Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

'কফি পাহাড়ের রাজা' সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব - ৩ ।। খন্ড - ৮)

maro news
'কফি পাহাড়ের রাজা' সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব - ৩ ।। খন্ড - ৮)

কফি পাহাড়ের রাজা

তৃতীয় পর্ব:

৮)
বিদ্যার সঙ্গে ওই মাড়োয়ারি কোম্পানির চুক্তি হয়ে গেল একদিন। কুগান আর বিদ্যা চুক্তি সই করল। বিদ্যা খুব খুশি আজ। বেশ নিশ্চিন্ত হল যেন। একটু একটু করে একেকটা জট খুলে যাবে এরপর থেকে। ভবিষতের সুখ স্বপ্ন দেখতে দেখতে আজ খুব ফুরফুরে লাগছিল অনেকদিন পরে। মুরুগান যাওয়ার পর থেকে সবসময়ে একটা চাপ ধরে থাকত বুকের ভেতরে। একে তো ওই লোন নেওয়ার চাপ, নতুন ভাবে চাষবাস শুরু করা…তারপর মুরুগানের দুম করে উধাও হয়ে যাওয়া…একটার পর একটা ধাক্কায় বিদ্যা নিঃশ্বাস ফেলতে পারেনি এতদিন ঠিক করে। আজ তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরল ও। স্নান করতে করতে গলা খুলে গান ধরল ও। কুগান কেন, বাড়ির চাকরবাকররা সবাই শুনে বুঝল আজ দিদিমণির মেজাজমর্জি খুব ভাল রয়েছে। কিন্তু কারণটা কী, একমাত্র কুগানই জানে। যদিও কুগান ঠিক ততটা আনন্দিত হতে পারছে না। বিদ্যাকে অন্ধের মতো সাপোর্ট করা তার স্বভাব হয়ে গেছে আজকাল। কিন্তু এই ব্যাপারে মুরুগানের যুক্তিটাকেও ও খারিজ করতে পারছে না। আজ ফোনেও মুরুগানকে সে এখানকার সবটা শুনিয়েছে। শুনিয়েছে বিদ্যার খোশ মেজাজের কথাও। শুনে মুরুগান উত্তর দিয়েছিল—যেভাবে ও খুশি থাকে, সেভাবেই থাকুক। তুই ওকে বারণ করিস না। নিরুৎসাহও করিস না। যা পারে করুক ও। ভালো থাকিস তোরা।
আজকাল মুরুগানের এক নতুন নেশা হয়েছে। এই এক কামরার ফ্ল্যাটে একটা ডবল জানলার সামনে একটা লেখার টেবিল, চেয়ার রাখা আছে। ঘরের আরেকদিকে একটা সিঙ্গল খাট, ওয়াড্রোব, ব্যাস্‌। সামনের ড্রইং-ডাইনিং রুমে একটা দুটো চেয়ার আর কয়েকটা বেতের মোড়া ছড়ানো রয়েছে। ছোট একটা টিটেবিলও আছে ওখানে। ওখানেই প্লেট রেখে খেয়ে নেয় মুরুগান। সকালে কফি নিয়ে ঘরে লেখার টেবিলের সামনে বসে মুরুগান। সূর্য আলো ঢেলে দেয় ওখানে তখন। সেই নরম রোদে বসে একদিন সামনে রাখা লেখার কাগজে আঁকিবুঁকি কাটছিল মুরুগান। সেই থেকেই এই নেশার উৎপাত। আজকাল মুরুগান পুরনো অভ্যেসটাও ছেড়ে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যায় আর সকাল সকাল উঠে পড়ে। সব পুরনোকে সে রেখে এসেছে ওই কফি বাগানে। তারপর আঁকতে আঁকতে একসময়ে নেশা ধরে গেছে ওর। রঙ, তুলি কিনে এনেছে। তার প্রিয় প্যাস্টেলও এনেছে। বেশিরভাগ ছবিই যদিও কফি বাগানের আর পাহাড়ের। একদিন হঠাতই শুভলক্ষ্মীর মুখটা মনে এলো ঘুমের ঘোরে। ঘুম থেকে উঠেই আঁকতে বসল ও। যদিও