Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ছোট গল্পে দেবদাস কুণ্ডু

maro news
ছোট গল্পে দেবদাস কুণ্ডু

কৃষ্ণমুরারীর মৃত্যু

কাগজটা বন্ধ করে চোখ বুজলাম আমি। বুঝতে পারছি শরীরের ভিতর একটা যন্ত্রণা শুরু হচ্ছে। এরা কারা? নিজেকেই প্রশ্ন করি। পাখার বাতাসে কাগজের পাতা উড়ছে। শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু আবার কাগজটা পড়তে ভয় হচ্ছে। খবরের অনেকটা অংশ পড়েছি। পড়তে পড়তে শরীরটা অবশ হয়ে এল। বুকে একটা যন্ত্রণা অনুভব করলাম। মাথার ভিতরটা অন্ধকার অন্ধকার লাগছিল। মেইন রাস্তার ওপর গীতাঞ্জলি ঘড়ি। ঢং ঢং করে ১১টা বাজলো। বাতাস সেই শব্দকে ধরে আনে আমার ঘরে। মনে হচ্ছে চোখ খুললেই আমি সেই ভয়ানক দৃশ্যটা দেখতে পাবো। পাশের ঘরে আমার স্ত্রী পুজো দিচ্ছে। ঘণ্টার ধ্বনি আমার কানে আসছে। আমাকে আরো অস্থির করে তুলছে। পেটের ভিতরটা গুলিয়ে উঠছে। আমি কি বমি করবো? খেয়েছি তো মাত্র দু’টো বিস্কুট আর এক কাপ চা। চোখের পাতা বন্ধ। পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি। আমার ফ্ল্যাটের দক্ষিণ দিকে আছে একটা জঙ্গল। তার গাছে কিছু কিছু পাখি আসে। তাদের নানা রং আমাকে মুগ্ধ করে। আচ্ছা পাখি কি মানুষকে ডাকে? টিয়া ডাকে। বাকি পাখি? আজ বাজার গিয়েছিলাম ১০টায়। কাল রাত ২ দু’টো পর্যন্ত একটা উপন্যাস পড়েছি। সকালে উঠেছি ৯টায়। বাজারে মাছ ছিল না। কাটা পোনা খাওয়া বারণ। তবু নিতে হলো। বাজার থেকেই রোজ কাগজ কিনে আনি। কাগজ খুলে পড়ছি। মোদি আবার সরকার গড়তে চলেছে। এ রাজ্যে শাসক দল ‍‌ ৩৮ থেকে ২২ শে নেমেছ। বি.জে.পি ২ থেকে ১৮। ৭ বছর আগে এখানে পরিবর্তন হয়েছে। তবে কি ইতিমধ্যে ভিতরে ভিতরে আবার একটা পরিবর্তন হচ্ছে? তৃতীয় পাতায় এসে একটা খবরে চোখ আটকে গেল! শিউরে উঠলাম। তবে কি চোরা পরিবর্তনের স্রোত আমার জন্মভূমি কৃষ্ণমুরারী অঞ্চলকে পাল্টে দিয়েছে? খবরটা পড়ে বুঝতে পারি এতো আমায় পৈত্রিক বাড়ির পাড়া কৃষ্ণমুরারী অঞ্চল। খবরটা পড়েছি। আমাকে রিএ্যাক্ট করেছে। আমি গল্প লিখি। তাই কি? যদি না লিখতাম তবে কি ব্যাপারটা উপেক্ষার হতো? কৃষ্ণমুরারী অঞ্চলটা আমার চোখে ভেসে উঠেছে। বস্তি অঞ্চল। টালির চাল। ঘন বসতি। একটা বাড়ি আর একটা বাড়ির ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। আমাদের বাড়িটা আছে ১৬ নম্বরে। এখন আমি থাকি দাশ পাড়া। দু’কামরার ফ্ল্যাটে। মাঝে মাঝে জামাই মেয়ে এসে থাকে। ওখানে ছিল একটা ঘর। অঞ্চলটার আগে ছিল বেশ কিছু পুকুর। তার বুকে এখন তিনতলা চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ি। টালির বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে এখন সব হয়ে উঠেছে ফ্ল্যাট বাড়ি। চারতলা পাঁচতলা। এখানকার বেশির ভাগ লোক হাটুরে। হরিশা আর হাওড়া হাটে রেডিমেট পোশাক বিক্রি করে। বাবার ব্যবসা এখন ছেলেরা ধরেছে। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি এখন টাকায় বিছানায় সুখ নিচ্ছে। যুবকরা বাইক নিয়ে উড়ছে। মদ্যপান করছে। স্ফূর্তি করছে। নিষিদ্ধপল্লী যাচ্ছে। বিলাসপূর্ণ জীবনযাপন করছে। নতুন ক্লাব হচ্ছ। দু-তিনতলা। সবই বেআইনি। । নিঃশব্দে হচ্ছে। অঞ্চলটার খোল নলচে বদলে গেছে। নিঃশব্দে। সপ্তাহে দু’দিন পৈত্রিক বাড়িতে বি.