কেমন ছিলেন অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যারা? (তাঁদের স্বপ্নের স্বাধীনতা কেমন ছিলো)
অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা বলতে বুঝি ব্রিটিশ ভারতের সেইসব বীরাঙ্গনাদের যাঁরা বিপ্লববাদে দীক্ষিত হয়ে পুরুষদের পাশাপাশি সংগ্রামে ব্রতী হয়ে প্রত্যক্ষভাবে সংগ্রামসূচিতে অংশগ্রহণ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনদান করেছিলেন। এইসব বিপ্লবী নারীদের লক্ষ্য ছিলো: আর পরাধীনতার গ্লানিতে বেঁচে থাকা নয়, ইংরেজদের মত বেনিয়াদের অধীনতা থেকে দেশকে যেভাবে হোক মুক্ত করা। তাঁদের স্বপ্ন ছিলো: বিদেশী প্রভাবমুক্ত একটি বৈষম্যহীন অর্থাৎ যেখানে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলে সমান অধিকার ভোগ করবেন, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখে দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ পাবেন- এমন একটি শোষণহীন সমাজবিশিষ্ট স্বাধীন সার্বভৌম গনতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠন করা। এর অন্তর্নিহিত অর্থ আরো বিস্তৃত- যেমন: ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক সাহসী নেত্রী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্বপ্নের স্বাধীনতা ছিলো এমন একটি দেশ গঠন, যেখানে লিঙ্গ বৈষম্য থাকবেনা। আরো একজন বিপ্লবী নেত্রী- যাঁকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘অগ্নিকন্যা’- নামে অভিহিত করেন- সেই সর্বজনবিদিত বিপ্লবী নেত্রী কল্পনা দত্তের স্বপ্নের স্বাধীনতা ছিল এমন একটি দেশ গঠিত হবে যেখানে কোনো ভেদাভেদ থাকবেনা— সবাই মিলেমিশে থাকতে পারবে। প্রকৃত বিপ্লবী মানসপটে একটি স্বাধীন দেশের কল্পচিত্র আঁকা শুধু দেশের স্বাধীনতা অর্জনেই থেমে থাকতে পারে না— তাঁরা কেবল স্বাধীনতার জন্যই সংগ্রাম করেননি। তাঁরা চেয়েছিলেন ভারতবাসীর একাধারে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা অর্জন ও মুক্তিও। তাঁরা চেয়েছিলেন এমন একটি সমাজ ও তার প্রগতি যেখানে নারীরাও পুরুষের পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যযুক্ত অবদান রাখতে পারবে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটাতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ও আত্মত্যাগ করেছিলেন বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বহু বিপ্লবী নারী। স্বল্প পরিসরে সকলের নাম ও কর্মকাণ্ড উল্লেখ করা সম্ভব নয়, তবু কয়েকজনের কথা না বললেই নয়। যেমন:
কল্পনা দত্ত (১৯১৩-১৯৯৫) চট্টগ্রাম বিপ্লবের একজন অন্যতম বিপ্লবী নেত্রী। অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। শহীদ ক্ষুদিরাম এবং বিপ্লবী কানাইলাল দত্তের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বেথুন কলেজ-এ গড়ে ওঠা ছাত্রী সংঘে যোগ দেন। বিপ্লবের পথেই মাস্টারদা সূর্য সেনের সাথে দেখা, তারপর মাস্টারদার প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মিতে (চট্টগ্রাম শাখায়) যোগদান করেন। তার বিপ্লবী মনোভাবের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে ‘অগ্নিকন্যা’ বলেছেন। ১৯৩১ সালে সূর্য সেন, কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে চট্টগ্রামের ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দেন। নির্দিষ্ট দিনের এক সপ্তাহ আগে পুরুষের ছদ্মবেশে একটি সমীক্ষা করতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েন ও গ্রেফতার হন। জেলে বসে তিনি অপারেশন পাহাড়তলী এবং বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মহত্যার