Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ১৫২)

maro news
দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ১৫২)

পর্ব - ১৫২

শশাঙ্ক পাল বললেন, তাহলে তুই রমানাথের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলি কেন?
শ‍্যামলী বলল, কি মুশকিল, গতকাল ওঁর বাবার শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে আমি ওঁদের বাড়িতে প্রথম গেলাম। আর আজ।  এর আগে ওঁরা এসেছেন, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। প্রথম দিনেই আমি বিয়ে জিনিসটাকে কি চোখে দেখি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলাম। তুমি মনে করে দেখার চেষ্টা করো। আর ওঁর বাবার স‌ই করা একটি চিঠি এসেছিল। সেই ব‍্যাপারটাও তুমি চেষ্টা করলে মনে করতে পারবে।
শশাঙ্ক পাল ধমক দিয়ে বললেন, বাজে কথা একদম বলবি না। আজ আমি খুব ভাল করে দেখেছি, রমা না খেয়ে রয়েছে শুনে তোর চোখে জল পড়ছিল। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ওকে তুই ভালবাসিস। তাহলে মিথ‍্যে মিথ‍্যে এত জটিলতা পাকাচ্ছিস কেন?
বাসন্তীবালা স্বামীর দিকে চেয়ে  বললেন, এইবার তুমি ঠিক বাপের মত পরিচয় দিচ্ছ। এর আগে মাথায় তুলে রেখে রেখে ওকে বেড়ে উঠতে দিয়েছ। এবার জোঁকের মুখে নুন পড়েছে। এই বাড়িতে বসে তুই বিয়ের সম্পর্ক নিয়ে নোংরা কথা বলবি, আর ভেবেছিস্ আমরা তোর মতো অতো লেখাপড়া জানি না বলে সব জো হুজুর বলে মেনে নেব?
শোন্, ভদ্রলোকের সমাজে তুই একলা মিশিস না। আমরাও অনেকের সঙ্গে মিলে মিশে চলি। তোর এইসব কথা তোর ওইসব ভদ্রলোকেদের কাছে গিয়ে বলে দ‍্যাখ্ না, তোর গায়ে থুতু দিয়ে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে দূর করে দেবে।
শ‍্যামলী বলল, বাবা, কার কথার জবাব দেব, তোমার না মায়ের?
শশাঙ্ক পাল বললেন, জবাব কিছুই দিতে হবে না। এটা তোর বিতর্ক সভা নয়, যে গাজোয়ারি করে কিছু একটা বলে পার পেয়ে যাবি। বাস্তব জীবন অনেক কঠিন।
বাসন্তীবালা বললেন, ওগো, বিতর্কসভাতে গিয়েও উনি এখন মোটে সুবিধা করতে পারছেন না। এই তো কলেজে ক'মাস আগে ওর নিজের কলেজে বিতর্ক হল। মেয়ে ফিরল খালি হাতে। বললাম, কি রে, এবার কিছু আনলি না যে, দিলে না তারা কিছু? তো মেয়ে মুখ শুকনো করে বলল, ফার্স্ট সেকেণ্ড থার্ড, কিছুই না কি করেনি। উৎপটাং কথাবার্তা বলে বলে বদভ্যাস তৈরি করে ফেলেছে, এখন লোকের কাছেও সেটা ধরা পড়ছে।
সবিতা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। সে এবার বলল, বৌরাণি, মেয়ে তোমাদের, তোমরা তাকে মারবে, কি কাটবে, আমার কিছুই বলার এক্তিয়ার নেই। কিন্তু একটা কথা বলছি কি, প্রাইজ আর হাততালি না পেলেই সে পুরো গোল্লা পেল, তা কিন্তু নয়। ভাল লোককেও অনেক সময় কষ্ট পেতে হয়। হয় তো, একটু বেশিই পেতে হয়। ভগবানের হিসেব বড্ড গোলমেলে।
স্ত্রীর দিকে চেয়ে শশাঙ্ক বকুনি দিলেন, আমি একটা কথা বলছি। তুমি কিছু বোঝো না, এর মধ‍্যে তুমি মাথা গলাচ্ছ কেন?
থতমত খেয়ে বাসন্তীবালা বললেন, না, এবার প্রাইজ কিছু পায় নি কি না, তাই বলছি। ন‌ইলে তোমার মেয়ে, তুমি মারবে না কাটবে, আমার বলার কি আছে?
