Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

"এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো" 26য় ঋতব্রত গুহ

maro news
"এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো" 26য় ঋতব্রত গুহ

শেষ রাতের রহস্য 

১। 
কি অবস্থা দেখ চারদিকে ! বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার , বৃষ্টি  সব মিলে একটা মেস ! "
গরম চা এ চুমুক দিতে দিতে বলল কাকুসোনা । 
আমি আর ব্রত মন ভরে তখন শ্বাস নিচ্ছি । ডুয়ারসে রোমাঞ্চই আলাদা । আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় এটা অন্য কোন পৃথিবী । যদিও ডুয়ারস আমাদের শহরের খুব কাছে কিন্তু এখানে আসার সময় হয় কোথায় ! আমি আর ব্রত ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছি সদ্য । আমাদের আপাতত হাতে কোন কাজ নেই । আমরা কাকুসোনাকে অনেক কষ্ট করে চারদিনের ছুটি নিতে রাজি করিয়েছি । কাকুসোনার যেহেতু ব্যবসায়িক কারণে এদিকটায় বেশ পরিচিতি রয়েছে তাই আমাদের বুকিং পেতে অসুবিধে হয় নি । আমরা সরকারি বাংলোয় বুকিং পেয়েছিলাম । কিন্তু বাধ সাধল ব্রত । যেহেতু সরকারি বাংলো সেহেতু  সেখানে লোকজনের বেশ ভিড় । ব্রতের মতে অরণ্যের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করবার জন্য একটু নিভৃত স্থান প্রয়োজন । একটা জায়গায় এত ভিড় থাকলে সেই শান্তি পাওয়া যাবে না । শেষমেশ ব্রতের চাপে আমরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম । এই জায়গাটা অনেকটা ভেতরে । একটা ছোট ফরেস্ট বাংলো । আশেপাশে তেমন জনবসতি নেই । একটু দূরে কোথাও জনবস্তি রয়েছে ।  আজ সকালে বাংলোর সামনে দিয়ে লোকজন যেতে দেখেছি । যদিও বিকেল হলেই জায়গাটা একদম ফাকা হয়ে যায় । 
“কাকুসোনা এইটেই তো আনন্দ । এমন রোমাঞ্চ ই তো চেয়েছিলাম । কি থ্রিলিং বল তো ! "
এখানে লোক বলতে আমরা চার জন । আমি , ব্রত , কাকুসোনা আর শিবু । শিবু এই বাংলোর কেয়ার টেকার । বয়স আন্দাজে খুব চুপচাপ । একজন রাঁধুনে সারাদিন থাকে । বিকেল বেলা চলে যায় ।
“একটু গা ছমছম লাগছে ! কি বলিস ! " কাকুসোনা কে দেখে বোঝা যাচ্ছে যে কাকুসোনা বেশ ভয় পাচ্ছে । এমন পরিবেশে সেটা অস্বাভাবিক না । ব্রত কাকুসোনার কথায় বিশেষ পাত্তা দিল না । খালি গলায় গান ধরল । বাইরে বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। ভেতরে আলো থাকলেও তার তীব্রতা বিশেষ নেই । আমার বেশ ভয় লাগছে । হঠাৎ উপরের তলায় মানুষের হাঁটার শব্দ । আমি আর কাকুসোনা একসাথে লাফিয়ে উঠলাম । 
“ডিনারের সময় হয়েছে । শিবু আসছে নিচে ! এতে ভয় পাওয়ার কি আছে ! “ ব্রতের কথা শুনে একটু  বল পেলাম । 
“কাকুসোনা তো ভূতে বিশ্বাস করে । তুই তো সেটা করতিস না । তবে এত ভয় পাচ্ছিস কেন ! "
আলো তে অনেক জিনিস অবিশ্বাস করে থাকা যায় কিন্তু অন্ধকারে সেটা যায় না । ব্রতকে আমি উত্তরটা দিতেই যাচ্ছিলাম ততক্ষণে শিবু নেমে এসেছে ।
"স্যার ডিনার সেরে নেবেন । চলুন । এখানে বেশিক্ষণ বসে থাকা ঠিক হবে না । “
প্রথম অংশ টুকু ঠিক ছিল । পরের অংশ টা একটু দ্বন্দ্বে ফেলে দিল । আমি প্রশ্ন করার আগেই কাকুসোনা প্রশ্নটি করল । 
"বেশিক্ষণ বসে থাকা ঠিক হবে না মানে ! "
শিবু কোন উত্তর দিল না । আমি ব্রতের দিকে তাকালাম । ব্রতের মধ্যে কোন হেলদোল নেই । চেয়ারে হেলান দিয়ে দিব্যি বসে আছে । 
"কোন ভয়ের কারণ আছে ! "