খবর শোনেন। এরপর জামিনে মুক্তি পেলেও চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার: (১৯১১-১৯৩২), বেথুন কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক হয়ে শিক্ষকতায় আসেন, অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মাস্টারদার নেতৃত্বে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে অগ্নিসংযোগ ও সশস্ত্র আক্রমণের সময় গ্রেফতার এড়াতে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন। “বাংলার প্রথম নারী শহীদ” তিনিই।
মাতঙ্গিনী হাজরা (১৮৭০-১৯৪২): তমলুকের অদূরে আলিনান গ্রামে (ডাকঘর: হোগলা) এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম। দারিদ্র্যের কারণে প্রথাগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত মাতঙ্গিনী মাত্র আঠারো বছর বয়সেই নিঃসন্তান অবস্থায় বিধবা হয়েছিলেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রত্যক্ষভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেন। সেই সময়ে তিনি লবণ আইন অমান্য করে কারাবরণ করেন ও মুক্তিও পান। কিন্তু চৌকিদারি কর মকুবের দাবিতে প্রতিবাদ চালিয়ে গেলে আবার তিনি দীর্ঘ প্রায় ছ’মাসের জন্য কারারুদ্ধ হন। মুক্তিলাভের পর তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্যপদ লাভ করেন এবং নিজের হাতে চরকা কেটে খাদি কাপড় বানাতেও শুরু করেন। গান্ধীবাদি নেত্রী ‘গান্ধীবুড়ি’- নামে খ্যাত হন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে একবার পুলিশের লাঠিচার্জের আহত হন। এরপর ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের মুখপত্র বিপ্লবী পত্রিকার বর্ণনা অনুযায়ী, ফৌজদারি আদালত ভবনের উত্তর দিক থেকে একটি মিছিলের নেতৃত্ব দেবার সময় পুলিশ গুলি চালালে তিনি অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের পিছনে রেখে নিজেই এগিয়ে যান। বারংবার গুলিবর্ষণে জাতীয় কংগ্রেসের পতাকাটি মুঠোর মধ্যে শক্ত করে উঁচিয়ে ধরে বন্দেমাতরম ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বাসন্তী দেবী (১৮৮০-১৯৭৪): উনার পরিচয়- উনি শুধু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সুযোগ্যা সহধর্মিনীই নন, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদান যথেষ্ট। তিনি অসহযোগ আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। স্বদেশী আন্দোলনের কার্যক্রম অনুসারে ১৯২১ সালে কোলকাতায় খাদি বিক্রী করতে গিয়ে গ্রেফতার হন। তারপরেও তাঁর কর্মময় জীবন থেমে থাকেনি। ‘নারী কর্ম মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করে নারীদের প্রশিক্ষণ দেন। ১৯২৬ সালে একমাত্র পুত্র চিররঞ্জনের মৃত্যুর পর রাজনৈতিক জীবন থেকে অবসর নেন। তিনি ‘বাংলার কথা’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ১৯৭৩ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত হন।
কল্যাণী দাস (১৯০৭–১৯৮৩) বিপ্লবী ও সাহিত্যিক। ছাত্রী সংঘের সদস্যা। ১৯৩০ সালে গভর্নরের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেন, ফলে গ্রেফতারও হন। ‘Bengal Speaks’ গ্রন্থের সম্পাদক। বইটি তাঁর বোন বিপ্লবী বীণা দাসকে উৎসর্গ করেন।
ভাবিনী মাহাতো (প্রায় ১৯২৫–২০১৪) পুরুলিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামী। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, বিপ্লবীদের খাদ্য ও অর্থ সহায়তা প্রদান করেন। বাংলা ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
