ইসপ্যামার ভিতরের অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে নিজের মনেই হাঁটছিলাম ,তাই ঠিক কতক্ষণ হেঁটেছি বলতে পারবো না!!!
হঠাৎ দেখলাম আমার সামনে একটা বিশাল এবং ব্যস্ত ,আলো ঝলমলে প্রাসাদোপম বিল্ডিং,যার উপরে সিনথিয়ার কথা অনুযায়ী 'স্যল কমিউনিটেয়ার' কথাটা জোরালো রঙিন আলোতে জ্বলছে নিভছে...তার মানে আমি আমার গন্তব্যে এসে গেছি।
সামনের বিশাল আলোকিত এন্ট্রান্স গেটটা দিয়ে নানারকম মানুষজন দলে দলে ঢুকছে। অল্প কয়েকজন বেরিয়েও আসছে। বেশিরভাগ ই আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা। তাদের হাসি,কথার মৃদু মৃদু গুঞ্জন এখান থেকেই হাল্কা হাল্কা শোনা যাচ্ছে।
তবে এখানে খুব বয়স্ক কাউকেই দেখছি না।
আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি... আমার এতদিনের চেনা পৃথিবীর জীবনে যেগুলো দিনের বেলায় হোতো বা করতাম, ইসপ্যামার দুনিয়ায় সেগুলো সবই আমায় রাতে করতে হবে। পৃথিবীর মধ্যেই এ এক অদ্ভুত অন্য পৃথিবী...আর আমিও এই অদ্ভুত পৃথিবীর একটা পার্ট হতে চলেছি...হতে চলেছি আর কি...হয়েই গেছি!!!
বড় হলটার সামনে এসে গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়েই ডান দিকে চোখ টা পড়লো।
গডেস নিক্সের বিশাল এফেজি টা নিমেষে আমার চোখ টেনে ধরলো। আমি কোন এক অমোঘ আকর্ষণে স্ট্যাচুটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
'নিক্সের' মায়াময় সুন্দর মুখটা আমার বুকের ভিতরটা একটা আলোতে ভরিয়ে তুললো...ঠিক আমার স্বপ্নে (??) দেখা সেই অপার্থিব অলৌকিক নিষ্পাপ সৌন্দর্য্যে ভরা মায়াঘেরা মুখ!!!
আচ্ছা... যে শিল্পী এই মূর্তি গড়েছেন...তিনিও কি গডেস্ কে নিজের চোখে দেখেছিলেন?? না হলে সেই একই মুখ উনি কি করে এই অদ্ভূত গোলাপি রঙের আলো বেরোনো পাথরে ফুটিয়ে তুলতে পারলেন??
নিক্সের পায়ের কাছে আধখানা চাঁদ... যা গডেসের সিম্বল। কাঁধের উপর একটা হোয়াইট আউল আর বাম হাতে একটা ডিমের মতো কিছু ধরা আছে মনে হোলো... ভালো করে দেখার জন্য একটু এগিয়ে গেলাম....
" ওটা এগ্ ই... ঐ এগ টা থেকে গডেস সৃষ্টি কে জন্ম দিয়েছেন... "
অচেনা গলার স্বরে চমকে উঠে ফিরে তাকালাম। আমার পাশেই একজন মাঝবয়সী , মুখে অসংখ্য রেখা ওয়ালা কালো রঙের কোট ও প্যান্ট পরা মানুষ এসে দাঁড়িয়েছেন। ভদ্রলোকের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই আমার মনে কেমন যেন একটা কষ্টের অনুভূতির ঢেউ উঠে মিলিয়ে গেল...ওনার ছলছলে চোখের আর আপাত হাসি হাসি মুখের মধ্যে যেন কত দিনের কি এক অব্যক্ত বেদনা ছায়া ফেলে রয়েছে...
আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে , একটু হেসে উনি বললেন, "আমি 'উইলি ডি'সুজা'। এই ইসপ্যামার 'চিফ হর্টিকালচারিস্ট এ্যান্ড গ্রীন কিপার'.... তুমি তো নিশ্চয়ই নতুন ফ্লেজলিং??"
আমি মাথা নাড়লাম...
"তুমি ভ্যাম্পায়ার...না??"
আমি আবার মাথা নাড়লাম...শুনতে খারাপ লাগলেও ... কষ্ট হলেও... আমাকে এখন এই কথাটা শোনা অভ্যেস করে নিতে হবে
"আমার মেয়েটাও ঠিক তোমারই মতো ছিল...এই রকমই সুন্দর, কনফিডেন্ট!! আর....আর...পাওয়ারফুল...না হলে স্বয়ং হাই প্রিস্টেস নিজে থেকে ওর মেন্টর হতে চান!!!!"
বলতে বলতেই আমার দিকে তাকালেন উইলি...আর আমার মুখে ফুটে ওঠা কৌতুহলটা আঁচ করতে পারলেন... ম্লান একটা হাসি ফুটে উঠলো ওনার মুখে...
"আমার মেয়ে, 'জুহেতা'..."