আমার প্রশ্নেরও শিবু কোন উত্তর দিল না । 
“আসুন ! খেয়ে নেবেন । " শিবুর গলাটা কেমন যেন একটা । শীতল এবং গভীর । এই পরিবেশে ওর গলা শুনলে ভয়টা বহুগুণ বেড়ে যায় ।  
ব্রত হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরল । এগিয়ে গেল শিবুর দিকে । 
“এখানেই তো প্যাটিনসন সাহেব আত্মহত্যা করেছিলেন । ওপরের ঘরটিতে । তারপর থেকে যারা এখানে এসেছেন তারা অনেকেই এই বাংলোয় ওনার আত্মার উপস্থিতি টের পেয়েছে । তাই না ! "
ব্রতের কথা শুনে কাকুসোনা আবার বসে পড়লেন । আমারও  কেমন যেন শিহরিত লাগল । 
শিবু ব্রতের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল । 
“আপনি জানেন ! তাও এসেছেন । 
ব্রত হাসল । 
“কেন ভূত কি প্রতিদিন আসে না কি মাঝে মাঝে আসে ! "
কাকুসোনা খেপে গেল । 
“ভূত নিয়ে একদম ইয়ার্কি ঠাট্টা মারবি না । যখন এসে ঘাড় মটকে দেবে তখন বুঝতে পারবি ! "
ব্রত ভূতে বিশ্বাস করে না । আর আমার বিশ্বাস টা অনেকটা পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল । এই যেমন এখন প্রবল ভাবে বিশ্বাস টা ফিরে আসছে । 
শিবু র গলার স্বরটা যেন আরও শীতল হয়ে গেল । 
“অত হাল্কা ভাবে নেবেন না স্যার । একজন ভদ্রলোক বছর দুয়েক আগে এখানে এসেছিল । রাতে ওই ঘরটাতে ঢুকেছিল । পরের দিন ওই ঘর থেকে ওনার লাশ পাওয়া যায় ! আপনারা তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। বেশি রাত করা ঠিক হবে না ! "
২। 
পাশাপাশি দুটো খাট । একটিতে কাকুসোনা শুয়েছে । অন্যটিতে আমি আর ব্রত । 
“কালকে প্রবাল কে বলে আমরা অন্য জায়গায় শিফট হয়ে যাব । এখানে লোকে থাকে !  এই ব্রতটার জন্য আমাদের দুজনকেও মরতে হবে ! "
“ভূত বলে কিছু নেই । সবটাই একটা ইলিউশন । বুঝলে কাকুসোনা ! "
“তুমি একা সব কিছু বোঝ ! আমরা তো সব মূর্খ । ওখানে যে খুন টা হয়েছিল সেটাকে কি বলবি হতভাগা ! "
কাকুসোনা আর ব্রতের মধ্যে এমন যুক্তি প্রতিযুক্তির লড়াই সবসময় চলতেই থাকে । কিন্তু অন্যসময় আমি যেমন ওদের বাক্যুযুদ্ধ উপভোগ করি আজ তেমন করতে পারছি না । একটা অস্বস্তি কাজ করছে মনের মধ্যে । পাশের ঘরেই তো ….। এমন সময় কারেন্ট টা যেতে হল । 
“ধুর ! আর ভালো লাগছ না আমার । আবার কারেন্ট টাও গেল । হ্যাঁ রে বচা বেঁচে ফিরব তো ! " কাকুসোনা আমাকে এ নামেই ডাকে । 
“চল বরং ঘুমিয়ে পরি । যত এসব নিয়ে ভাবব তত অশান্তি হবে । "
“সেই ভালো ! " সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে কাকুসোনা শুয়ে পড়ল । ব্রত ও “ গুড নাইট " বলে শুয়ে পড়ল । কিন্তু এমন সময়ে ঘুম আসা কি আর সহজ কথা । আমারও ব্রতের ওপর রাগ হচ্ছে । এখানে না এলেই ভালো হত । এসেছি রিল্যাক্স করতে । সেখানে এত ঘটনা আর ভালো লাগছে না । এই ঘন অরণ্যের মাঝে এমন অভিশপ্ত বাংলো তে শুয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছে এর থেকে আমার রাত জাগা শহরটাই ভালো । অন্তত সেখানে এমন ভূতের ভয় তো নেই । আচ্ছা ভূত কি সত্যি আছে ! না কি সবটাই মনের ভুল । একবার আমাদের অঙ্কের স্যার বলেছিলেন ভূতে যদি না বিশ্বাস কর তবে ভূত তোমার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না । কিন্তু যদি ভূতে তুমি বিশ্বাস কর তবে ভূতের সাথে তোমার দেখা হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল । আর ভালো লাগছে না ভাবতে । ঘুম নেমে আসছে চোখে । 
“বচা ! বচা ! "