বেলা মিত্র (১৯২০–১৯৫২): নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভাইঝি। আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসির রাণী রেজিমেন্টের সদস্যা। স্বাধীনতার পর সমাজসেবায় যুক্ত ছিলেন।
আশালতা সেন (১৮৯৪–১৯৮৬): বিপ্লবী, কবি ও সমাজকর্মী। ১৯০৫ সালে স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করেন। ‘গান্ধারিয়া মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করে নারীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ প্রচার করেন।
নির্মলনলিনী দেবী: তিনি নদিয়ার সত্যাগ্রহী। আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। সরকারি চাকুরীর বিরোধিতা করে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে আলাদা বসবাস শুরু করেন। কারাবাস ভোগ করেন।
চামেলী গুপ্ত: নারী সত্যাগ্রহ সমিতির সদস্যা। কলকাতায় বিলিতি বস্ত্রের বিরুদ্ধে পিকেটিং করেন। গর্ভবতী অবস্থায় গ্রেফতার হন। জেলে সন্তান প্রসব করেন এবং পরবর্তীতে দুজনেই মারা যান।
কুসুম বাগদী: মেদিনীপুরের সত্যাগ্রহী। দশ মাসের শিশুকে রেখে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। বন্ড লিখে মুক্তি নিতে অস্বীকার করেন।
সৌদামিনী পাহাড়ী: ইনি মেদিনীপুরের আন্দোলনকারী। ১৯৩২ সালে বাগবাজারে সভা করতে গেলে পুলিশের লাঠিচার্জের শিকার হন। দেশবাসীকে দেশীয় পণ্য ব্যবহারের আহ্বান জানান।
ফুলবাহার বিবি: ঢাকার বিক্রমপুরের সংগ্রামী। কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। গ্রেফতার হয়ে ছয় মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন।
বেগম রোকেয়া (১৮৮০–১৯৩২): মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত। ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর লেখা ‘অবরোধবাসিনী’ গ্রন্থে নারীদের অবস্থা তুলে ধরেন।
বীণা দাস (১৯১১–১৯৮৬): ইনি একাধারে বিপ্লবী ও শিক্ষিকা। ১৯৩২ সালে কলকাতায় গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করার চেষ্টা করেন। ফলে গ্রেফতার হন। কারাবাস ভোগ করেন।
কমলা দাশগুপ্ত (১৯০৭–২০০০): ইনি বিপ্লবী ও লেখিকা। যুগান্তর দলের সদস্যা। বিপ্লবীদের জন্য বোমা ও অস্ত্র সরবরাহ করতেন। গ্রেফতার হয়ে কারাবাস ভোগ করেন। পরে কংগ্রেসে যোগ দেন এবং সমাজসেবায় যুক্ত হন।
শশীবালা দেবী (১৮৮৬–?): ইনি রাজশাহীর রাজনৈতিক নেত্রী। অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ। চারবার কারাবাস ভোগ করেন। বেঙ্গল প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্যা ছিলেন।
রানী শিরোমণি (১৭২৮–১৮১২): ইনি কর্ণগড়ের রানি। চুয়াড় বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।
লাবণ্যপ্রভা ঘোষ (১৮৯৭–২০০৩): পুরুলিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামী। ইনি স্বাধীনতাসংক্রান্ত বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ। পুরুলিয়া থেকে প্রথম মহিলা বিধায়ক নির্বাচিত হন।
ননীবালা দেবী: ইনি বিপ্লবীদের সহায়তা করতেন। গ্রেফতার হয়ে কারাবাস ভোগ করেন।
দুকারি বালা দেবী: বিপিন বিহারী গাঙ্গুলীর প্রশিক্ষণে প্রথম মহিলা বিপ্লবী। রড্ডা অস্ত্র লুটের ঘটনায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁর বাড়ি থেকে সাতটি মাউজার রাইফেল, ১,১০০টি কার্তুজ ও বিপ্লবী সাহিত্য উদ্ধার হয়। গ্রেফতার হয়ে দুই বছর কারাবাস ভোগ করেন।
বনলতা সেন: ইনি ফরিদপুর জেলার বিপ্লবী। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সীমিত, তবে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন।
