Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব - ২৪)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব - ২৪)

স্রোতের কথা

পর্ব - ২৪

[ রুকসানা ]

"রিজ...প্লিজ্ কান্না থামিয়ে কি হোলো একটু বলবি?? আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না..." সমীর রিজের পাশে বসে ওর হাতে হাত রেখে প্রশ্ন করলো...
   "সমীর...আমি পারলাম না সমীর...এতো চেষ্টা করেও পারলাম না...আমার রুকসানা কে প্রোটেক্ট করতে...."
    মিট্টি চোখ গোল করে আমার দিকে তাকিয়ে ভুরুটা উপর দিকে তুললো...আমিও কিছুই বুঝতে পারছিলাম না...রুকসানা আবার কে...
     আমার না করা প্রশ্নটাই প্রতিধ্বনিত হলো সুজীর গলায়...
"রিজ্ .... রুকসানা কে রে??"
  " রিজ প্লিজ তুই একটু জল খাতো"...
  " না".... নিজের গলাকে আমি নিজেই চিনতে পারলাম না...
   "এখন যেটা রিজের সবচেয়ে খাওয়া জরুরি ও সেটাই খাবে...."
       সবার অবাক,জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে আমি এগিয়ে গেলাম রিজের ঘরের বিশাল ফ্রীজটার দিকে
  ফ্রীজ টা প্রথমে খুললো না...ফ্রীজের পাশে বেরিয়ে থাকা মাইক্রোফোন টাতে নিজের নাম বলতেই নিঃশব্দে খুলে গেল...আর আমার যা দরকার... সেগুলো চোখের সামনেই থরে থরে সাজানো দেখলাম...
  ওগুলো থেকে তিন চারটে ঘন লাল লিকুইডে ভরা বোতল তুলে নিলাম... আমি নিজেই ভাবতে পারছিলাম না আমি এই কাজ টা করছি... কিন্তু আমার মনের ভিতরের মন টা আমাকে বলে দিচ্ছিল, এই মুহূর্তে এটাই আমাদের সবচেয়ে দরকার...
আমার বন্ধুদের বিস্ফারিত চোখের সামনে আমি একটা বোতল রিজের দিকে বাড়িয়ে ধরলাম....
     "এই নাও রিজ্.... জল মনে করে এটা খেয়ে নাও..."
    রিজ... লালচে...জলে ভেজা চোখ দুটো তুলে আমার দিকে তাকিয়ে কয়েক মূহুর্ত থেমে থাকলো...তারপর হাত বাড়িয়ে দিল...আর ঢাকনা খুলে বোতলে থাকা টলটলে তরল লাল পানীয়টা গলায় ঢাললো
   আমি অন্যদের দিকে তাকালাম..."আমি রক্ত খাচ্ছি....আর কেউ খাবি??" অবশ্য এই কথাটা বলার আগেই আমি ডাইকোর লুব্ধ দৃষ্টি দেখে নিয়েছিলাম...আর আমার অনুমান সঠিক করে সবার আগে হাত বাড়ালো ডাইকো...
     "তোদের মিথ্যে বলবো না ভাই... আমি অনেক ছোটবেলা থেকেই এর অপূর্ব স্বাদ পেয়ে আসছি.... আমার গ্যাগ্যা আমাকে... বলতে বলতেই একটা বোতল প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে ঢকঢক করে গলায় ঢালতে লাগলো ডাইকো...
   মিট্টি,সুজী, প্যাম আর সমীরের দ্বিধাগ্রস্ত মুখের দিকে একবার তাকিয়ে... একটু হেসে একটা বোতলের মুখ খুলে আমিও গলায় ঢাললাম... আর... এতক্ষনের উৎকণ্ঠা আর ক্লান্তি এক নিমেষে দূর হয়ে গেল.... অপূর্ব এক স্বাদে আমার স্বাদকুঁড়ি গুলো যেন আহ্লাদে হেসে উঠলো...
      প্রাথমিক আবেশ কাটিয়ে আমি দেখলাম সমীর কখন যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে একটা বোতলের দিকে....আর পরম তৃপ্তিতে চুমুক দিয়ে খেতে গিয়ে ওর মুখের দু'পাশ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে লাল ঘন তরল....
   "হ্যাঁ, রিজ্ এবার বল... রুকসানা কে?"
