Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

মেঘ প্রবন্ধে সুষ্মিতা রায়চৌধুরী (নিউ জার্সি, আমেরিকা)

maro news
মেঘ প্রবন্ধে সুষ্মিতা রায়চৌধুরী (নিউ জার্সি, আমেরিকা)

দাদাগিরির সৌরভে 

শতকাল গেল বাঙালি আকালে
প্রেম মানে “এক্স” জেনে,
বুক ফেটে গেল দাদার আশায় 
নিতে হল সেটা মেনে।
ফেটে চৌচির এ বুক আমার
ক্রিকেট-মক্কা যেনো মরুভূমি ;
বাঙালিয়ানার আবেগের বুকে
দুরারোগ্য দাদা-প্রেম তুমি ।
হ্যা হ্যা এরকম চার পাঁচটা লাইন কোনওরকমে মিলিয়ে বসিয়ে দিলেও “হম বাঙালি লোগো কো” অসুবিধা হবেনা এটা বুঝতে কার কথা বিশেষ ভাবে বলা হচ্ছে এখানে। বাঙালির তিন রকম দাদা। এক, বাবাইদা। দুই, পাড়ার মস্তানদা। তিন, সৌরভ গাঙ্গুলি।
বাঙালি মেয়েদের পাড়ার বাবাইদার কাছে অঙ্ক করতে যাওয়া আর বাবাইদার বাইকে করে অটোস্ট্যান্ড অব্দি ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধে, ভয় পাওয়ার অছিলায় ভালো সেজে বলা, “কি যে বলো তুমি বাবাইদা, মা জানলে রক্ষে নেই” - এই প্রেম চিরন্তন। অতএব হঠাৎ যদি এমন একজনের এই ফিল্মি চিত্রপটে আবির্ভাব হয়, যে দাদা শুধু হ্যন্ডসাম নয়, দাপুটে, বুদ্ধিমান, স্মার্ট, রসবোধসম্পন্ন, প্রবল ব্যক্তিত্যের অধিকারী এবং সর্বোপরি “লড়কে লেঙ্গে” মনোভাব পোষণ করা বাঙালি, তাকে নিয়ে যে আপামর নারীসম্প্রদায় চোখ খুলে রেখে দিবাস্বপ্ন দেখবে, এতে সংশয়মাত্র নেই।
এই মানুষটিকে কিন্তু পাড়ার মস্তানদাদাও সমীহ করে। ক্লাব ঘরে সারা দেওয়ালে ঝুল হলেও বড়ো পোস্টারটা একেবারে চকচকে। “দাদাগিরি” যার হাত ধরে বাঙালি শিখলো সে কি যে-সে লোক হতে পারে? বেহালা চৌরাস্তার “প্লেয়ার্স কর্নার” পাশের পাড়া হওয়ায়, মার্কিনমুলুকে বসে আমার কলমেরই কেমন “গব্ব” হচ্ছে এখন।
কিন্তু কারণটা কি? শচীন তেন্ডুলকরের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়েও, সৌরভ গাঙ্গুলির জন্মদিনে একটু তলিয়ে দেখলাম ব্যপারটা। শুধুই কি ক্রিকেট? নাকি প্রেম=এক্সকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বাঙালির এক্স ফ্যক্টরটাকে চাগাড় দেওয়া? বুঝলাম দুইয়ের সমন্বয়ে যার চরিত্রায়ন তিনি এই, “জার্সি ৯৯”। যখন ইংল্যান্ডের সম্ভ্রান্ত, অভিজাত লর্ডস স্টেডিয়ামে পা রাখতেই, ধোপদুরস্ত ইংরেজ গাইড আমাদের জন্মস্থান কলকাতা জানতেই একগাল হেসে বলেছিলো, “ওয়াও ফ্রম গেঙ্গুলিস প্লেস”, তখন বাস্তবে প্রথমবার অনুভব করেছিলাম “দাদাগিরি”। বিশ্বাস করুন পাশে আরও দুটি ভারতীয় ছিলেন কিন্তু সেইদিন সেইমুহূর্তে পুরো স্টেডিয়াম-ট্যুরে আমরা বেশ মধ্যমণি। শচীনের জন্য তাদের সম্মান, তাদের সমীহ আকাশছোঁয়া কিন্তু গাঙ্গুলি নিয়ে তাদের উৎসাহ তুঙ্গে। স্বচক্ষে দেখলাম ২০০২-এর সেই বিতর্কিত শিহরণ জাগানো নীল জার্সি। সাদা দরজা খুলে দেওয়া হলো ড্রেসিংরুমের। এখান থেকে বেরোলেই একটা সিঁড়ি নেমে গেছে মাঠে। আর ড্রেসিংরুমে ঢোকার ওপরপ্রান্তে আরেকটি বিরাট দরজা। সেটি খোলার সময় আমাদের ডেকে নেওয়া হয়েছিলো সামনে। সামনে সেই ঐতিহাসিক সাদা ব্যলকনি। ছুঁয়ে দেখলাম দুধসাদা রেলিং, থাম। সবার দেখার পর একটু সময় চেয়ে নিয়েছিলাম আমরা। সামনে সবুজ ক্রিকেটের মক্কা, লর্ডসের মাঠ। চারদিকে কমেন্ট্রিবক্স, বিগ স্ক্রিন, ভি.আই.পি সিট, গ্যলরি সিট, মাঝখানে পিচ। পরেরদিন ২০১৯-এর ওয়াল্ডকাপ ফাইনাল!