আঁকার পরে দেখা গেল, অন্য একটি মেয়ের ছবি ফুটে উঠেছে সেখানে। না, বিদ্যাও নয়। মুরুগান ভাবতে বসল। কে এই নারী? চেনা লাগছে খুব, অথচ মনে পড়ছে না। ভাবতে ভাবতে সে রাতে ঘুমই এলো না মুরুগানের। ভোরের দিকে চোখ বুজে এলো। তখন ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমে ও স্বপ্ন দেখল—তার আঁকা ওই নারী তাকে দেখে হাসছে। হাত বাড়িয়ে ডাকল ওকে। স্কুলের ব্যাগ ধরিয়ে দিল ওর হাতে। তড়াক করে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠল ও। মা! এতদিন বাদে অবচেতন থেকে মায়ের মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠে এলো ওর আঁকার খাতায়।
   বিদ্যা আজ ভাবছে, মুরুগান নেই বলে দুঃখের বদলে স্বস্তি কি পাচ্ছে না ও? মুরুগান থাকলে সবসময়ে তটস্থ হয়ে থাকা, এই বুঝি রেগে গেল এই বুঝি কোথায় চলে গেল, এই বুঝি মাতাল হয়ে কী না কী কাণ্ড ঘটালো……আবার কথায় কথায় অভিমান করে গাল ফুলিয়ে বসে রইল… সে কী খেল, কী না খেল, ঘুমলো কিনা…সারাদিন ওই লোকটার জন্য বিদ্যাকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকতে হত। উল্টে পান থেকে চুন খসলে গাল শুনতে হত। ভালমুখে ওই লোক কটা কথা বলেছে তার সঙ্গে আজ অবধি? অবশ্য, বিদ্যা ততটাও বোধবুদ্ধিহীন বা অনুভূতিহীন নয় যে, ওই লোকের নির্ভরতা বুঝবে না। এমনও নয় যে, তাদের দুজনের কোন বোঝাবুঝি ছিল না পরস্পরের প্রতি। ছিল তো কিছু নিশ্চই…কিন্তু না থাকাও ছিল অনেকটা। বিদ্যার প্রতি মুরুগান কতখানি যত্ন দেখিয়েছে আজ পর্যন্ত? হয়ত কখনও সখনও খেয়াল করেছে। আর তাতেই বিদ্যা বর্তে গিয়েছিল এতদিন। সে তো কাজের লোক হয়েই রয়েছিল আদপে। শরীরের প্রয়োজন ফুরিয়েছে অনেকদিনই। বাগানের ওপর থেকেও তার মন চলে গেছে বলে এখন তাই বিদ্যাকে ছেড়ে যেতে বিন্দুমাত্র ভাবেনি মুরুগান। সত্যিই যদি ভালবাসত ওকে, এভাবে ছেড়ে চলে যেতে পারত? নাহয় শরীর নেই, নাহয় কফিবাগান রইল না, কিন্তু আর কিছু কি থাকে না এতদিনের সম্পর্কে? হয়ত বিদ্যা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যবসার ক্ষেত্রে, যদিও সেটা এখনও প্রমাণিত হয়নি, তাই বলে এই সামান্য কারণে তাকে ছেড়ে যেতে পারল লোকটা! নিজের ইচ্ছেমতো যেমন খুশি চলে গেল একজন…অন্যের কথা ভাবলও না একবার…যাক্‌ ভালই হয়েছে। দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল। এই শুন্যতাই তাকে পূর্ণ করবে একদিন, বিদ্যা জানে। সেই বা কেন—যে স্বেচ্ছায় ছেড়ে গেছে তার জন্য ভাবতে বসবে? এই বেশ ভাল আছে বিদ্যা। ঝুটঝামেলাহীন একলা। আর জীবন তো কেটেই গেল একরকম। সারাজীবনই তো লড়াই করে বেঁচে রইল সে। আর কটা দিনই বা…কেটে যাবে একরকম।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register