আমার ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল । আমি আতকে উঠলাম । বাইরে বৃষ্টি পড়ছে  মুষলধারে । 
“কি হল ! "
দেখি কাকুসোনা রীতিমত কাঁপছে । আমি ব্রতকে ডাকার জন্য পাশ ফিরলাম । দেখি ব্রত নেই । আমার শরীরটা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল । চোখ গেল দরজার দিকে । দরজাটা খোলা । 
“কি হচ্ছে এসব ! "
“ব্রত কে আমি বাইরে যেতে দেখেছি । তারপর একটা খুব জোরে আওয়াজ হল । " কাকুসোনা কাঁপতে কাঁপতে বলল । 
আমি লাফিয়ে বাইরে গেলাম । মোবাইল টর্চ টা জ্বালালাম । কাকুসোনা আমার পেছন পেছন এল । আমি জোরে জোরে ডাকলাম “ ব্রত ! ব্রত ! " কোন উত্তর এল না । পাশের ঘরটাও বাইরে থেকে বন্ধ । তার মানে ব্রত সে ঘরে যায় নি । 
এই অন্ধকারে আমাদের পক্ষে ব্রতকে খুঁজে বার করা মুশকিল । আমার মনে হল শিবুর সাহায্য না নেওয়া ছাড়া উপায়ন্তর নেই । 
“শিবু ! শিবু !  " কাকুসোনা জোরে জোরে ওর ঘরের দরজা ধাক্কাতে শুরু করল । কিছু মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে এল শিবু ! 
“কি হল স্যার ! "
“ব্রতকে পাওয়া যাচ্ছে না ! "
“সে কি ! উনি কি ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন ! "
“হ্যাঁ ! "
শিবু যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল । 
“শিবু ! কি ভাবছ ! "
“কিছু মনে করবেন না স্যার । আপনারা যারা শহর থেকে আসেন তারা কিন্তু এভাবে নিজেদেরই বিপদ বাড়িয়ে তোলেন । কি দরকার ছিল বাইরে যাওয়ার ! আগের স্যার কিন্তু এভাবেই মারা গিয়েছিলেন ! "
গলাটা কেমন শুকিয়ে এল আমার । ব্রতের কোন বিপদ হল না তো ! 
আমরা তিনজনে মিলে ব্রতকে খোঁজা শুরু করলাম । শিবুর কাছে ইমারজেন্সি লাইট ছিল  । অতএব একটু সুবিধে হল । অনেকক্ষণ ধরে খুঁজেও ব্রতকে পেলাম না । আমি ততক্ষণে মনস্থ করে ফেলেছি যে পুলিশকে খবর দেব  । শিবু আর কাকুসোনা ওপরে খুঁজছে । আর আমি খুঁজছি নিচে । ব্রতের চিন্তায় আপাতত ভয় বলে কোন বস্তু আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই । হঠাৎ বাংলোর পেছনের দিকটায় আমি একটা হোঁচট খেলাম । লাইট টা সামনে নিয়ে গিয়ে দেখলাম এক জোড়া পা । বাকি শরীরটা কাঠের পাটাতনের নিচে । নিচু হয়ে দেখলাম ব্রতের শরীরটা পড়ে রয়েছে । 
“ভাগ্যিস অজ্ঞান হয়েছিল । নইলে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যেত । "
ব্রতের সবে জ্ঞান ফিরেছে । এখনও ধাতস্থ হতে পারেনি বেচারা । কেমন শিশুর মত চারদিকটা দেখছে। 
“কেমন লাগছে এখন ! “
“ভালো ! "
আমরা আরও কিছু সময় ব্রতকে দিলাম । অনেক প্রশ্ন জমে রয়েছে মনের মধ্যে । শিবু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে । ওর মনেও নিশ্চয় অনেক প্রশ্ন ।  
“আমি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম । পাশের ঘরটা থেকে অদ্ভুত কিছু আওয়াজ শুনি । ঘরটার দিকে এগিয়ে যাই । আর কিছু মনে নেই আমার ! " ব্রত শান্তভাবে বলল । 
“স্যার ওই ঘরটার থেকে আওয়াজ শুনে ওখানে যাওয়াটাই ভুল হয়েছে । ওই ঘরটা থেকে অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায় রাতে । আমি ডিপার্টমেন্ট এর লোকজন কে বলেছি সে কথা । ওরা এসব পাত্তা দেয় না । এই বাংলোটাকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত । অবশ্য সবাই জানে এই সব কথা । তাই এখানে কেউ সচরাচর বুকিং করে না । আপনারা যে এত জায়গা থাকতে এখানে কেন বুকিং করলেন সেটা বুঝতে পারলাম না । !"
