মেহফিল এ কিসসা নুসরাত রীপা
ওরা
কোথায় যাচ্ছো?
আফসারের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে ঠোঁটের লিপস্টিকটা আয়না দেখে আরেকবার ঠিক করে নেয় লাইজু। তারপর স্বামীর দিকে ঘুরে লিপস্টিক এর মুখ লাগাতে লাগাতে বলে, আর বোলো না, আমার এক বান্ধবী হাসবেন্ড এর সাথে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়েছে। এখন আমার বাসায় উঠতে চায়। আমি ওকে একটা রেস্টুরেন্ট এ বসতে বলেছি--
তুমি ওকে আনতে যাচ্ছো?
আরে না। খাল কেটে বাড়িতে কুমির ডেকে আনার মানুষ আমি না সোনা-- দুষ্টু হেসে বলে লাইজু। তারপর বলে, আমি ওকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ওর মা অথবা বোনের বাসায় পাঠাবো। বান্ধবী আমার অনেক সুন্দরি। পরে আমার স্বামীটিকে বাগিয়ে নেয় যদি!
লাইজুর এই কথা শুনে আফসার গাঢ় স্বরে বলে, যাকে একবার ভালোবেসেছি পৃথিবীর এমন কোনো শক্তি নেই মৃত্যু ছাড়া তার থেকে আমাকে দূরে সরাতে পারে। আফসারের আবেগ নিজের মধ্যে সংক্রামিত হওয়ার আগেই ঝট করে উঠে দাঁড়ায় লাইজু।
আমি আসছি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাই। - বলে পার্স টা তুলে নিয়ে দ্রুত ঘর ছাড়ে।
পেছনে আফসারের কন্ঠ শোনা যায়, সাবধানে যেও।
লিফট থেকে বেরিয়ে হাফ ছাড়ে। আফসারের সাথে একগাদা মিথ্যা কথা বলে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। কী বলতে কী বলে ফেলে সেই ভয় তো আছেই। কিন্তু মিথ্যা না বলেই বা উপায় কী। ইমরুলের কথা তো আর আফসার কে বলা যাবে না।
সামনেই একটা সিএনজি। লাইজু ওতেই উঠে পড়ে। হাতিরঝিল-বলে একটু গুছিয়ে বসে।
হাতিরঝিলেই অপেক্ষা করবে ইমরুল।
ঘড়ি দেখে লাইজু তিনটা চল্লিশ। পাঁচটার
মধ্যে পৌঁছাতে পারলে হয়। যা জ্যাম।
২)
ইমরুলের সাথে লাইজুর পরিচয়টা একদম অদ্ভুত উপায়ে। ফেসবুকে কে কাকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলো ভুলে গেছে। ফ্রেন্ড লিস্টে থাকার সুবাদে টুকটাক লাইক কমেন্ট হতো মাঝে সাঝে।
তো, একরাতে ঘুম আসছিলো না লাইজুর। আফসার ঢাকার বাইরে। শুয়ে শুয়ে মোবাইলে ফেসবুক স্ক্রল করছিলো । হঠাৎ মেসেঞ্জার এ একটা থাম্বস আপ!
তখন মাঝরাত পেরিয়েছে। এতো রাতে এটা আবার কে নক করলো মেসেঞ্জারে? কৌতূহলী হয়ে লাইজু লিখলো-হ্যালো।
ওপাশের উত্তর টাইপের অক্ষরে ভেসে এলো, কি, ঘুম নেই?
নেই তো। কিন্তু দেখছি আমি একা নই, আপনিও জেগে আছেন- লিখলো লাইজু।
ব্যস এভাবেই প্রাথমিক পরিচয়।
প্রথম দিনেই প্রায় দুঘন্টা চ্যাট করলো ওরা। একসময় ফজরের আজান পড়তেই ইমরুল বললো, ঘুমাবেন না আজ আর?
