Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

গল্পে শর্মিষ্ঠা সেন

maro news
গল্পে শর্মিষ্ঠা সেন

উড্ডু এবং খারাপ টিভির গল্প

দুপুর বেলা উড্ডুর আর সময় কাটে না। টিভিটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে অনেকদিন।
মা বা বাবার কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই যেন! ওর কী একটু রিল্যাক্স করতে ইচ্ছে করেনা? এই যে উড্ডু স্নান সেরে চুল টুল আঁচড়ে, ক্রিম মেখে ভালো মেয়ের মতো চুপটি করে বাবার পাশে গিয়ে বসে গুনগুন করছে এর মানেটা আসলে কী? কেউ ভেবে দেখেছে? কেই বা ভেবে দেখবে ! বাড়িতে শুধু বাবা আর মা! ঠাম্মা দাদা অনেক দিন আসতে পারছেন না করোনার জন্যে! এদিকে মা বাবা তো নিজেদের কাজে ব্যস্ত, আর ওদের তো ল্যাপটপ, মোবাইল সব আছে! উড্ডুর শুধু সকাল থেকে পড়া আর পড়া! স্কুলের অনলাইন ক্লাস, হোমওয়ার্ক, টিউশান... ক্লাস শেষ হলেই মা বলবে 'উড্ডু, চোখ দুটোকে রেস্ট দে। বই খাতা বন্ধ কর।' তাহলে উড্ডু করবেটা কী? গল্পের বই? হুহ্! বিগ নো নো! পরীক্ষা যে সামনে! এখন মাথায় অন্য কিছু ঢোকানো বারণ। মা সব কিছুতে লক্ষণের গন্ডী‌ কেটে রেখেছে। তাতে আর কী? টিভিটা চললে শুধু শিন চ্যান দেখা হতো, কিছুই ক্ষতি হতো না পড়ায়। এই যে উড্ডু এখন বাবার পাশে বসে দেওয়ালের রং চটা, চুন ওঠা জায়গাটা দেখতে দেখতে এত কিছু ভাবছে, তার খবর কে রাখছে? মাথাটা তো মোটেই বিশ্রাম পাচ্ছে না! এদিকে আবার গুনগুন করে গানটাও একা একাই গলা থেকে আসছে, উড্ডুর মনটাই উড্ডুর কথা শোনেনা, মা বাবাকে আর কীই বা বলবে!
খাওয়া দাওয়ার পর মা মোটা একখানা বই নিয়ে বিছানায় আসেন। এসে কিন্তু বই না খুলে মোবাইল চেক করেন।
উড্ডু বলে,‌ 'মা, এখন আমি কী করবো?'
মা বলেন, 'একটু শো আমার পাশে। বিশ্রাম কর।'
'কিন্তু মা, আমি ঘুমোবো না, রাতে ঘুম আসতে দেরী হয়!' উড্ডু বলে।
'তাহলে আর কী‌ করবি, একটু ব্যালকনি তে বসে গাছ দ্যাখ গে, পাখি আসে নাকি‌ খেয়াল কর।' মায়ের সহজ সমাধান।
উড্ডু বলে, 'মা, তোমার ঐ খইলের থেকে পচা গন্ধ আসছে, বারান্দায় তো যাওয়াই যাচ্ছে না।'
''এমন বলিস না বাবা, যার যা খাবার। দেখেছিস এই গরমেও গোলাপ গাছে কেমন চারটে কুঁড়ি এসেছে?" মা বলেন।
উড্ডু আস্তে করে মায়ের বইটা টেনে নেয়, বলে ''মা, আমি এই বইটা একটু পড়বো?'
মা তখন আনন্দবাজার শেষ‌ করে ফেসবুকে ঢুকেছেন। স্ক্রল করতে করতে অন্যমনস্ক ভাবে বলেন, 'হুঁ‌ পড়।'
