Mon 17 November 2025
Cluster Coding Blog

গদ্য বোলো না -তে (রূপং দেহি, জয়ং দেহি) রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

maro news
গদ্য বোলো না -তে (রূপং দেহি, জয়ং দেহি) রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

মহালয়া না নস্টালজিয়া

আজ মহালয়া৷ আমরা বলি পিতৃপক্ষের সমাপ্তি দেবী পক্ষের প্রারম্ভ৷ জগৎজননী মা তাঁর সন্তানসন্ততিদের নিয়ে আসছেন পিত্রালয়ে, বিশ্বের মানুষের কল্যাণার্থে৷ প্রতিবছর শরৎকালে মা দুর্গা মর্ত্যে আসেন ভক্তদের কল্যাণ সাধন করে শত্রুর বিনাশ ও সৃষ্টিকে পালন করার উদ্দেশ্যে। এবারও যদিও পরিস্থিতি অত্যন্ত প্রতিকূল তথাপি তার আগমনী বার্তা পৌঁছে গেছে বাঙালির ঘরে ঘরে। দুর্গাপূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। আজ মহালয়া উদযাপনের মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। মণ্ডপে মণ্ডপে উচ্চারিত হবে মা দুর্গার আগমনী ধ্বনি। সারাদেশের মণ্ডপগুলোতে পূজা, মন্ত্র ও চণ্ডীপাঠ, মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে মা দুর্গাকে মর্ত্যে আসার আহ্বান জানানো হবে।
রেডিয়তে বেজে ওঠা বিরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে চন্ডীপাঠ এবং মহিষাসুরমর্দিনীর সুর জানান দেয় পূজা এসে গেল৷
তবে আদও দেবী দশভুজার মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার সাথে মহালয়ার তর্পণের কি কোন সম্পর্ক আছে ? আমি তার্কিক নই৷ নই কোন পন্ডিত ৷যারা জানেন তাঁদের আবার মহালয়ার শুরুর ইতিহাস নিয়ে রয়েছে দ্বিমত৷ তবে অনেকের মতে মহালয়া কথাটি এসেছে 'মহত্‍ আলয়' থেকে। হিন্দু ধর্মে মনে করা হয় যে পিতৃপুরুষেরা এই সময়ে পরলোক থেকে ইহলোকে আসেন জল ও পিণ্ডলাভের আশায়। প্রয়াত পিতৃপুরুষদের জল-পিণ্ড প্রদান করে তাঁদের 'তৃপ্ত' করা হয় বলেই মহালয়া একটি পূণ্য তিথি। তবে এই পূণ্য তিথির সঙ্গে "তর্পণ" -এর যোগাযোগ কীভাবে আছে তা নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে দ্বিমত আছে৷
এই সূত্রেই পণ্ডিত সতীনাথ পঞ্চতীর্থ বলেছেন, 'মহালয়ায় যে তর্পণ করা হয়, তা শুধুই পিতৃপুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দেব তর্পণ, ঋষি তর্পণ, দিব্য-পিতৃ তর্পণ করতে হয়। সঙ্গে থাকে রাম তর্পণ ও লক্ষ্মণ তর্পণ। সেখানে ত্রিভুবনে সমস্ত প্রয়াতকে জলদানের মাধ্যমে তৃপ্ত করার কথা বলা আছে। এমনকী তাঁদেরও উদ্দেশে তর্পণ করা হয়, জন্ম-জন্মান্তরে যাঁদের আত্মীয়-বন্ধু কেউ কোথাও নেই। এই ভাবে যদি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আত্মীয়-অনাত্মীয়, পরিচিত-অপরিচিত সকল প্রয়াতকে জলদান করে তাঁদের আত্মার তৃপ্তি সাধন করা হয়, তাহলে সেই দিনকে অশুভ বলে ভাবা হবে কেন?'
রামায়ণ অনুসারে ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র অসময়ে দেবী দূর্গার আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধার করার জন্য। শাস্ত্রমতে দুর্গাপুজো বসন্তকালে হওয়াই নিয়ম। শ্রীরামচন্দ্র অকালে দুর্গাপুজো করেছিলেন বলে একে অকাল বোধন বলা হয়। সনাতন ধর্মে কোনও শুভ কাজের আগে প্রয়াত পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। লঙ্কা বিজয়ের আগে এমনটাই করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। সেই থেকে মহালয়ায় তর্পণ অনুষ্ঠানের প্রথা প্রচলিত।
আবার মহাভারতে অন্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। মহাভারত অনুযায়ী, মৃত্যুর পর কর্ণের আত্মা পরলোকে গমন করলে তাঁকে খাদ্য হিসেবে স্বর্ণ ও রত্ন দেওয়া হয়। দেবরাজ ইন্দ্রকে কর্ণ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন যে দানবীর কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণ ও রত্ন দান করেছেন, কিন্তু প্রয়াত পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কখনও খাদ্য বা পানীয় দান করেননি। তাই স্বর্গে খাদ্য হিসেবে তাঁকে সোনাই দেওয়া হয়েছে। তখন কর্ণ জানান, যেহেতু নিজের পিতৃপুরুষ সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না, তাই ইচ্ছাকৃত ভাবেই পিতৃগণের উদ্দেশ্যে খাদ্য দান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।
মহালয়ার এই দিনটি দুর্গাপুজোর আরম্ভ বলেই আজকের বাঙালি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু হিন্দু ধর্মানুযায়ী, তার কোনও ভিত্তি আছে কিনা সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা আমার নেই । সম্ভবত ১৯৩২ সাল থেকে আকাশবাণীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ-বাণীকুমারের গীতি-আলেখ্যটি চালানোর ফলেই কি এমন ধারণার সূত্রপাত? মনে রাখা দরকার, আকাশবাণীর অনুষ্ঠানটির নাম কিন্তু ‘মহালয়া’ নয়— ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। আর তাছাড়া অনুষ্ঠানটি এখন মহালয়ার দিন সম্প্রচারিত হলেও শুরুতে তা সম্প্রচারিত হতো ষষ্ঠীর ভোরে।
তথাপি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, ধূপের গন্ধ, কাশ ফুল, সোনাগলা রোদ আর পূজো আসছে, এই নস্টালজিয়া কোনদিনও মেকী কিংবা মলিন হওয়ার নয়৷ ও! আর একটা কথা মহালয়া অশুভ না শুভ বিচারে যারা চুল চেরা বিশ্লেষণে মত্ত, তাদেরকে প্রশ্ন করি, যে তিথি আমাদের পূর্বপুরুষদের এবং সমস্ত প্রয়াতকে জলদানের মাধ্যমে তৃপ্ত করা হয়, সেই তিথি কি কখনও অশুভ হতে পারে!
শুভ মহালয়া
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register