বলে চুপ করে নিক্সের হাসি ফুটে ওঠা অপূর্ব মুখ টার দিকে তাকিয়ে রইলেন উইলি।
আমি আন্দাজ করলাম, ওনার মেয়ে হয়তো অন্য কোন ইসপ্যামায় ট্রান্সফার হয়েছে... জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কি হবে না ভাবতে ভাবতেই উইলি কথা বলে উঠলেন।
"বলতে পারো?? আমি কি অন্যায় করেছি...যার জন্য গডেস্ আমাকে এতবড় শাস্তি দিলেন... এর থেকে আমাকে কেড়ে নিলেও তো পারতেন..."
ওনার কষ্টের গভীরতা যেন আমারও বুকের ভিতরটা মুচড়ে দিলো... আমি বুঝলাম ওনার মেয়ের নিশ্চয়ই খুব খারাপ কিছু হয়েছে... আমি ওনার একটু কাছে এগিয়ে গেলাম।
"উইলি আঙ্কেল...কি হয়েছে জুহেতার?? খুব কষ্ট না হলে আমাকে বলবেন প্লিজ?? শেয়ার করলে কিন্তু যন্ত্রণা কমে আঙ্কেল...."
"তুমি... তুমি আমাকে আঙ্কেল বললে মা!!!!"
এবার দৃশ্যতই ওনার ছলছলে চোখ দুটো জলে ভরে এল।
"গডেসরা আমাকে শাস্তি দিয়েছেন মা... কি দোষে জানি না... যদি কেড়েই নেওয়ার ছিল...তবে এত সুন্দর মেয়ে দিয়েছিলেন কেন? ছোট থেকে মা ছিলো না... এই দুটো হাত দিয়ে বড় করেছিলাম ওকে। আমি বহুদিন ধরে ইসপ্যামাকে সার্ভ করেছি। গাছ পালা, ফুল ,ফল দিয়ে কতো গুলো ইসপ্যামা কে সুন্দর বানিয়েছি। যখন জুহেতার ষোলো বছর বয়সে জানতে পারলাম। আমার মেয়ের শুধু মাত্র আমার মতো খালি গাছ পালা,ফুল এসবেই এফিনিটি নেই...তার থেকে অনেক অনেক বেশি কিছু পাওয়ার আছে... গডেস্ রা ওকে ভ্যাম্পায়ারের পাওয়ার দিয়েছেন.... আমি.... আমি খুশিতে...ও...ও নিজের যোগ্যতায় ইসপ্যামা তে সিলেক্টেড হয়েছিলো। হাই প্রিস্টেস নিজে থেকে ওর মেন্টর হয়েছিলেন। কত গর্ব...কত আনন্দ... হঠাৎ করে সব শেষ...সব..."উইলি ফুঁপিয়ে উঠলেন।
আমি উইলির ঝুঁকে যাওয়া কাঁধে হাত রাখলাম..
"হঠাৎ করে কি এমন হোলো আঙ্কেল??...যে জুহেতা ????"....উইলি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ!!!তারপর ফিসফিস করলেন
" ওর শরীর চেঞ্জ রিজেক্ট করে দিয়েছিল..."
" মানে?? "
"মানে... ওর শরীর... ফ্লেজলিং থেকে পূর্ণ ভ্যাম্পায়ার হওয়ার জার্ণির ধকল টা নিতে পারেনি... ও কিন্তু খুব ভালো শিখছিল সব কিছু....তবুও...এক রাত্তিরে...ও তখন সার্কেলের জন্য রেডি হচ্ছিল... হঠাৎ মুখ থেকে রক্ত উঠে এল... ওঃ....সে কি রক্ত...হাই প্রিস্টেস সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এলেন... নিজের কাসলে্ নিয়ে গিয়ে প্রাইভেটলি কত রকম স্পেল এ্যাপ্লাই করলেন! কিচ্ছু হোলো না! সকাল হতে হতেই আমার মেয়েটা... আমার জুহি..." উইলি দুহাতে নিজের মুখটা ঢেকে ফেললেন... আমি উইলি আঙ্কেলের কাঁধে রাখা হাতটায় চাপ বাড়ালাম.... কিছু শোকের হয়তো কোনো সান্ত্বনা হয় না....
"জানো ???!! চলে যাওয়ার পরও জুহি আমার সম্মান বাড়িয়ে দিল.... আমার মতন সাধারণ গ্রীন কিপারের মেয়েকে....হাই প্রিস্টেস নিজের পার্সোনাল সেমেট্রিতে ইনহিউম করেছেন.... উনি নিজে আমার কাছে এসে শোক প্রকাশ করেছেন...আমাকে সোলেস্ দিয়েছেন...এ ও কি কম??"
আমি কি আর বলবো?কারণ আমার মনেও এতক্ষণে বেশ কিছু প্রশ্ন ও আশঙ্কা জন্ম নিয়েছে।
দিম্মা তাহলে এই চেঞ্জের কথাই বলছিল!!!এমন চেঞ্জ...যাতে আমার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে... এমনিতেই তো প্রথম দিকে আমার শরীরে প্রচুর সমস্যা দেখা দিয়েছিল.....যেগুলো এখনও খানিকটা আছে... তাহলে আমিও কি জুহেতার মতই... কোনোদিন... হয়তো খুব শিগগিরই... আমার চিন্তা টা উইলি পড়তে পারলেন বোধহয়...
