Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

এক মাসের গপ্পে ঈশা দেব পাল (পর্ব - ৫)

maro news
এক মাসের গপ্পে ঈশা দেব পাল (পর্ব - ৫)

বিভাস বসুর বউ - ৫

আমরা এরকম ই হাবিজাবি নানা গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি। আমরা তিন বছর আগে ও ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে, আমাদের বিয়ে নিয়ে যেসব হাসি আনন্দ ঠাট্টা মেশানো গল্প করতাম, আজকাল আর সেটা করিনা। সময় এগোচ্ছে, আমাদের নারীত্বের বয়স বাড়ছে। আমরা চেনা পৃথিবীর বাইরের জগত কে দেখতে শিখছি। পরের দিন বেশ হই হই করে রিমিদের বাড়ি গেলাম। রবিবার ছিল। দুপুরে খাওয়া সেরেই চলে গেছিলাম। সারাদুপুর কফি, পকোড়া, চপ সব চলতে লাগল। রিমির বর অনিলদা খুব জমাটি। ওদের দুই ছেলে মেয়ে ও বেশ দুষ্টু। রিমির মা ওদের সঙ্গে থাকেন। এই পরিবার টা আমার খুব পছন্দের। কিন্তু ফরেস্টের ধারে , যেখানে হাতি টা ছিল সেখানে গিয়ে জানা গেল, হাতিটা জঙ্গলে ঢুকে গেছে। ওর সঙ্গী হাতি টি নাকি জলদাপাড়ার ই অন্য দিকে এগিয়ে জখম হয়ে পড়ে ছিল। তাকে সারিয়ে নিয়ে আসার পর দুটোতে মিলে জঙ্গলে ঢুকে গেছে । মন টা ভালো ও হয়ে গেল, খারাপ ও। দেখা হল না অমন প্রেমিকা জীব টিকে, যে অপেক্ষায় বসে কষ্ট পাচ্ছিল এই কদিন। মনে হল, পশুদের জীবনে প্রেম কি অবভিয়াস। কোনও দ্বিধা নেই মাঝে। আকাশ আর পৃথিবীর মধ্যেকার কোনও জলাভূমি ওদের মধ্যে বাস করেনা। আমরা ফরেস্টে এমনি বেরিয়ে এলাম। বিকেল বেলার অরণ্যের মধ্যে কী যে জাদু। অনেকক্ষ্ণ জঙ্গল এর ঘ্রাণ নিলাম। রিমির বাচ্ছাদের সঙ্গে রোজি দৌড়াদৌড়ি করে খেলল। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে চা খেলাম, ওদের ছবি তুললাম। আর সন্ধ্যের মুখে মুখে ফিরতি পথে পা বাড়ালাম। হেঁটে নয়, একটা ভ্যান পেয়ে সবাই উঠে পড়লাম। চোখের সামনে থেকে যখন জঙ্গল টা মিলিয়ে যাচ্ছিল তখন ঐ ফিরে যাওয়া হাতির জুটি টার জন্য অনেক ভালবাসা রেখে এলাম মনে মনে। একটা সত্যিকারের ভালবাসার গল্প আসলে অনেককে সত্যিকারের খুশি করে দিতে পারে, তা যত অল্প সময়ের জন্যই হোক না কেন। প্রায় অন্ধকার এ ফিরলাম। ওরা নামল ওদের বাড়ি। অনিলদা এগিয়ে দিয়ে গেল আমাদের। আর তখন ই একথা ওকথার মধ্যে শুনলাম বিভাস বসুর নাকি খোঁজ পাওয়া গেছে। উনি নাকি ভারত সেবাশ্রমের সঙ্গে হিমালয়ের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গরীব দের সেবা করছিলেন এতকাল। শিলিগুড়ির আশ্রমে ফিরেছেন কিছুদিন আগে। স্কুলের ই এক অন্য মাস্টারমশাই এর সঙ্গে কাল বিকেলে হঠাত দেখাও হয়েছে। কিন্তু আর বাড়ি ফিরতে চান না। চাকরিতেও নাকি অফিসিয়াল রেজিগনেশন পাঠিয়ে দেবেন। টাকাপয়সা বাড়ি সব বউ এর জন্যই