শ‍্যামলী মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মা এই যুক্তিতেই কি তোমার চোখের সামনে দাদা যখন আমায় মারধোর করে, তুমি কিছু বলো না, তাই না? সত্যি বলতে কি, মায়েরা দশমাস দশদিন ধরে গর্ভে সন্তানধারণ করে, তার পরেও বেশ কয়েকটি বছর ধরে লালন পালন করলেও তোমাদের ধর্মের হিসেবে সন্তান আসলে পুরুষের। পুরুষ তাকে মারধোর করতেই পারে। মারধোর খাওয়াই নারীদের ভবিতব‍্য। রামচরিত মানসের কবি তুলসীদাস বলেছেন,
ঢোল গাঁওয়ার, শূদ্র, পশু, নারী,
ইয়ে হ‍্যায় সব তাড়নকে অধিকারী।
মারধোর, দৈহিক পীড়ন নারীদের স্বাভাবিক ভাবেই প্রাপ‍্য মা। আর লক্ষ্মণকে যখন শক্তিশেল মেরে শুইয়ে দিয়েছে মেঘনাদ ইন্দ্রজিৎ, তখন নিস্পন্দ নিস্তেজ লক্ষ্মণের জন‍্য কাঁদতে কাঁদতে রাম বলেছিলেন, দেশে দেশে কলত্রাণি, দেশে দেশে চ বান্ধবাঃ, সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথ শাস্তি গল্পে ছিদাম রুইয়ের বচনে লিখেছেন, ব‌উ গেলে ব‌উ পাইব, মায়ের পেটের ভাই গেলে ভাই পাইব কোথা? তো মোদ্দা কথাটা হল, একটা মেয়ের ইচ্ছে অনিচ্ছের দাম কিছু নেই। তাই ভাইয়ের হাতে তাকে মারধোর খেতে দেখলে মা হিসেবে তোমার কিছু বলার নেই। কেননা, সন্তান তো আসলে পুরুষের। পিতৃপরিচয় নিয়েই সামাজিকতা।
বাসন্তীবালা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, দেখলে? কী কথাকে চটকাতে চটকাতে কোথায় টেনে এনে ফেলল, দেখলে?
শশাঙ্ক পাল মেয়েকে বললেন, শোন্ মা, আমার কথা কটা শোন্, মেয়েদের বিয়ে করতে হয়। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, রমাকে তুই ভালবাসিস, ও না খেয়ে আছে শুনে তোর চোখ দিয়ে জল পড়ছে। শুধু শুধু গোঁয়ার্তুমি করে দুটো জীবনকে শেষ করে দিবি, এ আমি হতে দেব না। মনস্থির করে ফ‍্যাল, একটা বছর মেলামেশা কর্, সিনেমা থিয়েটার দ‍্যাখ্, তারপর কালাশৌচ কেটে গেলে বিয়ে হোক্, তখন আর লোকনিন্দার চান্স থাকবে না।
শ‍্যামলী বলল, বাবা, রমানাথকে ভালবাসি না, এই কথাটা আমি একবারও বলি নি। আর চোখ দিয়ে আমার যে জল পড়ছিল, সেটা উনি না খেয়ে আছেন বলে নয়, আমার মতো একটা তুচ্ছ মেয়ের জন্য মায়ের সাথে উনি বিরোধ করছেন, এটা ভেবে আমি কষ্ট পেয়েছি।
শশাঙ্ক পাল বোঝানোর ভঙ্গিতে মেয়েকে বললেন, বেশ বেশ, না হয়, তুই মায়ে ছেলেতে মন কষাকষি দেখেই কষ্ট পেয়েছিস্, তবুও বলছি, তুই যে তাকে ভালবাসিস, একথা তো নিজের মুখেই এইমাত্র স্বীকার করলি।
শ‍্যামলী বলল, তাঁকে ভালবাসি তো অবশ্যই। বাসি বলেই তো তিনি যখন পিতৃশ্রাদ্ধে বারবার যাবার জন্য মিনতি করলেন, পারলাম আমি আপত্তি করতে? আবার গল্প করতে ছাতে ডাকলে কোনো আপত্তি না করেই গেলাম।
শশাঙ্ক বললেন, ঠিক আছে ঠিক আছে, তোকে আমি খুব বিশ্বাস করি। যা করেছিস, নিশ্চয়ই শালীনতা বজায় রেখেই তবে করেছিস্। কিন্তু বিয়ের ব‍্যাপারে মনস্থির করে ফ‍্যাল। রমানাথও বেঁচে যায়, আমরাও শান্তি পাই।
শ‍্যামলী বলল, হুম, আইরিশ শিক্ষক মিস মার্গারেট নোবল্ তো বিবেকানন্দকে দেখে তাঁর ব‍্যক্তিত্বের আকর্ষণে ভারতে এলেন। আসলে বিবেকানন্দকে দেখে তিনি ভারতকেই ভালবেসে ফেললেন। তাই সেরা ভারতীয়দের‌ও ভালবেসে ফেললেন। জগদীশচন্দ্রকে উৎসাহ যোগান, বলেন, খোকা, এলোমেলো কোরো না, পেটেন্ট নাও, নেওয়া দরকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা অনুবাদ করে দেন। গোরা উপন্যাসের শেষটা কেমন হবে, সেই নিয়ে জোরদার তর্ক করে জিত আদায় করেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আঁকতে উৎসাহ দেন। মার্গারেট যেন এক পবিত্র দীপশিখা। সকলের ভিতর আলো ঢেলে দেন। গুরুকে নিয়ে আলমোড়া বেড়াতে গিয়েছেন। কিন্তু গুরুকে ভালবাসেন বলে আর কাউকে ভালবাসবেন না, এ তো হতে পারে না। তিনি ধর্মসম্প্রদায়ের খাঁচায় বন্দিনী হবেন বলে তো নিজের দেশ সমাজ ভাষা পরিবেশ ছেড়ে চলে আসেন নি। তিনি এসেছেন উদার মনুষ্যত্বের আহ্বানে। কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশন তো তা চায় না। আরে তুমি আমাদের গুরুর সেবার কাজ করো, মন্দিরের দালান সাফ করো, মন্দিরের কাজ করো, বাইরে বাইরে মন কিসের?