"আমার হয়তো তোমাকে এসব কথা বলা উচিত হোলো না মা... তুমি একদম এসব ভেবোনা। সবার তো এরকম হয় না মা... তোমার কিচ্ছু হবে না... আমি ঠিক জানি..."
বলতে বলতেই উনি পকেট হাতড়ে একটা ছোট্ট শুকনো ফলের মত জিনিস আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন
"এটা নাও... তুমি... তোমার নাম টা!!!"
"আমি স্রোতস্বিনী আঙ্কেল.... আপনি আমাকে স্রোত বলতে পারেন..."
"স্রোত!!! কী সুন্দর নাম....আগে কখনো শুনিনি...এই ফল টা একটা ব্লেসড্ ফ্রুট...এটার নাম 'আরিটা'...এটা তোমাকে আমার গিফ্ট... যখন খুব ডিপ্রেসড্ লাগবে...কনফিডেন্সের অভাব মনে হবে!!!তখন এই ফ্রুট টা একটু মুখে নিয়ে রাখবে... দেখো...এই ম্যাজিকাল ফল তোমার মানসিক পাওয়ার কত বাড়িয়ে দেবে... আর এটা কখনো নষ্ট হবে না"....বলতে বলতেই উইলি চমকে উঠলেন..." এই রে!!! তোমার দেরি করিয়ে দিলাম.... শিগগির যাও...সেরেমনি শুরু হয়েই গেলো বোধহয়... আমি দেখি ফুল টুল গুলো ঠিক ঠাক গোছানো হয়েছে কি না...?"বলতে বলতেই উনি বিগ হলের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন
"উইলি আঙ্কেল...এক সেকেন্ড... আমার একটা প্রশ্ন ছিল..."
উনি থমকে গিয়ে ঘুরে তাকালেন,
"আমি কিভাবে বুঝবো ? যে আমি ফ্লেজলিং থেকে ফুল ফ্লেজেড বা পূর্ণ ভ্যাম্পায়ার হয়ে গেছি... বা সাকসেসফুলি আমার ট্রান্সফর্মেশন কমপ্লিট হয়েছে?? মানে...সাকসেসফুল না হলে তো বুঝতেই পেরেছি... আমিও...জুহেতার মতই..." বলতে বলতেই আমি থেমে গেলাম।
"একদম না হওয়ার কথা মাথায় ই আনবে না... আমার উচিত হয়নি প্রথম দিনেই তোমাকে এসব বলা... তোমার কিচ্ছু হবে না.. আমি ঠিক জানি...গডেস্ রা এত নিষ্ঠুর নন..."
আমার বলতে ইচ্ছে করলো, গডেস্ রা যদি জুহেতার বেলায় নিষ্ঠুর হতে পারেন...তো আমার বেলায়ই বা কেন হবেন না... আমি কথা টা গিলে নিলাম।
"ট্রান্সফর্মেশন খুব অপূর্ব একটা প্রসেস!! একেবারে আনওয়ার্ল্ডলি।গডেস্ রা যখন মনে করবেন তুমি উপযুক্ত হয়ে উঠেছো, তখন তারা তোমাকে ব্লেসিংস আর আরো পাওয়ার গিফ্ট দেবেন... আর তাদের একটা চিহ্ন তোমার শরীরে এঁকে দেবেন... আর তুমি কোনো একজন গডেসের প্রিস্টেস হওয়ার , পৃথিবীর ভালো করার শক্তি তোমার মধ্যে অনুভব করবে... আমাদের সবার চোখের সামনেই হবে, সব কিছু...তার পর তোমার ট্রান্সফরমেশন ঠিকঠাক হলে তোমার ইনভেস্টিচ্যর সেরেমনি হবে। কত আনন্দ, অনুষ্ঠান,আমার মেয়েটার তো..."
বলতে বলতেই উইলি হাত নেড়ে বিগ হলের দিকে দৌড়লেন।
উইলির চলে যাওয়ার দিকে দেখতে দেখতে আমি ভাবলাম... কি অদ্ভুত এই জায়গা...এই জগত...এই ইসপ্যামা....যেখানে ভ্যাম্পায়ার হওয়া গর্বের বিষয়.... আবার সেই সুপার পাওয়ারও এক মেয়েকে তার বাবার থেকে চিরতরে আলাদা হওয়া থেকে আটকাতে পারে না...তাহলে...কি লাভ এই সুপার পাওয়ারের...???? তার থেকে কত ভালো হোতো আমি যদি আবার আমার পুরোনো পৃথিবীটা ফিরে পেতাম...দিম্মা...শৌনক...এমিল...হাসি খুশি আনন্দ... স্বাভাবিকতা...
আমি 'নিক্সের' স্ট্যাচুর দিকে আরেকবার তাকিয়ে নিয়ে অজস্র প্রশ্ন ও আশঙ্কা ভরা একটা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বিগ হল্....না কি আমার ডেস্টিনি অথবা ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ালাম.....
0 Comments.