রইল। এদিকে তার বৌ নাকি সে কথা শুনে কাল রাত থেকে কেঁদে চলেছে। অনিলদা বাড়ির সামনে আমাদের নাবিয়ে দিয়ে চলে গেলে হঠাত মনে হয় অন্ধকারে নদীটার আওয়াজ ও কেমন কান্নার মত। এই কান্নায় কোনো আক্রোশ নেই, কোনো তীব্রতা নেই। এ যেন হেরে যাবার কান্না একলা নারীর। আমি মন্থর পায়ে এগোই। রোজি ই দরজার চাবি খোলে। উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে মাস্টারমশাইএর মেয়ের গলা সাধার আওয়াজ পাই। মেয়েটার গলায় সুর আছে। কিন্তু কান্নার প্রবাহের কাছে সেই সুর কেমন হারিয়ে যাচ্ছে। কিচ্ছু শুনতে পাইনা আমি। রোজির পিছন পিছন অন্যের গৃহে প্রবেশ করার মত দ্বিধান্বিত হয়ে নিজের বাসায় ঢুকি।
আজ নদীটা এখনো অশান্ত। বাড়ি ফিরে আমি ও কাঁদছি। রোজি একটু ঘাবড়ে গেছিল প্রথমে। তারপর কিছু না বলে অন্য ঘরে গিয়ে বই পড়ছে। ও বোঝে, আমার নিজের সঙ্গে কখন একা থাকার দরকার। আমি আসলে আটকাতে পারছিলামনা কান্নাটাকে। কাল রোজি ফিরে যাবে। আমি আবার একলা হয়ে যাব ভীষণ। আর আমার এই একাকীত্ব টা একদম আমার একার হয়ে থাকবে। কোনো চটকদার সিনেমার মত বা বিয়েতে উপহার দেওয়া গল্পের মত আমার জীবন কাহিনি ও একটা সুতোতে এসে মিলবেনা। রাজীব বা সুপ্রভ কেউ ই ফিরে আসবেনা জীবনে বা বিভাস বসুর মত আমাদের এই ছাড়াছাড়িতে কোনো হিমালয়ের স্পর্শ আসবেনা। জনসেবার মহত্ত্বের ছোঁয়ায় আমার প্রেম আমাকে সত্যিকারের কাঁদাবেনা। এ নেহাত ই প্রবঞ্চনা র গল্প হয়ে থাকবে, যে বঞ্চনায় কারোর ই হাত নেই। আমি চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করি আর আয়না দেখি। আর চমকে উঠি। এতদিন যে চাহনি টা কে আমি ভয় পেতাম, যা দেখে আমি চোরের মত পালিয়ে আসতাম, আমার আয়না একদম সেরকম তাকাচ্ছে। ভ্যাবাচাকা, বোকা হয়ে যাওয়ার আড়ালে একটা ক্ষীণ প্রত্যাশা যা কোনওদিন মিটবে না জেনেও ব্যর্থ বায়নার মত চোখের মণিতে বসে বদলে দিচ্ছে আমাকে। সুপ্রভ র যে বাগদত্তা প্রেমিকা কে ছোট থেকে কথা দেওয়া আছে তার কাছে ফিরতেই হবে তাকে। ও প্রাণপণ চেষ্টা করছে কলকাতার কলেজে চলে যাওয়ার ও। আমি পড়ে থাকব আমার বিভ্রান্ত জীবন নিয়ে একলা এই অরণ্যে। আমি নিজের ভবিষ্যত দেখতে পাই আমার ই দিকে তাকিয়ে। আমাকেও দেখতে একদম বিভাস বসুর বউ এর মত ই লাগছে। যে দেখাটায় রূপ বা শিক্ষার কোনও ছাপ নেই। মুখে সেই ধূসর রং। পৃথিবী আর আকাশের মাঝখানের মত একটুকরো ফ্যালফেলে বোকা হয়ে যাওয়া জমি গড়ে উঠেছে আমার চোখেও, যা শুধু সেসব মেয়েদের চোখেই দেখা যায়, যারা ব্রাত্য হয়ে গেছে কখন যেন । বুঝতে পারি এই হেরে যাওয়া চাহনি শুধু একটা মেয়েই চিনতে পারে অন্য মেয়ের চোখে।

সমাপ্ত

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register