উড্ডু পড়া শুরু করে, 'স্বচ্ছসলিলা লুনী নদী….মা, স্বচ্ছসলিলা মানে কী?'
''স্বচ্ছ মানে স্বচ্ছ, মানে ট্রান্সপারেন্ট, 'স্বচ্ছসলিলা লুনী' মানে লুনী নদীর খুব পরিস্কার জলধারা বোঝানো হয়েছে এখানে।'' মা আনমনে উত্তর দেন।
''.....'স্বচ্ছসলিলা লুনী নদী বঙ্কিম গতিতে প্রখর প্রবাহে মাড়বারের বালুকা-কঙ্কর-বহুল বক্ষ ভেদ করিয়া কুলু ধ্বনিতে ধাবিত হইতেছে'…..উফ্ মা! দিস ইজ টু মাচ! এত কঠিন কঠিন বাংলা যে কেন লেখা হয়! একদম ঘ্যাত্তপ্রোত্ত ঘপাঘাত্। কোষ্ঠকাঠিন্য ও এর থেকে সোজা!'' উড্ডু মাত্র একটা বাক্য পড়ে বলে।
মা এবার মোবাইল রেখে বলেন, 'তা বই না পড়লে কঠিন তো লাগবেই। এজন্যই বলি পড়তে।'
'মা, এরকম বাংলা তো আমরা বলিনা, এত বাজে করে লেখা কেন? দেখো, এখানে লেখা আছে, অর্থোপাজ্জজ..কী সব..আর্থ্রোপোডা?'
''আর্থ্রোপোডা বায়োলজি তে আছে, সন্ধিপদী, এখানে লেখা আছে 'অর্থোপার্জ্জনের' অর্থাৎ অর্থ উপার্জনের।'' মা বলেন।
''ধুর আমি এমন বই পড়বনা। ভালো বাংলা লেখা পড়ব।'' উড্ডু বই ছেড়ে শুয়ে বলে।
মা বলেন, 'তাহলে কী শেক্সপিয়ারের প্লে গুলোও পড়বিনা? ওটাও তো অন্যরকম ইংলিশ এ লেখা। এই তো সেদিন বলছিলি,‌ কবে পড়ব অরিজিনাল প্লে!'
উড্ডু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর উঠে আসে বাইরের ঘরে। কী যেন খোঁজে! তারপর আবার গুটিগুটি পায়ে মায়ের পাশে এসে বসে।
"শুম্ভ, আর তাহার ভাই নিশুম্ভ, এই দুইটা অসুর দেবতাদিগকে বড়ই নাকাল করিয়াছিল। তাহারা তাঁহাদিগকে স্বর্গ হইতে তাড়াইয়া দিয়া আর অস্ত্র-শস্ত্র কাড়িয়া লইয়াই সন্তুষ্ট থাকে নাই, তাঁহাদের ব্যবসায় পর্যন্ত নিজেরা করিতে আরম্ভ করিল।" মা আড়চোখে দেখলেন উড্ডু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর 'পুরাণের গল্প' পড়ছে। কিছু বলেন না তিনি। কীই বা করবে একলা মেয়েটা! লকডাউনে এমনিতেই সবই বন্ধ হয়ে গেছে, কতদিন মেয়েটা বাড়ির বাইরে যায়নি, একটু দৌড়োদৌড়ি করেনি, গল্প করেনি বন্ধুদের সাথে! সারাক্ষণ ফ্ল্যাটবাড়ির দুটো ঘরে বন্দী! আহারে!
আর এদিকে উড্ডু তখন উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে, বুকের কাছে বই নিয়ে পৌঁছে গেছে দেবতা আর অসুরদের মাঝখানে, হুড়ুম দুড়ুম কান্ড একেবারে! ভাগ্যিস টিভিটা নেই! দুপুরবেলা মায়ের পাশে শুয়ে শুয়ে বই পড়ার মজাই আলাদা।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register