এ.’র ব্যাচ পড়াতে যাই। একদিন পড়াচ্ছি। গণ্ডগোলের শব্দ পেলাম। বাইরে বেরিয়ে আসি। একটা অটো ড্রাইভার এক প্রবীণের সঙ্গে ঝগড়া করছে। কাছে গিয়ে জানলাম ভাড়া আট টাকা চাইছে। অথচ ভাড়া ছ’টাকা। সামনে পুজো। বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রবীণ লোকটি দেবে না। তাই নিয়ে তর্ক। ড্রাইভার ছেলেটি হঠাৎ লোকটিকে ধাক্কা দিল। লোকটি রাস্তায় পড়ে গেল। অটোর ভিতর থেকে একটি মেয়ে নেমে লোকটিকে তুলে অটোতে বসালো। আর দৃঢ় গলায় বলল, উনি ছয় টাকাই ভাড়া দেবে। এখন আপনি ওকে নিয়ে গৌর ডাক্তারের কাছে চলুন। ওনার মাথা ফেটে গেছে। রক্ত পড়ছে। ড্রাইভারটি ফুঁসছে। ‘আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারব না।’ ‘তবে ওনাকে নিয়ে থানায় চলো তুমি।’ আমি হঠাৎ বললাম, এবার ছেলেটি অটো স্টার্ট দিলো।
‘কি গো কি ভাবছো চোখ বুঁজে? স্ত্রীর কথায় আমার চিন্তা কাটে। চোখ খুলি বলি, ‘তোমার বাপের বাড়ি পাড়ায় কি হয়েছে জানো?’ ‘আমরা এখন ওখানে থাকি না। জেনে কি হবে? এছাড়া ওটা তোমারও পাড়া।’ ‘কাগজে খবর বেরিয়েছে!’ ‘কি খবর?’ ‘একটা ছেলেকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।’ আমার স্ত্রী একটা ছোট্ট সংস্থায় চাকরি করে। বেরুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। খবরটা শুনে বলল, ‘ওখানকার ছেলেদের হাতে কাঁচা পয়সা এসেছে। ওদের এখন মান আর হুঁশ কোনটাই নেই।’ বেরিয়ে গেল স্ত্রী। কথাটা মিথ্যে বলেনি? খবরটা আবার আমি ভাবছি রড, ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে মেরেছে। জ্ঞান হারিয়েছে যুবকটি। ওরা ভয় পেয়ে ডাক্তারকে ফোন করে। ডাক্তার এসে দেখে, থানায় খবর দেন। পুলিশ যুবকটিকে আর. জি. কর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে মারা যায় যুবকটি। পুলিশ চারটে ছেলেকে অ্যারেস্ট করেছে। ভাবলেই শিহরণ দিচ্ছে আমার শরীরে। কৃষ্ণমুরারী অঞ্চলটায় আগে কত সমস্যা ছিল। টালির চালের বাড়ি। কাঁচা রাস্তা। একটু বৃষ্টি হলে জল জমে যেত। কাউন্সিলার একটা পুরোনো সাইকেল নিয়ে ঘুরত। এখন কাউন্সিলার বাইক নিয়ে ছোটে। রাস্তায় টাইম কলের জল। সেই জল নিয়ে কাড়াকাড়ি হৈ, চৈ, মারামারি, ঝগড়া, বিবাদ। কি না হতো। আবার কেউ অসুস্থ হলে তারাই কেউ হাসপাতাল নিয়ে যাচ্ছে। অসহায় বৃদ্ধর মৃত্যু হলে নিজেরাই পয়সা খরচ করে শ্মশানে দাহ করছে। দুঃস্থ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, তারাই উদ্যোগ নিয়ে বিয়ে দিচ্ছে। সেই অঞ্চলটা এমন করে কবে পাল্টে গেল? আসলে আমার সময়ের লোকগুলো তো এখন বুড়ো হয়ে গেছে কিন্তু তাদের সন্তানরাই তো এখন যুবক। বাবার জীন, স্বভাব তো পাবে। তখন বাবারা অনেক কষ্ট করে ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে। সারা দিন বাঁচার জন্য, অর্থের জন্য ছুটেছে। প্র্তিষ্ঠিত করেছে ব্যবসা। ছেলেরা এসেছে! তারা লড়াই করলো না। অনায়াসে পেয়ে গেল সাম্রাজ্য। তাদেরই অনেকে বিগড়ে গেছে। হঠাৎ আমায় মোবাইলটা বেজে উঠলো? ‘হ্যাঁ, বল অভিজিৎ।’ ‘মেজদা আজকে খবরটা পড়েছিস?’ ‘পড়েছি তো।’ ছেলেটা চোর না রে। আমি তো হাটে যাই গেঞ্জি বেচত। আগে ফোন এক সময় চুরি করতো। এখন ব্যবসা করছে। কিন্তু হাটে তো নতুন ব্যবসা করলে এক শ্রেণীর পওনাদাররা এসে টাকা চায়। ওর কাছে ত্রিশ হাজার টাকা চেয়েছিল। ও দিতে পারবে না বলেছে। তাই চোর বদনাম দিয়ে মেরে ফেলল ছেলেটাকে? ‘ক্লাবটা কোথায় রে?’ ‘বোমায় মাঠের ওদিকে। সংগ্রাম সংঘ।’ ‘কোনদিন তো নাম শুনিনি? এখন কত নতুন নতুন ক্লাব গজাচ্ছে। জানিস তো ভোলার মা মারা গেছে। ‘কে ভোলা?’ ‘আমাদের পিছনের দত্ত বাড়ি।’ ‘সেই বাড়ি তো ফ্ল্যাট হয়ে গেছে।’ ‘সেই ফ্ল্যাটে মাকে বন্দী করে ভোলা বউ নিয়ে সিকিম বেড়াতে গিয়েছিল। খবরটা তো কাগজে বেরিয়েছিলো।’ ‘হবে হয়ত। চোখে পড়েনি।’ ‘ভোলার মা না খেতে পেয়ে ফ্ল্যাটের মধ্যে মরে পড়েছিল। পাশের ফ্ল্যাটের লোক গন্ধ পেয়ে থানায় খবর দেয়। পুলিশ এসে লাশ মর্গে নিয়ে যায়। আর ভোলা কলকাতায় ফিরেছে কাল। ওকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে।’ কিছু সময় থম দিয়ে বসে থাকি আমি। বুঝে উঠতে পারি না। বস্তিই কি ভাল ছিলো? অভাব ছিল। সেটাই ভালো ছিলো? একজনের বিপদে অন্য জন ছুটতো। একজনের নিঃশ্বাস অন্য জন টের পেত। খোলা উঠোন ছিল। আকাশ দেখা যেত। বৃষ্টি পড়লে উঠোনে গিয়ে স্নান করা যেত। ভাগবত পাঠ হতো এক মাস। অনাড়ম্বর ছিল দুর্গাপুজো। এখন জাঁকজমকে পূর্ণ। সব উঠে গিয়ে বা পালটে গিয়ে মানুষই বদেল গেল! খুব কষ্ট হচ্ছে বুকের মাঝে। আমার জন্মভূমি বাল্যের কৌশরের খেলার মাঠ, যৌবনের উপবন। সব সব পালটে গেল! অথচ এই জন্মভূমিতে যখন আমার বয়স ২৫। দোল খেলে ফাঁকা পুলিশ ফাঁড়ির পুকুরে স্নান করতে গিয়ে পা হড়কে গভীর জলে পড়ে গিয়েছিলাম। জল খেয়ে যাচ্ছি, যাচ্ছি ক্রমশ অন্ধকার। আর অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকারে আসি তলিয়ে যাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম মৃত্যু নিশ্চিত। তখন কে যেন আমার চুল ধরে টানছে। আমি তাকে জাপটে ধরছি। সে আমাকে ছিটকে দিচ্ছে। আবার আমার চুল ধরে টানছে। ধীরে ধীরে আমি আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছিলাম। পাড়ে তুলে পেট থেকে জল বের করল। যে বাঁচলো সে ছিল দত্ত বাড়ির বড় ছেলে কৃষ্ণ। সেই হাত কোথায় গেল? সেই হাত আজ রক্ত খেলায়, মৃত্যু খেলায় মেতেছে? আর ভাবতে পারছি না। আমাকে একটা কাজে ডালহৌসি যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি দ্রুত রেডি হয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। বাসে খুব ভীড়। পিছনের লোকটা অনবরত ঠেলছে। আমি মুখ ঘুরিয়ে বলি, ‘ঠেলছেন কেন? স্থির হয়ে দাঁড়ান।’ ‘আপনি অলকদা না?’ ‘কে আপনি?’ ‘চিনতে পারছেন না স্যার আমাকে? আমার বোন আপনার কাছে পড়তো। আমি টিউশন ফি দিয়ে আসতাম। জানেন স্যার আমার বোনটাকে শ্বশুর বাড়ির লোকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে।’ কষ্ট হচ্ছে। দারুণ যন্ত্রণা। তবু বললাম, ‘আপনি ভুল করছেন। আমি কোনদিন ছাত্র পড়াইনি?’ ‘কি আশ্চার্য আপনি কৃষ্ণমুরারী অঞ্চলে থাকতেন না? ১৬ নং লাহা বাড়িতে?’ আমি কঠিন গলায় বললাম, ‘না।’
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register