লাইজু হাসলো। ঘুম নেই যে।
আমার ফোন নম্বরটা দিলাম। সময় পেলে ফোন দিয়েন।
আচ্ছা।
আপনারটা---
এর দুইদিন পর এক দুপুরে, বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরে খেয়ে দেয়ে ঘুম দিচ্ছে। আগামীকাল ছুটি, পড়ার তাগাদা নেই। লাইজু একা একা ড্রইং রুমে বসে টিভির রিমোট টিপছিলো। হঠাৎ ইমরুলের কথা মনে পড়লো। চ্যাট করতে বেশ লাগে লোকটার সাথে। ফোন নম্বর দিয়েছিলো। লাইজুর টা দেয়া হয়নি। একবার ফোনের সুবাদে নিজের নম্বরটাও দেয়া হয়ে যাবে ভেবে ইমরুলের নম্বরে ফোন করলো লাইজু।
কী ব্যাপার! ভুলেই গেলেন মনে হচ্ছে।
মোটেই না। ব্যস্ততা।
আমার চেয়েও বেশি?---
আপনার তো ঘরকন্যা---
আহা,এসব যেন কাজ নয়---
এভাবে কথা শুরুহলো সেই দুপুরে।
সবই অকাজের কথা। একদম অকপটে বহুদিনের চেনা মানুষের মতো দুজন দুজনের জীবনের টুকরো টুকরো অনেক গল্প শেয়ার করতে করতে সন্ধ্যা নেমে এলে ইমরুল ফোন রাখলো। বাসা থেকে রোজকার মতো বউ ফোন দিয়েছে, একটা পার্টিতে যাওয়ার আছে সেটা মনে করিয়ে দিতে।
আর তখন লাইজুর ও মনে পড়লো আজ সন্ধ্যায় চায়ের সাথে বেগুনি খাবার বায়না রেখে গেছে আফসার।
লাইজুর স্বামী আফসার অসম্ভব ভালো মানুষ। বিয়ের পর এতোগুলো বছর পেরিয়ে গেছে অথচ লাইজুর সাথে কোনোদিন উঁচু গলায় কথা বলেছে বলে মনে পড়ে না লাইজুর।
এমন একজন মানুষকে ভালো না বেসে পারা যায় না।
স্বামী সংসার নিয়ে সুখি লাইজুর জীবনের এইক্ষণে একটা দখিন হাওয়া হয়ে এসেছে ইমরুল।
৩)
হাতিরঝিলে দাঁড়িয়ে আছে ইমরুল।গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। জীবনে পরিশ্রম ছাড়া আর কোনো বিষয়ই বোঝে না সে।সেই ইমরুল ফেসবুকে লাইজুর সাথে পরিচিত হওয়ার পর যেন জীবনের এক অন্য রঙ খুঁজে পেলো। সেই রঙ কখনো রংধনু কখনো ধূসর!
ব্যক্তিগত জীবনে সুখী একজন মানুষ সে। স্ত্রী অনন্যা আসলেই অনন্যা। ইমরুলের যা কিছু অর্জন বলতে গেলে সবটুকুর পেছনেই অনন্যার ভালোবাসা আর প্রেরণা গ্রোথিত। অথচ কী আশ্চর্য, লাইজুর সাথে পরিচয় হবার পর একদিন কথা না হলে, একদিন চ্যাট না হলে কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভূত হয় বুকের গভীরে তার কারণ ইমরুল জানে না।
লাইজুও একদিন এমনটাই বলেছিলো। বলেছিলো, এটা কী হলো বলোতো ইমু! আমরা প্রেমিক প্রেমিকা নই। দুজনেরই সংসার আছে, সন্তান আছে। আমাদের দুজনেরই জীবন সঙ্গী ভালো। শুধু ভালো বললে ভুল হবে, তারা ফেরেশতা তূল্য তা সত্ত্বেও তোমার ফোন আমাকে এভাবে টানে কেন? কেন এতো হাহাকার বোধ হয় একদিন তোমার সাড়া না পেলে?
লাইজুর কথাগুলো ইমরুলের ক্ষেত্রেও সত্যি। আর ওরা দু'জনেই বুঝেছিলো এ কষ্টের কোনো সমাধান নেই। তাইতো ইমরুল লাইজুকে বলেছিলো, যতো কষ্টই হোক আর আমি ডাকবো না তোমায়। তুমিও ডাকবেনা আমায়।
কিন্তু পারেনি লাইজু। গত একসপ্তাহ প্রাণপনে চেষ্টা করেছে স্বামী সন্তান সংসারে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে। ইমরুল ও কাজের মধ্যে ডুবে থেকেছে অনুক্ষণ।
কিন্তু গতকাল লাইজু ফোন দিয়েছে,দেখা করতে চায়।এক সাথে বসে একটু গল্প করা ,ব্যস।
ইমরুল যেন অপেক্ষাতেই ছিলো যোগা যোগ না করার প্রতিজ্ঞাটা ভাঙার। লাইজুর ফোন পেতেই মনে হয় জৈষ্ঠ্যের তীব্র তাপদাহে একঝলক বাসন্তী হাওয়া বয়ে গেলো!
৪)
সি এনজি থেকে নেমে মৃদু পায়ে হেঁটে আসে লাইজু। প্রথম দিনের মতো আজ কোনো অস্থিরতা নেই। বরং একটু দ্বিধা যেন জড়িয়ে আসে পায়ে।
পাশাপাশি চুপচাপ হাঁটে দুইজনে। লাইজুকে অনেক সুন্দর লাগছে- কথাটা কেন যেন সহজ ভাবে বলতে পারে না ইমরুল। অতপর দুইজনে গিয়ে বসে একটা ছোট্ট চা দোকানে।
ইমরুলের সাথে কাটানো অনেক সময় , অনেক কথা মনে পড়ছে লাইজুর। মনে পড়ছে অনেক কথা ইমরুলেরও।
এই যে দেখা হবার, কথা বলার আকর্ষণ,এই যে ভালো লাগা-এটা কি প্রেম?যদি প্রেম হয় তবে এর শেষ কোথায়? পরিণতি কী?--- লাইজুর জানা নাই। জানা নেই ইমরুলেরও।
মুখোমুখি বসে আছে দু'জন। অনেক কথা, তবু বলার মতো কথা খু্ঁজে পাচ্ছে না কেউ!
(এই গল্পের কাহিনী ও চরিত্রসমূহ সম্পূর্ণ কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কারো সাথে মিলে গেলে লেখক দায়ী নয়।)
0 Comments.