ব্রত যেন কোন গভীর চিন্তায় মগ্ন । কাকুসোনা কে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব ক্লান্ত । আর আমি সময় গুনছি কখন আলোর দেখা পাব ! 
৩। 
রাতের বেলায় চারপাশটা যেমন দমবন্ধ লাগছিল সকাল বেলাটা সে তুলনায় অনেক মনোরম । অনেক স্নিগ্ধ । সারারাত বৃষ্টি হয়েছে । চারদিকে ঘন সবুজ । 
“তবে আজ আমরা শিফট করছি তাই তো ! "
কাকুসোনা গরম চা এ চুমুক দিয়ে বলল । 
ব্রতের মুখ দেখে মনে হল ওর আদৌ ইচ্ছে নেই । অথচ ব্রতেরই তো সব থেকে বেশি ভয় পাওয়া উচিত । 
ব্রত মৃদু  হাসল । 
“আজকের দিনটা থাকি । আশপাশটা একটু ঘোরাঘুরি করি । কাল বরং শিফট করি । "
“এখানে যা কিছু ঘটছে । এখানে এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না আমার ! " আমি বললাম । 
“হ্যাঁ আর ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি ব্রত । চল আজই শিফট করে নিই ! "
কাকুসোনার অনুরোধেও কোন ভাবান্তর ঘটল না ব্রতের মধ্যে । ব্রত যেন একটা কিছু ভাবছে । 
“আমি কাল ওই ঘর থেকে যে আওয়াজ টা শুনেছি সেটা মোটেই ভূত সদৃশ নয় । কিছু একটা রয়েছে এর মধ্যে । একবার ঘরটা দেখলে ভালো হত ! "
“তুই আর বাড়াবাড়ি করিস না । শিবু তো বলেছেই ওই ঘরটা খোলা হয় না । আমাদের এত সমস্যায় মধ্যে নিজেদের জড়িয়ে কি লাভ বল তো ! তার থেকে ঘুরতে এসেছি ! ভালো করে সে কাজটা করি । এখানে কি রহস্য রয়েছে , কি ঘটছে এসবের মধ্যে ঢুকে কি লাভ বল তো ! " কাকুসোনার কথায় আমারও পুরোপুরি সমর্থন আছে কিন্তু ব্রত নাছোড়বান্দা । ও আজকের দিনটা এখানেই থাকবে। 
ব্রত সারাদিন বের হল না । নিজেকে ঘরবন্দি রাখল । আমি আর কাকুসোনা বেরোলাম । যদিও আমাদের ব্রতকে একা রেখে বেরোনর ইচ্ছে ছিল না কিন্তু ব্রত একপ্রকার জোর করেই আমাদেরকে বের করল । ডিপার্টমেন্টের গাড়ি ছিল সাথে । আশপাশটা ঘুরে দেখলাম । এমন সবুজের প্রেমে বারবার পড়তে ইচ্ছে করে । নানা রকম পাখি , কত ধরনের গাছ  ! কোথাও কোন ট্রাফিক নেই  , অশান্তি নেই । যেন সর্বত্র একটা পরম শান্তি বিরাজ করছে । হালকা বৃষ্টি হচ্ছে আজকেও । ঘণ্টা তিনেক ঘুরে ফিরে গেলাম আমরা । দেখি  ব্রত বারান্দায় বসে একটা বই পড়ছে । 
“কি ঠিক আছিস তো ! "
ব্রত মুচকি হাসল । 
“আছি আপাতত । "
যাওয়ার আগে দেখেছিলাম ব্রত কিছুগভীর চিন্তায় মগ্ন ।  এখন অবশ্য সে সব নেই । ওকে বরাবরের মোট ফুরফুরে লাগছে। 
সারাটা দিন বেশ ভালোই কাটল । যে ছেলেটি এখানে রান্না করে তার রান্না অতুলনীয় । অনেকদিন বাদে এত তৃপ্তি করে খেলাম । আমরা রাত দশটার মধ্যেই খাওয়া দাওয়ার পর্ব মিটিয়ে শুয়ে পড়লাম । বাইরে জোর বৃষ্টি চলছে । ঘুমটা তাড়াতাড়ি এসে গেল । 
৪। 
“বচা ! বচা ! "
ব্রতের গলা । 
“এখন ডাকছিস কেন ! কটা বাজে ! "
“দুটো ! চল । "
আমি অবাক হলাম । 
“কোথায় যাব ! "
“অভিযান ! " কাকুসোনা দেখি আগেই উঠে ফিটফাট হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে । 
