Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ২২১)

maro news
দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ২২১)

পর্ব - ২২১

ক্লাস চলার মাঝখানে প্রিন্সিপাল ম‍্যাডাম পিওন পাঠিয়ে শ‍্যামলীকে ডাকলেন। ক্লাস ছেড়ে তাকে যেতে হল।
প্রিন্সিপাল ম‍্যাডামের সামনে গিয়ে শ‍্যামলী দাঁড়িয়ে র‌ইল। ম‍্যাডাম নিজের কাজ করে চলেছেন। খানিকটা সময় বাদে তিনি বললেন, কি হল, বোসো।
গতকালই তিনি শ‍্যামলীর একান্ত অনুরোধ রক্ষা করার প্রয়োজন বোধ করেন নি। হোস্টেলে আশ্রয় চেয়েছিল সে। ম‍্যাডাম চাপ দিয়েছিলেন বাবার একটা চিঠি লাগবে। শ‍্যামলী বলেছিল, আইনতঃ আমি সাবালক। আঠারো বছর বয়স পার করে ফেলায়, নিজের জীবনের ব‍্যাপারে সিদ্ধান্ত আমি এখন নিজেই নিতে পারি। প্রিন্সিপাল তা মানতে চাননি। শ‍্যামলী যে বাড়িতে কোনো গণ্ডগোল বাধিয়ে কলেজ হোস্টেলে ঢুকে পড়তে চাইছে না, এটা তিনি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। শ‍্যামলী প্রাইভেসির প্রশ্ন তুলেছিল। একটি কলেজ পড়ুয়া সাবালক মেয়ে তার বাড়ির লোকের সাথে সম্পর্ক বিন‍্যাসের খুঁটিনাটি কলেজ কর্তৃপক্ষকে বলতে বাধ‍্য নয়। সাবালকত্ব অর্জনের পর, যে কোনো ব‍্যক্তির‌ই প্রাইভেসি গড়ে ওঠে এবং সমাজের উচিত, তার সেই প্রাইভেট তথ‍্য জানাতে জোর না করা।
ধীরে ধীরে ম‍্যাডামের টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসল সে। প্রিন্সিপাল ম‍্যাডাম বললেন, কলেজের ভেতরকার খবর বাইরে চাউর করাটা ভাল?
শ‍্যামলী ভেবে পেল না, কলেজে বিজ্ঞান ও কলা বিভাগ মিলিয়ে সাতশোর উপর ছাত্রী পড়ে। যেখানে এতগুলি মানুষ নিয়মিত যাতায়াত করে, সেখানকার কোনো সাধারণ কথা সব সময়েই পাবলিক হয়ে আছে। কলেজ যে একটা পাবলিক প্লেস! আর সে একটা সাধারণ ছাত্রী। কোনো গোপন তথ‍্য জেনে ফেলার মতো অবস্থানে সে নেই।
শ‍্যামলী চুপ করে র‌ইল। ম‍্যাডাম বললেন, নাও, এই দরখাস্ত। হোস্টেলে সীট পাবার দরখাস্ত। এতে স‌ই করে উদ্ধার করো।
শ‍্যামলী ইতস্ততঃ করতে লাগল। হোস্টেলে থাকতে গেলে খাওয়া মাসে মাসে কিছু খরচ লাগে। আর ঢোকার সময়েও কিছু লাগে। এই টাকাটা এই মুহূর্তে তার কাছে নেই। গতকাল সে ভেবেছিল কোনোভাবে ওই টাকাক'টা যোগাড় করতে পারবে।  তারপর সব দরজাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গত পরশু দিন সে মহাজনের কাছে গিয়েছিল। নবতিপর মহাজন তাঁর বয়সজনিত অভিজ্ঞতায় শ‍্যামলীর সংকটাপন্ন অবস্থা আন্দাজ করলেও, তাঁকে মন খুলে সব কিছু বলা সম্ভব হয়নি। রাম নারায়ণ মিশ্রকে সে গাড়িভাড়ার টাকাটা যখন চুকিয়ে দিতে চেয়েছিল, তখন তাঁর গ্রহণের ভঙ্গি দেখে তার অদ্ভুত মনে হয়েছিল। মিশ্রর সাথে তার সম্পর্ক বিন‍্যাস যা দাঁড়িয়ে ছিল, তাতে টাকা দিতে যাওয়ার জন্য মিশ্রের অনুযোগ করার কথা। কিন্তু যেন শ‍্যামলীর আত্মসম্মানবোধকে সম্ভ্রম জানাবার দায়বদ্ধতা থেকে তিনি ওভাবে দুহাত পেতে টাকা নিয়েছিলেন। পরদিনই যে তিনি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চলেছেন, তা মিশ্র শ‍্যামলীকে টের পেতে দেন নি।
তারপর থানায় গিয়ে বিনোদ মেহতার প্রসঙ্গ উঠে ওসির সাথে সহজ হৃদ‍্যতায় একটু জটিলতা সৃষ্টি হল। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসলে সরকারের একটা মুখ। ওই চেয়ারে বসে সরকারি স্বার্থের বাইরে যাওয়া যায় না। একটা লোক যদি একটা চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় চেয়ারটাকে তুলতে চান, তা হলে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মে তিনি ব‍্যর্থ হতে বাধ‍্য। নিজের চাকুরিগত অবস্থানকে সংরক্ষণ করতে গেলে ওসির পক্ষে শ‍্যামলীর সাথে একমত হ‌ওয়া বাস্তবিক পক্ষে সম্ভব ছিল না।
প্রিন্সিপাল ম‍্যাডাম বললেন, কি হল, স‌ই কর্?
