Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে পাপিয়া ভট্টাচার্য (পর্ব - ৭)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে পাপিয়া ভট্টাচার্য (পর্ব - ৭)

আলোধুলোর দিন - ৭

আমার বাবার বাড়ি গ্রামে আর মা কলকাতার, ফলে ছোট থেকেই মিলিজুলি এক সংস্কৃতির ভেতর বাস ছিল আমাদের, জীবনযাত্রাতেও তার ছাপ পড়েছিল গভীরভাবে। সব কিছুতে প্রবল উৎসাহী আমার বাবার কল্যাণে সাঁতার থেকে সাইকেল সবই শিখে গেছলাম ছোটবেলাতেই, কিন্তু বন্ধুরা যখন ছুটির দিনে পুকুরে নেমে তোলপাড় করে ফেলত জল, আমাদের করুণ মুখে বাথরুমে স্নান করতে হত। আমার মনে হত ,মা নিজে জলে ভয় পায় বলেই হিংসে করে পুকুরে যেতে দেয় না । খেলাধুলোতেও তাই। এক্কা দোক্কা,কাবাডি থেকে বউ বসন্ত দিয়ে শুরু, তার মধ্যেই ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেট চলে আসত মামা মাসীদের কাছ থেকে। দাদার জন্যে কাঠের ক্রিকেট ব্যাট এসে পাড়ার আরো কিছু ব্যাট আসার পথ প্রশস্ত করল। যদিও সেই ব্যাটে দাদা হাত লাগাতে দিত না আমাকে, বল কুড়োনোর কাজটা ছাড়া। অবশ্য নেট টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টনের চেয়ে কাবাডি বা হুশ হুশ নামের এক অদ্ভুত খেলার মধ্যে যে দুরন্তপনা ছিল ,সেটাই তখন বেশি উপভোগ করতাম। মাত্র এক বছরে মাতৃহীন আমার ছোটমামা ছুটিছাটায় চলে আসতো দিদির বাড়ি। মামা ভাগনের ভাব ছিল যেমন ,তেমনি ওই একটা ব্যাট নিয়ে বাউন্ডারি না আউট, এসব গোলমালে প্রায়ই ঝগড়াও বাঁধত। ছোটমামা রাগ করে বাড়ি চলে যাবে বলে বেরিয়ে যাচ্ছে আর আমরা পেছন পেছন ছুটছি ,যেও না ছোটমামা ,বাবা কিন্তু বকবে । ছোটমামা বীরবিক্রমে ঘাড় নেড়ে বলছে, ওহ্ ,ওর বাবাকে যেন কত ভয় করি ! তারপর সত্যি সত্যি বাবাকে আসতে দেখলেই মামা সহ দুদ্দাড় করে সবাই মিলে বাড়িতে ঢুকে পড়ছি ,এসব ছিল রোজকার ব্যাপার। পুজোর সময় বেশিরভাগই দাদা আর আমার কাটত সিমলা স্ট্রিটের মাসিমণির বাড়িতে। ওদের বাড়ির বিখ্যাত জোড়া শিবমন্দির, যেখানে স্বামী বিবেকানন্দ ছেলেবেলায় মায়ের সংগে আসতেন পুজো দিতে, সেখানে মূল মণ্ডপ শুরু হত। বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাবের সেই পুজোয় পুচকে ভলেন্টিয়ারের ব্যাচ পরে 'এই যে এদিকে লেডিস'ও করেছি। একবার উত্তমকুমার এলেন ওখানে পুজো উদ্বোধন করতে, তাঁর ছেলে গৌতমের ওই রাস্তার মোড়েই ' আইভি কোং' নামে ওষুধের দোকান ছিল। তো মারাত্মক ভিড়ের চাপে মাঝরাত অবধি নাকি তাঁর গাড়ি ফিরে যাচ্ছিল বারবার। প্রায় ভোররাতেই বোধহয়, ঘুমন্ত আমাদের ডেকে তুলে মাসিমণি বলল, উত্তমকুমার এসেছেন। প্যান্ডেলের পেছনের পর্দা সরিয়ে কে একজন উঁচু করে তুলে ধরেছিল আমাকে, ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবীর নিখুঁত বাঙালীয়ানা আর সেই বিখ্যাত হাসির সংগে কপালের ওপর চুলের ঘূর্ণি মনে আছে শুধু। তখন আমরা সুচিত্রা উত্তম জানতাম না, 'আমি সুভাষ বলছি' ধরণের দু একটি ছাড়া সিনেমাই দেখিনি কোনও। স্কুল জীবনের শেষ দিকে অবশ্য সব ছুটির দিনে আমি আর প্রায় সমবয়সী মাসতুতো বোন মিলে রাধা, রূপবানী ইত্যাদি হলে গেছি বহুবার। ওষুধ কেনার ছুতো করে আইভি কোং এ গিয়ে উত্তম পুত্রকে দেখে হতাশ হয়েছিলাম খুব, মনে আছে। সেই বোন হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে একদম অল্পবয়সে চলে গেল। মাসিমণিদের সেই বাড়িগুলোও আর নেই। বেলুড় মঠ অধিগ্রহণ করে স্বামীজির সংগ্রহশালা নির্মাণ করেছে। বিবেকানন্দ রোড দিয়ে যাবার সময় এখনও বুক খালি করে শ্বাস পড়ে। বোন ছিল বেথুনের ছাত্রী। সে আর আমি বেথুন,হেদোর চত্বরে বসে মন খুলে আড্ডা দিতাম ! মা আর মাসিমণিদের মতো আমরা ভাইবোনেরাও বরাবরই বইয়ের পোকা ছিলাম। লাইব্রেরি থেকে মাসিমণির জন্য বই পালটে এনে হেদোর বেঞ্চিতে বসে দুজনেই একসংগে হুমড়ি খেয়ে পড়ছি মৈত্রেয়ী দেবীর 'ন হন্যতে'। প্রেম বিচ্ছেদ এসবের সংগে তখন সদ্য পরিচয় হচ্ছে, মির্চার বিদায় পর্ব নিয়ে দুই কিশোরী তাই খুব বিষণ্ণ। সামনেই বাচ্চারা লাফালাফি করছে সুইমিং পুলের জলে, চেনা ফুচকাওয়ালা ডেকে গেল ,আমরা চুপ করে বসেই আছি। দেরি হলে বকুনি খাব বুঝেও বাড়ি ফেরার তাড়া নেই সেদিন।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register