“মানে ! "
“এতদিন ধরে যে ব্যবসা চলছে সেটা বন্ধ করবার সময় এসেছে ভাই ! সময় নষ্ট করিস না । "
আমরা তিনজনে ঘর থেকে বেরলাম । আজকেও এখানে কারেন্ট নেই । চারদিক অন্ধকার। দরজা টাকে ব্রত সাবধানে চাপিয়ে রাখল । আমাদের ঘর থেকে এগিয়ে গেলেই একটা কাঠের বারান্দা। তারপরই সেই অভিশপ্ত ঘর। আমরা পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলাম । ঘরটার বাঁদিকে একটা ছোট স্পেস আছে । আমরা সেখানেই মাথা গুঁজে কোনভাবে নিজেদের আড়াল করলাম । সামনের থেকে কেউ এলে আমাদের দেখতে পাওয়ার কথা নয় । 
“আমরা এসব কি করছি! " আমি কিছুই জানি না কি ঘটছে । কাকুসোনাকে দেখে মনে হচ্ছে কাকুসোনা সবটা জানে । নইলে কাকুসোনা যে রকম ভীতু তাতে কাকুসোনা এত রাতে এই অন্ধকারে এমন রহস্য উন্মোচনে এসেছে সেটা একপ্রকার অসম্ভব । 
“একটু সবুর কর । আর কথা বলিস না ! " নিচু স্বরে বলল কাকুসোনা । 
আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে । আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে । কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না । এত নিকষ অন্ধকারে কোন রহস্যের সমাধান হবে কে জানে । হঠাৎ দেখলাম একটা আলো ক্রমশ উপড়ে উঠে আসছে । বাইরে প্রবল বৃষ্টি পড়ছে । আমরা আরও ভেতরের দিকে ঢুকে গেলাম । প্রথমে ব্রত , তারপর কাকুসোনা এবং সবশেষে আমি । আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না । মিনিট খানেক বাদে পাশের ঘরের দরজাটা খোলার শব্দ পেলাম । চাপা স্বরে কারা যেন কথা বলছে । 
“কবে যাবে মালগুলো ! " একজন প্রশ্ন করল । 
“ভেবেছিলাম তো আজকেই যাবে । তবে কাল বোধহয় চলে যাবে । তোমরা দুদিন অপেক্ষা করতে পারলে না ! "
এই গলাটা আমি চিনি । শিবুর গলা । আমার শরীরটা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে এল । 
“ধুর কালকেই ডেলিভারি দিতে হবে । তবে মালটাকে কাল যা করেছি তাতে মনে হয় আজ আর কেউ বের হবে না । আর যদি বের হয় ওদের ভূত ঠিক মেরে ফেলবে । আজ কোন ওয়ার্নিং নয় । সোজা খালাস করে দেব । "
আমরা তিনজনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম । ওরা মিনিট দশেক কাজ করার পর দরজাটা বন্ধ করে দিল । ওরা বারান্দা ধরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল । যাওয়ার সময় শিবু আমাদের ঘরের দরজাটা খুলল । 
“ ঘরে নেই ওরা ! " শিবু চিৎকার করে উঠল । 
“খোঁজ । আজ সবগুলোকে মেরে ফেলব ! "
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম “ কি হবে এবার ! " এই প্রবল বর্ষায় চিৎকার করলেও তো কেউ শুনবে না । পালাবোই বা কোথায় ! "
কাকুসোনা ও ঘাবড়ে গিয়েছে । 
“ওই ছাগল ! কোথায় ওরা ! "
“আমাদের পালাতে হবে । পেছনে একটা সিঁড়ি আছে । " ব্রত শান্তভাবে উত্তর দিল । 