পারুল মুখার্জী: ইনি অনুশীলন সমিতির সদস্যা ছিলেন। টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার হন। হাওড়া জেলে কঠোর নির্যাতনের শিকার হন। একাধিকবার কারাবাস ভোগ করেন।
সুনীতি চৌধুরী: ইনি কুমিল্লার বিপ্লবী। ১৯৩১ সালে শান্তি ঘোষ (১৯১৬-১৯৮৯)-এর সঙ্গে একসাথে কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করেন। গ্রেফতার হয়ে কারাবাস ভোগ করেন।
লতিকা ঘোষ: ইনি একজন অক্সফোর্ড শিক্ষিত সমাজসেবিকা। ১৯২৮ সালে চট্টগ্রামে ‘মহিলা রাষ্ট্রীয় সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন। সুভাষ চন্দ্র বসুর আহ্বানে কংগ্রেস অধিবেশনে মহিলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন।
সত্যবতী দেবী: ইনি দিল্লীর সমাজকর্মী। কংগ্রেস মহিলা সমাজ ও দেশ সেবিকা দল প্রতিষ্ঠা করেন। লবণ আইন ভঙ্গ করে গ্রেফতার হন। জেলে অসুস্থ অবস্থায়ও রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকেননি।
রামাদেবী চৌধুরী: ইনি ওড়িশার সমাজসেবিকা। গান্ধীজী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অসহযোগ ও লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। একাধিকবার গ্রেফতার হন।
প্রবনলিনী ভাণ্ডারী: ইনি কংগ্রেস কর্মী ও সমাজসেবিকা। ১৯৩০ সালে লবণ আইন ভঙ্গ করেন। ১৯৩২ ও ১৯৪২ সালে অসহযোগ ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেন।
কমলা দাশগুপ্ত: ইনি বিপ্লবী ও লেখিকা। যুগান্তর দলের সদস্যা হিসেবে বোমা পরিবহন ও বিপ্লবীদের সহায়তা করেন। বীণা দাসকে অস্ত্র সরবরাহ করেন। গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। পরবর্তীতে নারী কল্যাণ ও স্বনির্ভরতা নিয়ে কাজ করেন।
ভাবিনী মাহাতো: ইনি পুরুলিয়ার সমাজকর্মী ও বিপ্লবী সহায়ক। বিপ্লবীদের খাদ্য ও আশ্রয় প্রদান করেন। ১৯৫৬ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে গ্রেফতার হন। ১৯৭২ সালে ‘তাম্রপত্র’ সম্মানে ভূষিত হন।
আভা দে: ইনি ছাত্রীসংঘের সদস্যা ও ক্রীড়াবিদ। ১৯৩০ সালে নারী সত্যাগ্রহ সমিতিতে যোগ দেন। বেআইনি শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে গ্রেফতার হন। ১৯৩৮ সালে বেরিবেরি রোগে মারা যান।
ননীবালা দেবী: প্রথম মহিলা রাজবন্দী। আসলে ইনি বিপ্লবী ছিলেন। পরিস্থিতির শিকারে রাজবন্দী হন।
বাংলা ছাড়াও ভারতের অন্যান্য রাজ্যের কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তালিকা
রানি লক্ষ্মীবাই: ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম মুখ্য নেতৃত্বে ছিলেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ঝাঁসির স্বাধীনতা রক্ষা করেন। তাঁর বীরত্ব আজও প্রেরণার উৎস।
সারোজিনী নাইডু: ভারতের নাইটিঙ্গেল” নামে খ্যাত কবি ও রাজনীতিবিদ। ১৯২৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি হন। খিলাফত ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য- স্বাধীনতার পর উত্তরপ্রদেশের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন।
ম্যাডাম ভিকাজি কামা: বিদেশে ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনকারী স্বাধীনতাকামী আধুনিকমনস্ক নারী। ১৯০৭ সালে জার্মানির আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন।
বেগম হজরত মহল: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে আওধের নেতৃত্বদানকারী। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লক্ষ্ণৌ-এর স্বাধীনতা রক্ষা করেন।
অরুণা আসফ আলি: “ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বৃদ্ধা” নামে পরিচিত। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় মুম্বাইয়ের গওয়ালিয়া ট্যাংক ময়দানে কংগ্রেসের পতাকা উত্তোলন করেন।
