Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

"এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো" 26য় সায়নী ব্যানার্জী

maro news
"এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো" 26য় সায়নী ব্যানার্জী

শান্তি

দিল্লীর একটি নামী MNC কোম্পানিতে চাকুরীরত ঋতব্রত সাহা। দিল্লীতে জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা ঋতব্রত অর্থাৎ মা বাবার আদরের ঋজু বাড়ির একমাত্র সন্তান। পড়াশুনায় ঋজু বরাবর ভালো তাই বাবা মা এর আদর, প্রশ্রয়ের পাল্লা তার দিকে একটু ভারী। ঋজু মুখ ফুটে কিছু আবদার করলে ফিরিয়ে দিতে পারেন না তারা। সম্প্রতি মাস তিনেক হলো কলকাতার একটি মেয়ের সাথে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আলাপ হয়েছে ঋজুর। অফিসের পর দুজনে বেশ অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে। ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়েছে দুজনের মধ্যে। ঋজু ঠিক করলো এবার সামনে সামনি দেখা করার পালা। কলকাতা যেতে হবে খুব শীঘ্রই। তবে মেয়েটির বিষয় এখনই বাড়িতে কিছু জানাতে চায়নি ঋজু। তাই মা বাবাকে অফিসের কাজেই যেতে হবে বলে কলকাতা রওনা দিলো। ১২ই জুলাই মেয়েটির জন্মদিন। ঋজু তাকে কথা দিয়েছে একসাথে এবার জন্মদিন পালন করবে তারা। ঋজুর বাবার ছোটবেলার বন্ধু হৃষিকেশ রায় থাকেন কলকাতার শোভাবাজারে। হোটেলে না উঠে ঋজুকে সেখানেই থাকার কথা বলেছিলেন ঋজুর বাবা। সে কথা হৃষিকেশ বাবুকে আগে থেকেই বলা ছিল। তাই কলকাতা পৌঁছতেই থাকার জায়গা, নিজের পরিচিত মানুষ সকলেই খুব আদরের সাথে আপ্যায়ন করলো ঋজুকে। হৃষিকেশ বাবুর কোনো সন্তান নেই। বাড়ীতে তিনি এবং তার স্ত্রী থাকেন।
সেদিন ছিল ৯ই জুলাই। স্ত্রীকে নিয়ে হৃষিকেশ বাবু রুটিন চেক-আপ করতে হাসপাতাল গিয়েছেন। বাড়ীতে তখন ঋজু একাই। সময়টা হবে দুপুর ৩টের আসে পাশে। কলিং বেল এর শব্দ। ঋজু দরজা খুলে দেখে শীর্ণকায় এক বয়স্ক মহিলা। ঋজুর দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন যেমন করে বহু বছর পর কাছের মানুষের দিকে আমরা চেয়ে থাকি। - বলুন, কাকে চাই ? - আমি তোমার সাথেই দেখা করতে এসেছি বাবা। -আমার সাথে? কিন্তু এটা তো আমার বাড়ি নয়। আমি এখানে কিছু দিন হলো এসেছি। আপনি আমায় চিনলেন কিভাবে? - আমি তোমার জন্মানোর খবর পেয়েছিলাম কিন্তু চোখের দেখা দেখতে পাইনি। ইচ্ছেটা মনের মধ্যে রয়ে গেছিলো। আজ অনেক বছর পর খুব শান্তি লাগছে বাবা।
কথা বলতে বলতে ঋজুর সেই মহিলার প্রতি কোথাও যেন মায়া জন্মালো। -আপনি ভিতরে এসে বসবেন? আপনার নাম, কথা থেকে এসেছেন কিছুই তো জানা হলো না। - না বাবা, আমি বেশিক্ষন দাঁড়াবো না। এই বাড়ীতে তোমার বাবাকে নিয়ে ছোটবেলায় অনেকবার এসেছি। আজ তোমাকেও এখানে এসেই পেলাম। -আমার বাবাকে নিয়ে? -পরশুদিন বাগবাজার মহিলা আশ্রমে এসে আশাবরী সাহার কথা জিজ্ঞাসা কোরো। ওখানে অনেক কিছু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি আজ আসি। পরশু অবস্যই এসো বাবা। আমি এবার একটু শান্তি চাই। -শুনুন , বলছি যে---- শুনছেন----