হঠাৎ যেনো কানে ভেসে এলো অগুন্তি দর্শকের কলরব, শেষ মুহূর্তে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে ভারত আর ইংল্যান্ডের মধ্যে। এই ওভারে ফ্লিনটফের হাতে বল। সঙ্গে সঙ্গে দুটো উইকেট। ভারতের দরকার বারো বলে এগারো রান। হাতে দুটো উইকেট। ফাইনাল ওভার, ভারতের চাই দুই রান, ইংল্যান্ডের দুই উইকেট। ডট বল, ডট বল এবং দুই। কাইফের উচ্ছ্বাসে হাঁটুমুড়ে বসে পড়েন ফ্লিনটফ। কিন্তু এ কী? ক্যামেরা তো আমাদের ব্যলকনিতে। অনুভব করলাম পাশে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন সৌরভ গাঙ্গুলি খুলে ফেলেছেন তার জার্সি। প্রবল দাপটে, উচ্ছ্বাসে উড়িয়ে দিচ্ছেন সেটাকে জয়ের আনন্দে। “পারফেক্ট রিভেঞ্জ টু ২০০১”। হ্যাঁ, মিতভাষী বাঙালি একমাত্র পারে আবেগে আনন্দে মোক্ষম জবাব দিতে। টাইমমেশিনে সেদিন আমরা ওই স্মরণীয় মুহূর্তের সাক্ষী।
আসলে “বাঙালির শুধু মুখে মারিতং জগৎ” এই কথাটিকে প্রথমবার স্টেপ আউট করে ছক্কা মেরেছিলেন যিনি তিনি এই সৌরভ গাঙ্গুলি। অস্ট্রেলিয়ার স্লেজিং-এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে যে রকবাজি দরকার তা বেহালার ছেলেটার থাকা খুব স্বাভাবিক। বাওয়া, গালাগালি খেয়ে চলে আসবো এটা যে বাঙালির কাছে তীব্র লজ্জাজনক। তাও আবার বেহালার ছেলে হয়ে (আবেগটা বুঝুন প্লিজ)। স্টিভ ওয়াগকে টসের সময় দাঁড় করিয়ে রেখে, কিছুক্ষণ পর নিজেই টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতন বুকের পাটা আগে কটা ভারতীয়র ছিলো বলুন তো! আপনি বলবেন ঔদ্ধত্য, তা খানিক মানলাম বইকি কিন্তু আপনারাও তাহলে, “বাঙালিকে মাথায় চাঁটি মেরে সব কাজ করানো যায়” এই তকমা আর দেবেন না কিন্তু। আসলে বাঙালির সবসময় একটা চাগাড় দরকার, আর “দাদা” তা দিয়েছেন প্রত্যেকটা চার আর ছয়ে। “বাঙালি তো ব্যবসা বোঝেনা” এই অপবাদকে ধূলিস্মাৎ করতে পারে সৌরভের রিস্ক ম্যানেজমেন্ট। না হলে ম্যাচ-ফিক্সিং এর সময় ক্যপ্টেনসিপ নেওয়ার ক্ষমতা সবার থাকেনা। হ্যাঁ, বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি রাজনৈতিক চক্রব্যূহে কিন্তু ফিরে এলেন প্রেসিডন্ট ওফ বি.সি.সি.আই হয়ে। বাঙালি কাঁকড়ার জাত বলেন অনেকে, এভাবে ভাবলে ঠিকই। আমাদের মাথা মুড়িয়ে রাখার চেষ্টা করতেই পারেন, শত বাধায় আটকে দিতে পারেন উন্নতি কিন্তু মাটি কামড়ে পড়ে থাকবো ততক্ষণ যতক্ষণ না মাটি ফুঁড়ে জায়গা করে নিতে পারি নিজেদের।
প্লেয়ার্স কর্ণারের লাল বাড়িটার সামনে এখনও লোকের ভীড় হয়। সেই বাড়ির কাছেই “প্রিন্স”-এর রোলের দোকানে রোল খাইয়ে কোনও বাবাইদা এখনও শর্মিষ্ঠাকে বলে, “তোকে এমন ভালোবাসি যেমন সৌরভ বাসে ডোনাকে”। দুর্গাপুজোর ঢাকের তালে এই একটি মন্ডপে ভীড় হয় কোনও থীম ছাড়া। মহামায়ার মুখের থেকে দাদার ঢাক বাজানো এখানে শারদ সম্মান পায় হাজার হাজার লোকের ভালোবাসায়। মেরুদণ্ডহীন নয় বাঙালির গ্লোবাল দাদাগিরি সৌরভ গাঙ্গুলি। ডগলাস মাঠে ক্রিকেট খেলা ছেলেটা আসলে সাধারণকে স্বপ্ন দেখাতে পারে। শুধু তাই না, প্রমাণ করে দিতে পারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ফিরে আসা যায়, স্বপ্নকে আলবাৎ বাস্তবায়িত করা যায়, জেদটা যেনো থাকে।
আর প্রেম?কালো সিল্কের পাঞ্জাবি পড়ে সেদিন উনি এসেছিলেন সামনে।পারিবারিক সম্পর্ক থাকলেও কোনওদিন খুব উৎসাহ দেখাইনি আমি। কিন্তু পারিবারিক বিয়েবাড়িতে বর-কনে একলা হয়ে যেতে পারে যার উপস্থিতিতে, তা স্বচক্ষে দেখেছিলাম সেদিন। উপচে পড়া সেলফির ভীড়ে প্রায় ভেঙে পড়ার অবস্থা কনের বসার জায়গার। কিন্তু তবুও বিন্দুমাত্র বিরক্তি নেই এই নক্ষত্রের। স্মিত হাস্যে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেদিন। সেদিন ওই পাঞ্জাবি পড়া ব্যক্তিত্বকে দেখে মনে হয়েছিলো বাঙালির প্রেমের গল্পে তো নায়ক এমনই হয়। শান্ত অথচ তীব্র, নম্র অথচ বিচক্ষণ। রোমান্টিক চশমা পরিহিত উজ্জ্বল দুটি চোখে ঘায়েল হবেই আঠারো থেকে আশি।
টুপিখোলা সম্মান আপনাকে।“দাদাগিরির জনক”, সৌরভ গাঙ্গুলি, আপনার জন্মদিন সদ্য হয়ে গেলেও আপনার জন্মের দিনটি রোজ স্পেশাল, অগুন্তি ফ্যানেদের জন্য। আমি এখনও শচীনের অন্ধ ভক্ত কিন্তু বাঙালি হিসেবে আপনি অবশ্যই একটা কারণ গর্বিত হওয়ার। যুগ-যুগান্তর ধরে বাবাইদারা লড়তে শিখুক আপনার দেখানো রাস্তায়। প্রেম থেকে প্রফেসন, যা করবো “জান” দিয়ে করবো, নাহলে বাঙালি কিসের? অহেতুক “রেবেল” হওয়ার প্রতিযোগিতায় না নেমে, নিজের আবেগ আর সত্তাকে তুলে ধরাই আসল পরিবর্তন, শিখেছি আপনার থেকে। আপনি আমার ফেলে আসা, বড়ো হয়ে ওঠার পাশের পাড়া, ভালো থাকবেন দাদাগিরিতে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register