Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

এক মাসের গপ্পে ঈশা দেব পাল (পর্ব - ২)

maro news
এক মাসের গপ্পে ঈশা দেব পাল (পর্ব - ২)

বিভাস বসুর বউ - ২

এই বাড়ির পিছনদিকটায়, নদীর ওইপারে ঘন জঙ্গল। এই জঙ্গল ই আরো ঘন হয়ে গিয়ে মিশেছে জলদাপাড়ায়। একটা সরু নদী ঝিরঝির করে বয়ে যায়। মাঝরাতে সেই নদীর শব্দ শুনে আমার কবে মারা যাওয়া মায়ের কথা মনে করে চোখে জল চলে আসে। বেশ ঘন করে সন্ধ্যে নেমেছে। এই শীতে কনকনে সন্ধ্যে সাড়ে ছটা কেই গভীর রাত বলে ভ্রম হয়। আমি চুপ করে বিছানায় এসে শুই। টেবিল ল্যাম্প ছাড়া অন্য কোনো আলো আমার ভাল লাগছেনা। চামেলি বলে একটা আধা নেপালী মেয়ে দুবেলা এসে কাজ করে। ও ঘর দোর বিকেলের ঝাঁট দিয়ে রুটি বানিয়ে দিচ্ছে। রোজি চিকেন ম্যারিনেট করে রেখেছে সকালেই। রাতে নিজে রাঁধবে। ও মাঝে মাঝে আমার সংসারে এসে হাত পাকায়। আমার এসব কিছুই ভাল লাগছেনা। আমি চুপ করে শুয়ে আছি। পিছনে যে নদীটা বয়ে যাচ্ছে, তার নাম দোলন। আমি দোলন নদীর শব্দ শুনছি। এরকম নির্জন সন্ধ্যে সম্পর্কে আগে আমার কোনো ধারণাই ছিলনা। কলকাতায় একদম ঝলমলে দিনশেষ দেখতে আমি অভ্যস্ত। মানিকতলা য় আমার ছোটবেলা কেটেছে। পরে বাবা ফ্ল্যাট কিনল টালিগঞ্জ -কুঁদ্ঘাটে। সর্বত্র ই আলোর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সন্ধ্যে দেখেছি। এখানে এসে এই প্রথমবার এরকম সন্ধ্যে দেখলাম, তাও যদি সুপ্রভ আমাকে না দেখাত। আমার কলিগ, আমার থেকে বয়সে বছর তিনেকের ছোট ও। সুপ্রভ কবিতা লেখে, গান লেখে, গান গায়। ওর সঙ্গে বন্ধুত্বে আমি একটা অন্যদেশ, অন্য পৃথিবীকে চিনতে শিখেছি ,যা আগে জানতাম ই না। আমাকে ও ই তো বোঝাল এরকম নিঃশব্দ শিশিরের মত নেমে আসা সন্ধ্যে আর জীবনানন্দ র মানে। চামেলি চলে যেতে রোজি আমার কাছে এসে বসে। একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ও যে এমন উন্মত্ততা তৈরি করে কে জানত ! প্রথম বছর টা মনখারাপে কেটে যাওয়ার পর আমি এখন এরকম নির্জন সন্ধ্যে, একাকী দুপুর, বিষন্ন বিকেলের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলেছি সুপ্রভ র হাত ধরে বই পড়ে, গান শুনে। জায়গাটা জলপাইগুড়ির কাছে। জলদাপাড়া ফরেস্টের পিছনদিকটা এটা। কুঞ্জনগর নামক একটা ছোট্ট টুরিস্ট স্পট। সময়ে সময়ে লোকজন আসে। তাও খুব কম লোক। এখনো জায়গাটা পরিচিত হয়নি। আমার কলেজ টা একটু শহরের দিকে। রিক্স করে কুড়ি মিনিট। চল্লিশ টাকা নেয় একেকবার যেতে। তাও আমি রোজ আশি টাকা খরচ করে রিক্স করেই যাই আর আসি। প্রতিবারই রিক্সয় উঠে আমার একটা অনন্ত জার্নির কথা মনে হয়। মনে হয়, কোন অচেনা পথে আমি যাচ্ছি আর যাচ্ছি। বাড়ি-ঘর ছেড়ে, নিজের জন্য কিচ্ছু না রেখে আমি চলছি। তবে বলতে বাধা নেই, এরকম শান্ত জায়গা যে এই পৃথিবীতে আছে, কলকাতা ছাড়ার আগে সেই ব্যাপারে কোনো ধারণাই ছিলনা। এখন এই শান্ত জায়গাটাই আমার মনে অদ্ভুত প্রলেপের কাজ করে। প্রথমবার যখন বিভাস বসুর বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম, তখন ও এত অনুভব হইয়নি। ওনার বাড়িটা শহরের মাঝখানেই ছিল। কিন্তু উনি বাড়ি ছাড়ার পর ওনার বউ এর প্রতি তীব্র অপছন্দ থেকেই নতুন বাড়ি খুঁজতে লাগলাম। কলেজের কাছেই পেলাম কয়েকটা , কিন্তু সুপ্রভ আর আমার দুজনের ই এই নির্জনবাস পছন্দ হল। এই বাড়িটা বাংলো ধরণের। একতলা। কিন্তু পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট এর মত। ওইদিকে একজন স্কুলের স্যার তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে কে নিয়ে থাকেন। এইদিকে আমি একা। দুজনের গেট দুমুখো। কেউ ইচ্ছে না করলে কারোর খোঁজ নেবেনা। পাড়াটা ও খুব ছোট্ট। ছাড়া ছাড়া। কিন্তু ভীষণ নিরাপদ। কয়েকটা নেপালী পরিবার থাকে। তাদের মেয়েরা রাত অব্দি ই ঘোরে , কাজ করে। সুপ্রভ ও কলকাতার ছেলে, কাছেই থাকে। আশ্চর্যভাবে ও এই জায়গাটা কে একটা ট্যুরিস্টের চোখ দিয়ে দেখে তাই ও ও ভালবাসে। আমার এই নির্জন ঘরে মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে মিলিত হবার সময় ও আমি ওর চোখে পাহাড়ের হাতছানি, ঝর্ণার ডাক শোনার রোমাঞ্চ দেখি আজকাল। তাই সেই মিলনের আনন্দ আজকাল আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখেনা, বরং ক্রমশ ভীত করে রাখে , ট্যুরিস্টের যেকোনোদিন বাড়ি ফিরে যাবার সম্ভাবনায়।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register