ঋজুর কথা শেষ হতে না হতেই মহিলা সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। অনেক বার ডাকলেও পিছু তাকালেন না। সন্ধে তখন ৬টা। হৃষিকেশ বাবু স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরলে ঋজু সব ঘটনা ওনাদের জানায়। ঋজুর কাছে বাগবাজার মহিলা আশ্রমের কথা শুনে বেশ অবাক হন হৃষিকেশ বাবু। -তুমি ঠিক শুনেছ ঋজু? বাগবাজার মহিলা আশ্রমের কোথায় বলেছেন উনি? -হ্যা-- কি যেন--- আশাবরী সাহা-- -কি!!!
নামটা শুনেই কেমন যেন অবাক হলেন হৃষিকেশ বাবু, কথা না বাড়িয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। ওনার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি ঋজুকে বললেন, -ঋজু তুমি তোমার ঠাকুমাকে চেনো? -আমার ঠাকুমা? না চিনি না। তবে বাবাকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছি। বাবা বলে আমার নাকি ঠাকুমা নেই। কোনো দিন ঠাকুমার বিষয় কোনো কথা আমায় বলেনি বাবা। হৃষিকেশ বাবুর স্ত্রী মৃদু হেসে ঘরে চলে যান। ঋজুর কাছে পুরোটাই ধোঁয়াশা।
পরশু অর্থাৎ ১১ই জুলাই ঋজু পৌঁছায় বাগবাজার মহিলা আশ্রমে। সেখানে রিসেপশনে বসে থাকা মহিলাকে বলেন- -নমস্কার। আমি শোভাবাজার থেকে আসছি। গত পরশু আমার সাথে দেখা করতে এখন থেকে আশাবরী সাহা নাম এক বয়স্ক মহিলা এসেছিলেন। উনি আমায় এখানকার ঠিকানা দিলেন। আমায় আস্তে বলেছেন। -আপনি দোতলায় আমাদের অফিস ঘরে যান। ওখানে যে আছেন তার সাথে কথা বলুন। দোতলার ডানদিকে অফিস ঘর। ওখানে গিয়ে আবারও পুরো বিষয়টা জানালো ঋজু। -আপনি ঋতব্রত সাহা। আর যার কথা বলছেন তিনি আশাবরী সাহা। -হ্যাঁ কিন্তু আমি তো ওনাকে চিনি না। অফিস ঘরের মহিলাটি ঋজুকে একটি ছবি দেখান। -দেখুন তো, এনার কথা বলছেন ? -হ্যাঁ ,এনি তো এসেছিলেন আমার সাথে দেখা করতে। -আপনার কথার সত্যতা আমি বিচার করবো না। কিন্তু অনেক সত্যি কথা আছে যা আপনার জানা দরকার। -কি সত্যি কথা?
বিগত ২২ বছর ধরে আশাবরী দেবী আমাদের এই আশ্রমে ছিলেন। ওনার ছেলে ওনাকে এখানে কিছুদিনের জন্য রেখে দিল্লীতে চলে যান। বলেন পরে এসে আশাবরী দেবীকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু কোনোদিন ফায়ার আসা তো দূর, একটা খবর পর্যন্ত নেন নি। ওনার ছেলের এক বন্ধু থাকে শোভাবাজারে শুনেছিলাম। তাকে মাঝে মাঝে চিঠি লিখে ছেলের খবর নিতেন উনি। শেষ চিঠিতে নাতি হওয়ার সংবাদ আসে। তারপর আর কোনো খবর নেই। অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কোনো ফল হয়নি। তিন বছর আগে আশাবরী দেবী চলে গেলে আমরা সেই শোভাবাজারের ঠিকানায় চিঠি পাঠাই। কিন্তু কেউ আসেনি। চিঠির উত্তর ও আসেনি। -চলে গেলেন মানে? আর ওনার ছেলে দিল্লীতে থাকেন? কি নাম ওনার? -রজতাভ সাহা। আর ওনার মা আশাবরী সাহা তিন বছর আগে মারা গেছেন। ছেলের হাতে জল পান নি তাই হয়তো নাতির কাছে এসেছিলেন। উনি তোমার ঠাকুমা হন। নিয়ম মেনে ওনার শ্রাদ্ধ যতটা করা সম্ভব আমরা করেছি। কিন্তু উনি তো মা। ছেলে শত অন্যায় করলেও ছেলে-নাতির হাতে শেষ জল টুকু পাওয়ার জন্য আজও ঘুরে বেড়ান। আজ ১১ই জুলাই, ওনার চতুর্থ মৃত্যু বার্ষিকী।
ঋজুর চোখে তখন জল আর বাবার কাজের জন্য বুক ভরা অনুশোচনা। ভাগ্যিস সেদিন কথায় কথায় জলের গ্লাসটা হাতে দিয়েছিলাম। না হলে আত্মগ্লানিতে আর অপরাধবোধে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না।
রজতাভ বাবুকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না ঋতব্রত। তাদের আদরের ঋজু।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register