Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

"এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো" 26য় অভিজিৎ চৌধুরী

maro news
"এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো" 26য় অভিজিৎ চৌধুরী

বেলা নগর     

বেলানগর স্টেশনটা এখন কেমন হয়েছে জানি না , তখন বেশ নির্জন ছিল । হল্ট স্টেশনগুলির এক আশ্চর্য সৌন্দর্য থাকে । একটা চায়ের স্টল থাকে । সেখানে ঘুগনি , মাটির ভাঁড়ে চা আর আ-সেঁকা পাউরুটি পাওয়া যায় । আ-সেঁকা পাউরুটিতে বেশি অ্যাসিড হলেও তখন টের পেতাম না । বেশ উপাদেয় লাগত । চাকরি পাওয়ার পর ডিম-সেদ্ধ যোগ হয়েছিল । তবে সেসব আমাদের বেকার জীবনের কথা ।
সেবক সংঘের মাঠের একটা কোণার দিকের বারান্দায় ছিল আমাদের ঠেক । আলো-অন্ধকার খেলাঘরের মতোন বিলয় আর অভ্যুত্থান বিন্দুর মতোন সেখানে ওঠা নামা করত ।
অবসর ছিল অনন্ত । সময় অফুরান । জমত শনিবার । অণুংকর আর প্রদীপ দুজনেই শিবপুর বি. ই. কলেজ থেকে আসত । আড্ডা সেদিন প্রলাম্বিত হত । আর রোববারের দুপুরের কথা মনে পড়লে সেই সমস্ত রোদ্দুর ছিল যেন রূপকথা । 
সেই শনিবার অণুংকর এলো না , প্রদীপ এলো ।
বলল- সে তো অনেক আগে বেরিয়েছে ।
আমি , অমিয়াভ একসঙ্গে বললাম – সে গেলোটা কোথায় ! 
সুদীপ বলল – সন্দীপটাও তো নেই ।
আমরা বললাম , তাই-তো । স্যান্ডিও অফ ।
অবশ্য পরদিন রোববারে দুজনেরই দেখা পেলাম ।
বেশ বিশ্রস্ত চেহেরা । সেদিন ওরা কিন্তু ভাঙেনি কিছুই ।
ভাঙল এই মধ্য বয়সে আমাদের শারদীয়া আড্ডায় ।
স্যান্ডি একটা গ্রুপ করেছে এখন । হোয়াটস অ্যাপ ।
নাম ব্যাচ-৭৮। সেই গ্রুপে দীপংকর তার নাট্যচর্চার ধারা বিবরিণী দেয় । আর আমি এই বয়সে শোনাই রাক্ষস-খোক্কস আর পরীদের গল্প ।
স্যান্ডিই শুরু করল । অণুংকর , বেলানগর – সেই রাতটার কথা মনে পড়ে ।
অণুংকর হেসে উঠল ‘হো হো’ করে । সেই আমাদের পুরোনো বন্ধু অণুংকর ।
শারদীয় আড্ডায় দিল্লির নয়ডা থেকে আসতে পারেনি কিন্তু হাসির সংকেত পাঠাল ।
আমার মনে পড়ল সেই সুন্দর চোখ দুটো , ফর্সা ঝকঝকে দাঁত আর চমৎকার লাবণ্যে ভরা মুখটা ।
আমারা সকলে বদলে গেছি বাইরের চেহেরায় ।
ভয়ংকর রোগা ছিলাম , এখন ভয়ংকর মোটা হয়েছি । বন্ধুরা দেখেই বলে উঠল – কি হয়েছিস তুই !
এবার আসি বেলানগরের কথায় । অণুংকর চিরকালই সবটা কথা বলত না । এবারও একটু বলে বাঞ্জণা সমর্পণ করল স্যান্ডিকে ।
স্যান্ডি ব্যাংকে রয়েছে কিন্তু সে ইচ্ছে করলেই পেশাদার বাচিক শিল্পী হতে পারত ।
বেলানগর কিন্তু কোন হল্ট স্টেশন ছিল না । কর্ড লাইনের একটি স্টেশন ।
দীপংকর বলল – দুজনেই সেদিন কর্ড লাইনেই ছিলই !
স্যান্ডি হাসল ।
বলল- হ্যাঁ । একটু রাত হয়েছিল । বর্ধমান , মেইনের বদলে কর্ডে উঠে পড়ি ।
দীপংকর বলল – কিন্তু অণুংকর !
স্যান্ডি বলল – ‘ও’ একই ভুল করেছিল । 
তাই তো !
হোয়াটস অ্যাপে অণুংকর জানালো –হ্যাঁ ।
দীপংকর অপেক্ষা করতে পারছে না । শারদীয়া আড্ডার ব্যবস্থাপক এবার ভোলা আর মুরারি ।
পুরোনো সেই ক্লাসরুম যেন , কে নেই !
অভিনব , সুদীপ , চন্দন , চিন্ময় , অমিয়াভ , অরূপ , অচিন, কার্তিক , অনুপ , বিশ্বজিৎ , তানা , শৈবাল , ভালু ও ভাণু – কে নেই !
ইলিশের ফ্রাই চলে এলো সঙ্গে ব্ল্যাক কফি । 
মুরারি বলল – রাত অবধি থাকতে হবে সবাইকে ।
স্যান্ডি বলে – রাতে হুইস্কি আর প্রন ।
স্যান্ডি হচ্ছে এই গ্রুপের প্রাণ-পুরুষ । সে-ই খুঁজে খুঁজে বের করেছে সকলকে । অতল জলে হারিয়ে যাওয়া কৈশোরকে ফিরিয়ে আনা এই গ্রুপের কর্তব্য ।