শ‍্যামলী বলল, ম‍্যাম, আমার কাছে এই মুহূর্তে এই পরিমাণ টাকাটা নেই।
প্রিন্সিপাল বললেন, আমি তোকে টাকা দিতে বলেছি? ওটা সরোজনলিনী ফাণ্ড থেকে হয়ে যাবে। বাব্বাঃ, যে রেফারেন্স নিয়ে এসেছ তুমি, যে লেভেল থেকে রেকমেণ্ডেশন এসেছে....
শ‍্যামলী খসখস করে স‌ই করে দিল।
আলো নিবিয়ে দিলে কোন একটা ফাঁক থেকে এক টুকরো চাঁদের আলো ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে । শ্যামলী ভাবলো একটা আলো নিবে গেলে কখনো অন্য একটা আলো জ্বলে ওঠে । জীবনটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে সে যেন জীবন খুঁজে চলছে। বেদনাদূতী গাহিছে ওরে প্রাণ, তোমার লাগি জাগেন ভগবান.... দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান।
প্রিন্সিপাল ম‍্যাডাম বললেন, তোর উচ্চ মাধ্যমিক পাশের ডকুমেন্ট কলেজে আছে। জেলায় মেয়েদের মধ‍্যে সেরা হয়েছিলি। মাধ‍্যমিকেরটাও তো ফার্স্ট ডিভিসন ছিল, না কি?
শ‍্যামলী বলল, ছিল।
প্রিন্সিপাল বললেন, এবারো যদি ফার্স্ট ক্লাশ ম‍্যানেজ করতে পারিস, তাহলে এম এস সি করলে পড়ার খরচটা পাবি। ক্লাস শেষ হলে হোস্টেলে নিজের সিটটা দেখে আসিস।
বুকের মধ্যে একটা আনন্দ আর উত্তেজনা নিয়ে ক্লাসে ফিরল শ‍্যামলী। নিশ্চয়ই এটা অনসূয়াদির কাণ্ড। সে অনুগৃহীত হয়ে তাঁর বাড়িতে থাকতে চায় নি। মধ‍্যে ম‍ধ‍্যে অবশ‍্য‌ই যাবে। কিন্তু দৈনন্দিনতা বড়োই ভয়াবহ। তা অনেক মালিন‍্য ঘুলিয়ে তোলে। হোস্টেলে থাকা ও খরচ জোটার বন্দোবস্ত হতে খুব স্বস্তি পেল শ‍্যামলী। সকালে মারিয়া মন্টেসরির কথা বলে গিয়েছেন শিক্ষক। শ‍্যামলী স্মৃতি সরণি হাতড়ে হাতড়ে মন্টেসরিকে খোঁজে। নেদারল্যান্ডসে প্রয়াত হয়েছেন এই ইতালিয়ান শিক্ষাবিজ্ঞানী। বছর বত্রিশ আগে, ঊনিশ শো বাহান্ন সালে। ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়ে টেকনিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছিলেন মন্টেসরি। সেইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামের সাথে মিকেল‍্যাঞ্জেলো, এবং লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। প্রযুক্তি বিষয়ক পড়াশুনায় স্নাতক হলেন। তখন বয়স কুড়ি। তেমন সময় ডাক্তারি পড়তে ইচ্ছে হল তাঁর। বাবা বিরক্ত হলেন। মেয়েটার কি মনের ঠিক নেই না কি? একবার ইঞ্জিনিয়ারিং আবার ডাক্তারি, ইয়ার্কি পেয়েছে না কি? বাবার সাথে একটু মন কষাকষি হয়েছিল মন্টেসরির। প্রযুক্তিবিদ‍্যার স্নাতকের পক্ষে ডাক্তারি পড়ার সুযোগটা আদৌ সহজ নয়। প্রবল চেষ্টায় একটা পথ বের