আমরা ধীরে ধীরে পেছনের সিঁড়ির দিকে এগোলাম  । বৃষ্টি পড়ছে । তাই রক্ষা । নইলে পায়ের আওয়াজে ঠিক জায়গাটা ওরা ট্রেস করে নিত । পেছনের সিঁড়িটা ব্যবহার হয় না বোধহয় । খুব সরু আর ভগ্নপ্রায় । আমরা নামতে থাকলাম । হঠাৎ ওপর থেকে কে একজন আওয়াজ করে উঠল  “ ওই যে ওরা । নিচে নামছে !" আমরা প্রাণপণে দৌড় লাগালাম । হঠাৎ জিপের শব্দ শুনলাম  । হেডলাইট এসে পড়ল বাংলোর ওপর । বাংলোর ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে ত্রিমূর্তি । আরেকটু এগিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে আমরা নিজেদের আড়াল করে রেখেছি । গাড়ি থেকে নেমে এল কজন পুলিশ । ওরা পালানোর চেষ্টা করল কিন্তু শেষরক্ষা হল না । 
৫। 
আজকের সকালটা খুব ভালো লাগছে । আর কোন ভূতের ভয় নেই । কোন রহস্য অবশিষ্ট নেই । লোকাল থানার ইনচার্জ এসেছেন আমাদের ধন্যবাদ জানাতে । অবশ্য সব কৃতিত্ব ব্রতের । 
“আচ্ছা তোমার সন্দেহ টা হল কোথা থেকে ! " অফিসার প্রশ্ন করলেন । 
ব্রত হাসল । 
“আমার মনে হয় ভূত বলে কিছু নেই । সবকিছুর পেছনেই একটা যুক্তি থাকে । প্রথম রাতে যখন আওয়াজ টা শুনি তখন কেমন একটা সন্দেহ হয় । কোন কারণ ছাড়া কেউ ভয় দেখাবে কেন । আমি ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই । ঠিক সেই সময়ই আমি অজ্ঞান হয়ে যাই । বোধহয় কোন স্ট্রং চেতনা নাশক ব্যবহার করা হয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল ঘরটা খুলে একবার দেখা উচিত । হঠাৎ আমার মনে হল শিবু বিষয়টাকে আড়াল করছে কেন ! পুরোটাই কি ভয় ! আমি ইলেক্ট্রিসিটি ডিপার্টমেন্ট এ ফোন করে শুনলাম এখানে সেদিন  রাতে কোন পাওয়ার কাট হয় নি ! অতএব কারেন্ট যাওয়ার বিষয়টি পুরোটাই ম্যান মেড।  সকালে সবার অলক্ষ্যে শিবুর ঘর  এ গিয়ে আমি ঐ ঘরের চাবিটা খুঁজি । খুঁজে পেতে বিশেষ দেরি হয় নি । ও হয়ত ভাবেনি কেউ ওর ঘর থেকে এভাবে চাবিটা  চুরি করবে ! ঘরের চাবিটার একটা কপি করে নিই । তারপর সেটা শহর থেকে বানিয়ে নিয়ে আসি । এই ব্যাপারে আমাকে বিশেষ সহযোগিতা করেছে কাকুসোনা । "
“ কখন গিয়েছিলিস তুই !" আমি প্রশ্ন করলাম । 
“ তোরা যখন ঘুরছিলিস তখন । সকালেই ফোন করে দেওয়া হয়েছিল ।"
“ আমায় জানালি না কেন এসব কিছু ! "
ব্রত হাসল 
“ একজন অন্তত থাকা উচিত ছিল যে কিছু জানে না । তবে সব কিছু প্ল্যানমাফিক চলছে কি না বোঝা যায় । এখানে কাকুসোনার পরিচিতি রয়েছে । তাই কাকুসোনা কে জানাতেই হত ! " ব্রত বলে চলল। 
"শিবু দুপুরের সময়টা থাকে না । সেই সময়ই আমি ঘরের দরজাটা খুলি । দেখি তাকে তাকে সাজানো রয়েছে সাপের বিষ , তক্ষকের বিষ । এগুলো কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয় বাইরে । ব্যস চিত্রটা পরিষ্কার হয়ে যায় । কিছু ছবি তুলে থানায় খবর দিই ! "
ব্রত থামল । অফিসার ব্রতের পিঠ চাপড়ে দিল । 
কিছুক্ষণ বাদে আমরা বেরিয়ে পড়লাম জয়ন্তীর পথে । রহস্যকে পেছনে রেখে । 
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register