ফিরে হয়তো গেছি । আমি তো দিব্যি ব্ল্যাক বোর্ড আর চকের গন্ধ পাচ্ছি ।
স্যান্ডি ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিয়ে চোখ বুজল । আহ্লাদের কামড় বসালো ইলিশের ফ্রাই-য়ে ।
ট্রেন বেলানগর ঢুকতেই চমকে গেলাম । এরপর গেলে তো কোন্নগরে বাড়ি ফিরতে পারব না ।
সামান্য বৃষ্টি হয়ে গিয়ে স্টেশন চত্বর বেশ ধবধবে হয়ে গেছে । ছাতিম গাছের তলায় চপ ভাজা হচ্ছে । 
একজন বয়স্ক মানুষ ভাজছেন । আর ঠোঙায় ভরে দিচ্ছে এক তন্বী । তার হাতের নেল-পালিশ কখনও কখনও লেপটে যাচ্ছে ঠোঙার বাইরের অংশে । 
খিদে ছিল সঙ্গে যোগ হল নান্দনিকতা ।
আবার হো হো হাসির সংকেত পাঠাল অণুংকর । মুঠোফোন জেগে উঠল ।
স্যান্ডি ঝুঁকে পড়ে দেখল , অনুংকর লিখেছে – চপসুন্দরীর প্রণয়ে আটকে পড়েছিল সন্দীপ । গোটা দশেক ‘চপ’ পরপর মেরে দিলো । অবর আলাদা আলাদা ঠোঙায় সেই নেল- পালিশের ছাপ । 
দীপংকর বলল – তোকে দেখেই নি !
অণুংকর বলল – না । একেবারেই না ।
তারপর ! এবার দেবব্রত বলল । 
শেষমেশ আমি পীঠে হাত রাখতে সন্দীপ ফিরে তাকাল । আমাকে একটা চপ হাতে ধরিয়ে ইশারা করল ।
তানা বলল – বেলানগরে এসব বিন্দাস কর্মকাণ্ড হয়েছিল ! ইস্‌ , আমি তো বহুবার নেমেছি সেই স্টেশনে । 
সুদীপ বলল – আর কি করলি স্যান্ডি !
কিছুই না , বৃদ্ধ কিছুক্ষণ পর উনুনে জল ঢেলে দিলো । ওরা সামনের আলপথে নেমে উধাও হয়ে গেল ।
তবে !
কী ? আমি বললাম ।
অপাঙ্গে একবার আমাদের দুজনকে দেখেছিল ।
আমাদের সেকেলে , সাবেকি গল্প এখানেই শেষ হওয়ার কথা কিন্তু আর কিছুটা ছিল ।
অণুংকর বলল – ট্রেনের বিভ্রাটে দুজনেই আটকে গেলাম । একটা ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত ঘরে রাত কাটল আমাদের । মশক দংশনে টের পেলাম কি ভুলই না করেছি । 
স্যান্ডি বলল – সকাল হল । টিকিট কাউন্টার খুলল । ছাতিম গাছের তলায় চা , চপও ফিরে এলো। কিন্তু ...
তালা বলল – হ্যা । আমি বহুবার খেয়েছি । কিন্তু সেখানে তো কোন তন্বীকে দেখিনি । 
দীপংকর বলল – কিন্তু সেই তন্বী নেই । তাও আবার চপ খেয়েছিলি !
অণুংকর বলল – ঘুগনি , পাউরুটি , ডিম সেদ্ধ খেয়েছিলাম ।
স্যান্ডি আর পারল না ।
বলল – নতুন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম – সন্ধেয় বুঝি অন্যরা বসেন !
এই চপওয়ালা যুবক ,স্বাস্থ্যবান । বেরসিক চেহেরা , বেশ ষণ্ডামার্কা ।
তবুও বলল , ভূতেদের দেখেছিলেন । 
বাবা আর মেয়েকে দেখেছিলেন তো ! 
হ্যাঁ । ঢোঁক গিলে বললাম ।
অনেকেই দেখেন । দুজনে মিলে সুইসাইড করেছিল । চপ বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিল । 
স্তব্ধ হয়ে গেলাম । দুজনেই ।
অণুংকর লিখল – সত্যিই তাই ।
এরপর যুবকটি যেন শাসানোর গলায় বলল – এসব কাউকে বলার দরকার নেই ।
স্যান্ডি বলল – ‘আমি বললাম , কেন !’
সবটাই তো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে । আজ সন্ধেয় আরেকবার আসব । আমরা কিন্তু ভূতে বিশ্বাস করিনা ।
যুবকটি এবার কর্কশ গলায় বলল – জ্যান্ত ফিরবেন না তবে !
আমরা স্তব্ধ হয়ে রইলাম । 
মুরারি বলল – চল্‌ রান্না হয়ে গেছে । স্যান্ডির গল্প খাওয়ার পর আরেকবার শোনা যাবে ।
অণুংকর হোয়াটস অ্যাপে লিখল – আমরা আজও বুঝতে পারিনি সেদিনের সেই দৃশ্যটা ভৌতিক না অন্য কিছু !
স্যান্ডি বলল – আর কখনও বেলানগর যাইনি । 
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register