করলেন তিনি। অ্যানাটমি ফিজিওলজি অর্গানিক কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ে ১৮৯২তে ন‍্যাচারাল সায়েন্সে একটা ডিপ্লোমা বাগালেন। তারপর মেডিসিন নিয়ে রোম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু। ১৮৯৬তে মেডিসিনে সাম্মানিক স্নাতক। ১৮৯৮তে পুরোদস্তুর চিকিৎসক হিসেবে ইউনিভার্সিটি হসপিটালে সহায়ক পদে যোগ দেন। আর প্রাইভেট প্র‍্যাকটিশ চলতে থাকে।
ব‍্যক্তিগত জীবনে কম ঝড়ঝাপটার মুখে পড়েন নি মন্টেসরি। মেয়ে বলেই নানা টিটকারি, কটূক্তি শুনতে হয়েছে তাকে। তারপর সতীর্থ এক চিকিৎসকের সঙ্গে হৃদ‍্যতা। আর ঘনিষ্ঠতা। আর ক্রমে শারীরিক সম্পর্ক। নিয়মমাফিক বিয়ে করার উপায় ছিল না। কেননা, বিয়ে করে ফেললে মেয়েদের পক্ষে চিকিৎসক হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবার অনুমতি মিলত না।  অথচ তখন কাজ ছেড়ে ঘরোয়া জীবনে ফিরে যাবার প্রশ্ন নেই। দুই সহপাঠী মিলে স্থির করলেন, প্রথাগতভাবে বিয়ে না করলেও, তৃতীয় কাউকে যৌনসঙ্গী হিসেবে নেবেন না তাঁরা। এর‌ই মধ‍্যে মা হলেন মন্টেসরি। লৌকিক অর্থে কুমারী মা হলেন তিনি। তিন চার সপ্তাহের মধ্যেই মাতৃত্বকালীন ছুটি সংক্ষিপ্ত করে সন্তানকে গ্রামে তাঁর আপনজনের কাছে গচ্ছিত রেখে মন্টেসরি আবার ঝাঁপালেন চিকিৎসার কাজে। ইতিমধ্যে পুরুষটি বাড়িতে চাপের মুখে পড়ে অন‍্যত্র‌ বিবাহ করলেন। বুক ভেঙে গেলেও মন ভাঙতে দেননি মন্টেসরি। একাই বড় করে তুললেন সন্তানকে। মন্টেসরির সাথী ছিল গণিত। গণিত তাঁকে ধীর স্থিরভাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়ে গেছে।
নেদারল্যান্ডস বারে বারে সকাল থেকেই ঘুরে ফিরে আসছে। আনা ফ্রাঙ্ক নেদারল্যান্ডসের মেয়ে। মন্টেসরি চোখ বুজলেন নেদারল্যান্ডসে। প্রবাল সেনের চিঠির জন‍্য মন উসখুস করছে। লাল রেশমি রুমালে লুকোনো আমস্টারডামের গল্প। ভিনসেন্ট ভ‍্যান গঘ আর বারুখ স্পিনোজা। নেদারল্যান্ডস। শ‍্যামলী যেন ডাকঘরের অমলের মতো করে আমস্টারডাম শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ায়। মন্টেসরি বলছেন, নেভার হেল্প এ চাইল্ড উইথ এ টাস্ক অ্যাট হুইচ হি ফিলস হি ক‍্যান সাকসীড। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, দুঃখখানি দিলে মোর তপ্তভালে থুয়ে, অশ্রুজলে তারে ধুয়ে ধুয়ে..  জীবনের পরম লগ্নে বলেন, অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে, সে পায় তোমার হাতে অক্ষয় শান্তির অধিকার।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register