আমি আড়চোখে লক্ষ্য করলাম....মিট্টি কাঁপা কাঁপা হাতে একটা বোতল তুলে নিয়ে ভালো করে দেখছে...আর প্যাম আর সুজী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বোতল গুলোর দিকে...
     "রুকসানা আমার ন'বছর বয়সী ছোট বোন....."
    রিজ কে অনেকটা ধাতস্থ লাগছে এখন....
    "তোর ন'বছর বয়সের ছোট বোন??ওর ও কি স্পেশাল পাওয়ার আছে?? কিন্তু যতই পাওয়ার থাক...ষোলো বছরের আগে তো ইসপ্যামাতে এন্ট্রি বা আ্যাডমিশন কোনোটাই হয় না!!!"
     "না ডাইকো..ওর কোনো আ্যাডমিশন হয়নি...তাহলে তোমাদের সব খুলেই বলি"
   রিজের কথা শুনতে শুনতেই দেখলাম...মিট্টি বোতল খুলে গলায় ঢাললো...আর আরামে চোখ আর ঠোঁট কুঁচকে ফেললো....আর বোতল টা সুজীর দিকে বাড়িয়ে দিল...
    "আমার আব্বু দুবাইয়ের খুব গন্যমান্য নামকরা  একজন মানুষ ...যার দুটো অয়েল পিট... খেজুর বাগান...আরো প্রচুর সম্পত্তি ও অর্থ বিত্ত আছে...বলতে গেলে আমার আব্বুকে অনেকে সুলতান বলেই মানে ও ভক্তি করে...
    আমার আব্বুর দুটো বিয়ে...প্রথম স্ত্রী... আমার আম্মি.... খুবই বিত্তবান....অভিজাত পরিবারের মেয়ে...আর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিল আমার ছোটি আম্মি.... খুব সাধারণ পরিবারের... আমার আম্মি, ছোটি আম্মিকে একদম পছন্দ করতো না... কিন্তু ছোটি আম্মি আমাকে আর আমি ছোটি আম্মিকে ভীষণ ভালো বাসতাম...
         আমার যখন দশ বছর বয়স...তখন রুকসানার জন্ম দিতে গিয়ে ছোটি আম্মি মারা যায়... আমার আম্মি আর আব্বু রুকসানা কে ফস্টার হোমে দিয়ে দিতে চেয়েছিল..... আমি দিতে দিইনি...তোরা বিশ্বাস করবি না...দশ বছর বয়সেই আমি যেন ঐ একরত্তি প্রাণটার বাবা আর মা দুই ই হয়ে উঠেছিলাম.…... কিভাবে ওকে বড় করেছি রে.... কিন্তু সানা যতো বড় হোলো...আমরা জানতে পারলাম...ও অটিজম্ স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত...ওর শরীর বড় হতে লাগল... কিন্তু ব্রেইন....আব্বুকে হাজার বলেও ওর ব্রেইনের অপারেশনের জন্য আমি রাজি করাতে পারি নি....উল্টে আম্মি আব্বু ওকে আরো বেশি ঘৃণা করতে লাগলো...আর তত আমিও ওকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরলাম....সানাও ভাইয়া ছাড়া কিচ্ছু জানে না রে...." রিজ্ আবার ডুকরে কেঁদে উঠলো...
     "কিন্তু ও এখানে কি করে এলো?" সুজী বোতলে একটা বড়োসড়ো চুমুক দিয়ে আরামের নিঃশ্বাস ছেড়ে বোতল টা প্যামের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো....প্যাম প্রবল ভাবে মাথা নেড়ে একটু দূরে সরে গেল
    আমি যখন ইসপ্যামাতে সিলেক্টেড হলাম....সবাই খুব খুশি...আব্বু আম্মির তো গর্ব আর ধরে না.... কিন্তু আমার চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে গেছিলো.... আমি কি করে রুকসানা কে ছেড়ে থাকবো.…..ওকে কে দেখবে... কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না...ও তো নিজে নিজে  ঠিক করে কথা বলা,খাওয়া কিছুই করতে পারে না রে...." রিজ একটু থেমে আবার বোতলে চুমুক মারলো...