উষা মেহতা: গোপন কংগ্রেস রেডিওর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় গোপনে রেডিও সম্প্রচার মাধ্যমে ব্রিটিশবিরোধী প্রচার চালান।
কস্তুরবা গান্ধী: মহাত্মা গান্ধীর পত্নী ও সহযোদ্ধা। চম্পারণ, রাজকোট ও অন্যান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
অ্যানি বেসান্ত: ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেত্রী। ১৯১৬ সালে অল ইন্ডিয়া হোম রুল লীগ প্রতিষ্ঠা করেন।
কমলা নেহরু: জওহরলাল নেহরুর পত্নী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেন।
বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত: ভারতের প্রথম মহিলা ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি। অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও স্বাধীনতার পর আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।
লক্ষ্মী সায়গল: ইনি ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী নামে পরিচিত, আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের কমান্ডার। সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন।
সুচেতা কৃপালনি: ভারতের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী (উত্তরপ্রদেশ)।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মিথুবেন পেটিট: দানশীল পরিবার থেকে আসা স্বাধীনতা সংগ্রামী। গান্ধীর ডান্ডি অভিযানে অংশগ্রহণ ও নারী অধিকার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
লক্ষ্মী ইন্দিরা পান্ডা: আজাদ হিন্দ ফৌজের কনিষ্ঠ সদস্যা। মাত্র ১৪ বছর বয়সে রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
আমরা আজ স্বাধীন ভারতের নাগরিক। সাধের সাধন স্বাধীনতা সাম্যে সফল হল কি না, মূল্যায়ন করলে কি দাঁড়ায় দেখি— মানুষের খুব সাধারণ গুণ হলো দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার। সে এক দিন ছিল, যখন লক্ষ্য একটাই- স্বাধীনতা। ব্রিটিশরা ভিন জাতি, ভারতীয়দের পদদলিত করেছে, চিহ্নিত শত্রু তারা। দিকে দিকে ক্ষুদ্র ব্যক্তি-স্বার্থ-চরিতার্থতায় হোক বা সমষ্টির কল্যাণার্থে হোক, সংঘটিত আন্দোলন বা অসংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ, বা বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ হোক- সবটাই স্বাধীনতা আন্দোলনের তকমা পেয়ে এক ব্রিটিশ বিরোধী এক ছত্রছায়ায় যুক্ত হয়েছে। ফলস্বরূপ দু’শো বছরের নিঠুর শাসনকাল মজবুত ব্রিটিশরাজ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। হলাম স্বাধীন। স্বস্তি এলো জীবনে। এবারে লক্ষ্য গেলো বদলে। দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার, শোষণ- এই প্রবৃত্তির নিরসন হবে কোথায়? ফলে জাতি ভাষা ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ জিইয়ে রাখা, বিভিন্ন বিষয়ে সংরক্ষণ, সেটা বাদ দিলে কার্যতঃ ধনী নির্ধনের পার্থক্য সাম্যের পরিপন্থী হয়ে দেখা দিল। স্বনির্ভরতা বিষয়টি বহুল প্রচারভিত্তিক। স্বাধীনতা লাভের পর ভারত কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, এবং স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করলেও সাধারণ মানুষের উত্তরণ এখনো তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরাঙ্গনাদের স্বপ্নের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার দায়িত্ব সকল ভারতবাসীর। একক প্রচেষ্টায় তা রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার।