কিছু চায় তার অবস্থা হয় আমার মত। আচ্ছা একটা কথা ভেবে দেখেছ কি? এই যে তুমি ছোটবেলায় এত ভয় পেতে আমায়, এটা কমল কি করে? ভেবেছ কখনো? তুমি বলবে বড় হয়েছ, সাহস বেড়েছে। তা কিন্তু নয়। ভয়ের বাস মনের অনেক গভীরে। আমার ভয় তখনই কমেছে যখন আমার থেকেও ভয়ঙ্কর কোনো দুপেয়ে জীবকে সামনে দেখেছ। তাদের কিন্তু তোমার মতোই দেখতে। এই দুপেয়ে গুলোর ভাঁটার মত চোখ না, দৃষ্টির নোংরামি ভয় ধরায়। বাসে ট্রেনে সর্বত্র ভীড়ের সুযোগ নিয়ে তোমাদের যন্ত্রণা দেয়, একা গলিতে ভয় দেখায়, ছোটবেলায় আদরের নামে অত্যাচার করে,অ্যাসিড মারে, চরম কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলে, এরাই। এরাও তো রাক্ষস, মানুষের রূপে।আমাদের মত এদের রূপ দেখতে তরাস লাগে না, বলি চিনবে কি করে?-----"
গল্পটা এতটা লিখে, চুপ করে বসে ছিলাম। কি লিখতাম! ভয় আর ভয়কে জয় করার থেকেও বড় প্রশ্ন সামনে এসেছে, রাক্ষস আসলে কে? গল্পকথার ছোটরানী? না বাস্তবের দু পেয়ে? যারা রক্ত, মাংসের সঙ্গে আত্মবিশ্বাস, সাহস, সম্মান জীবনীশক্তি,সর্বস্ব খায়??? কি লিখব? হয়ত উত্তর খুঁজতে সাহায্য করবে বলেই এই সময় পাশের বাড়ি থেকে ফুড়ুৎ করে উড়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরল এক ছোট্ট পরী। সবে সে লালকমল নীলকমল এর গল্পটি শুনেছে আর ভয়ের থেকে তার কৌতুহলই বেশি।
"ও মিস, অজিত- কুসুমই তো লালকমল নীলকমল বলো? তাহলে প্রথমে ওদের রাক্ষসে খেল, আর পরে ওরাই রাক্ষসদের মারল, কি করে? ওদের কি পরে গায়ে জোর হয়ে গেছিল?"
"দূর পাগলি, তা হয় কখনো? জোর তো ওদের ছিলোই, তবে সেটা তারা প্রথমে বোঝেনি। আর তার থেকেও বেশি এটা বোঝেনি যে রাক্ষসটা কে আর তার আক্রমণ কোথা থেকে আসবে। তাই লালকমল নীলকমল হয়ে তারা নিজের শক্তি চিনেছে, সেইসঙ্গে রাক্ষসকেও। চিনতে পারলে তবেই তো রাক্ষসের সঙ্গে লড়াই করা যায়, এমনকি মানুষ-রাক্ষসের সঙ্গেও। বড় হয়ে বুঝবি সেটা। এখন গল্প শোন"।
0 Comments.