     "তাই আমি ওকে লুকিয়ে ইসপ্যামাতে নিয়ে এসেছি.... ভেবেছিলাম..এত বড় জায়গা... আমার এই এত বড় ঘর...ওকে ঠিক লুকিয়ে রাখতে পারবো..আর এ‌ছাড়া আমার তো আর কোনো উপায়ও নেই রে...ও নাহলে বাঁচবে না....ও ঠিকই ছিল... কিন্তু খেতে চাইছিল খুব... ফ্রিজের এই সব ওকে খাওয়াতে পারি নি...তাই ওকে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে..নিজেও একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম....তারপর ওকে ঐ অবস্থায় রেখে,সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে...অস্থির মন নিয়ে...ফাংশন আ্যাটেন্ড করতে গেছিলাম...ওর জন্য লুকিয়ে খাবার চুরিও করে এনেছি রে.... ওয়েলকাম সেরেমনির দিকে আমার মন ছিলনা একদম...কতক্ষনে ফিরে সানাকে একটু খাওয়াবো... কিন্তু ফিরে এসে দেখি... আমার ঘরের দরজা খোলা...সানা কোথাও নেই....ওঃ গডেস.... আমি এখন কি করি...ওকে কোথায় খুঁজবো এই নতুন জায়গায়...ও তো ঠিক করে কথাও বলতে পারে না... কিছু বোঝেও না..." রিজ আবার ডুকরে কেঁদে উঠলো...
  আমরা সবাই বাক্যহারা হয়ে তাকিয়ে রইলাম....এই তাহলে রিজের অস্থিরতার আসল কারণ!!!!
    "তুই খুব ভুল করেছিস রিজ্...এই‌ ইসপ্যামা কিন্তু সাঙ্ঘাতিক জায়গা...বাইরে থেকে এত সুন্দর মনে হলেও...ভেবে দেখ..এখানে কত জন ভ্যাম্পায়ার,নেকড়ে এবং ডাইনি আছে...কে যে মনে কতটা হিংস্রতা লুকিয়ে রেখেছে....সবাই যে পজিটিভ....তা কিন্তু নয়... সাবধানে না থাকলে এখানে পদে পদে বিপদ....আর ইসপ্যামার রুল না মানলে কেউ তোকে সাপোর্ট করবে না রিজ্... একমাত্র সুপার পাওয়ার যাদের আছে..তারাই এখানে নিরাপদ...."
    "কি করবো এখন ডাইকো??"
    আমি রিজের কাছে এগিয়ে গেলাম....
   "রিজ তোর জন্য আমাদের গর্ব হওয়া উচিত...তুই.... এত ভালো এত সুন্দর মনের একজন মানুষ..."
   "মানুষ না স্রোত...দানব....বল্....তুই এত ভালো একজন রাক্ষ....ইয়ে মানে দানব...মানে ডেমন‌ আর কি..."
   আমি মিট্টির দিকে ভর্ৎসনার চোখে তাকালাম....
    "কিন্তু এখন উপায় কি???" সুজী বোতলে আর এক চুমুক মেরে তাড়াতাড়ি ঢোঁক গিললো...
   "চল আমরা মিরান্ডা ম্যাম কে জানাই"
  "তুই খেপেছিস প্যাম...তাহলে রিজের রক্ষা থাকবে না"
    "কেউ কাউকে কিচ্ছু জানাবে না.... "আমি উঠে দাঁড়ালাম ..."এখনো রাত শেষ হতে কিছুটা বাকি আছে...."আমরা এর মধ্যে রুকসানাকে খুঁজে বার করবো..."
  আমি রিজের গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছিয়ে দিলাম....
"রিজ্ তোর তুলনা নেই....তুই এতদিন রুকসানা কে একা সামলেছিস...আজ থেকে রুকসানা আরো দাদা দিদি পেলো...আমরা সবাই একসাথে এবার থেকে ওর খেয়াল রাখবো...." বলতে বলতে আমি সবার দিকে ফিরে তাকালাম
     "স্রোত ঠিক বলেছে...আমরা সবাই মিলে ওকে খুঁজে বার করবো..." মিট্টি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো...
  প্যাম ,সুজী,সমীর ডাইকো সবাই একসাথে বলে উঠলো..."তুই কিচ্ছু ভাবিস না আমরা সবাই ওকে এক্ষুণি খুঁজে আনছি...."
     আমি অনুভব করলাম....আজ এই মুহূর্তে আমাদের মধ্যে যে আত্মিক বন্ধনটা গড়ে উঠলো....তার জন্য হয়তো চারজন গডেসই তাঁদের নিজের নিজের দুনিয়া (নাকি স্বর্গ??) থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে খুশীর হাসি হাসলেন.....

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register