বিবেকানন্দকে গুরুভাইরা জোর চাপ দিলেন, নিবেদিতার ওই বাইরের মেলামেশা ছাড়তেই হবে। আর বিপ্লবীদের সাথে মেলামেশা মোটেও চলবেনা। আমরা ঠাকুর ঠুকুর নিয়েই থাকব। বিপ্লবীদের সঙ্গে মেলামেশার দায়ে যদি মিশনকে ব‍্যান করে দেয় ব্রিটিশ সরকার, তখন কোথায় যাব? নিদেনপক্ষে যদি বিলেত আমেরিকা থেকে ডোনেশন আনা বন্ধ করে দেয়, তো পেট চলবে কী করে? দু নৌকায় পা রাখা চলবে না। হয় পুরোপুরি আমাদের হ‌ও, নয় তো কেটে পড়ো। নিজের থেকে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে সম্পর্ক ছেদ না করবি, তো দ‍্যাখ্ তোকে দূর করে দেব। চোখের জল ফেলতে ফেলতে নিবেদিতা রামকৃষ্ণ মিশনের সংশ্রব ছাড়তে বাধ্য হলেন।
শশাঙ্ক পাল বললেন, তার মানে তুই আজ রমানাথের সঙ্গে কথা বলবি, কাল অরিন্দমের সাথে চা খাবি, পরশু ওই বিলেতের ছেলেটাকে চিঠি লিখবি... এই চলবে তাহলে?
শ‍্যামলী বলল, এগুলো তো আমি এখনই করছি। আজ আবার রমানাথের কষ্ট ভোলাতে ওকে সবার সামনেই চুমু খেয়েছি। আগামীকাল যাতে এটা শুনে তোমার হার্ট অ্যাটাক না হয়ে যায়, তাই আগে ভাগে বলে রাখলাম।
শশাঙ্ক পাল রেগে গিয়ে বললেন, আমার বাড়িতে বসে এ রকম বেলেল্লাপনা করা চলবে না।
শ‍্যামলী বলল, যে আজ্ঞে, তাই হবে। এবাড়িতে বসবাস করার মেয়াদ আমার ফুরিয়ে এল। তবে বাবা, তুমি যে আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে না, তারজন‍্য ধন্যবাদ।
শশাঙ্ক পাল বললেন, তার মানে? বিয়ে করবি না তুই?
শ‍্যামলী বলল, কদিন ধরে তো সেই একটা কথাই তোমাকে বোঝাচ্ছি!
বাসন্তীবালা বললেন, বিয়ে করবি না তো বাচ্চা কাচ্চা হবে কি করে?
শ‍্যামলী তার মাকে বলল, বিয়ের পর বাচ্চা হতেও পারে, নাও পারে। দেরি করেও হতে পারে। ছেলে মেয়ের বাচ্চা হচ্ছে না কেন, কবে নাতির মুখ দেখব, এই নিয়ে পাগল হবার জন্যও কিছু কিছু মা  রাতে ঘুমানোর আরাম থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে।
বাসন্তীবালা মেয়েকে বললেন, তনুকে আর আমাকে ঠেস দিয়ে কথা বলছিস তো, ওপরে ভগবান আছেন, এর শোধ তিনি তুলবেন।
বিয়ে জিনিসটা একটা বেশ‍্যাখানায় যাবার মতো ব‍্যাপার, বাপ্ রে, এইসব বলার পরেও এখনো তোর জিব খসে যায় নি, আমি দেখে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।
বেছে বেছে এই সময়ই একটা টিকটিকি টিকটিক করে উঠল। বাসন্তীবালা তর্জনী খাবার টেবিলের উপরেই ঠুকে বললেন, দ‍্যাখ্ সত‍্যের টিকটিকি টিকটিক করছে। আজো চন্দ্র সূর্য উঠছে। আজো ধর্ম বলে কিছু আছে।
শ‍্যামলী অদ্ভুত শান্ত স্বরে বলল, হ‍্যাঁ মা, তার আগে ধারালো ছোরা নিয়ে খনার জিভটা কেটে নিতে হয়েছিল। খনার টুকরো জিভ খাবার জন‍্য ধর্ম তারপর টিকটিকি হয়ে গেল।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register