সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে দীপশিখা দত্ত (পর্ব – ৪)

কাকাতুয়া বাড়ী
ছোটোজেঠু
কাকাতুয়া বাড়ীর সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন ছোটোজেঠু – শ্রী সুনীল কুমার ঘোষ। বয়সে খুব সম্ভবতঃ আমার বাবার চেয়ে সামান্যই বড়ো ছিলেন। রোগা পাতলা, দোহারা-চেহারা।একমাথা অবিন্যস্ত ঝাঁকড়া চুল। ছোটোজেঠুই ওই বাড়ীর একমাত্র সদস্য, যিনি প্যান্টশার্ট পরতেন। বাড়ীতে পরতেন খুব ঢোলা কোলবালিশের মতো চওড়া পা ওয়ালা সাদা, আকাশী আর চকোলেট রংএর পাজামা বদলে বদলে, তার সাথে গায়ে থাকতো সাদা হাতাওয়ালা ফুটোফুটো গেঞ্জি।
ছোটো জেঠুর থাকার আর শোবার ঘরটা ছিলো দোতলার সিড়ি দিয়ে উঠে বাঁদিকের একচিলতে জায়গায়। জায়গাটা ঠিক ঘর নয়,অথচ বারান্দাও নয়, সিড়ির পাশে পাঁচিল দেওয়া একটুখানি ঘেরা জায়গাই ছিলো ছোটোজেঠুর ঘর। আমাদের বাড়ীর ছাদ থেকে সোজাসুজি ছোটোজেঠুর শোবার ঘরের জানালাটা দেখা যেতো।ওই জানালার পাশে রাখা চৌকিতে বসে বা শুয়ে জেঠু আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন।জেঠুর কড়া নিষেধ ছিলো, উনি ঘুম থেকে না ওঠা পর্যন্ত ওপরে ওনার ঘরের সামনে যাওয়া যাবে না। ঘুম থেকে উঠেই অন্য মানুষ। আমি রবিবারে ছাদে জামা-কাপড় তুলতে গেলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতাম।
তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচাইতে শৌখিন আর আয়েসী ছিলেন ছোটোজেঠু। ওনার বিছানার পাশে এক সাইডে রাখা থাকতো একটা গ্রামোফোন আর একপাঁজা রেকর্ড। অন্যসাইডে অসংখ্য ম্যাগাজিন। মাথার কাছে রাখা থাকতো একটা ছোট ট্রানজিস্টর। ছুটির দিনে অনেক বেলা অবধি ঘুমোতেন ছোটজেঠু। উঠেই বারকয়েক চা খাওয়া চলতো। দিদু বা মেজজেঠু সকালে একটা কেটলীতে অনেকটা দুধ, চিনি দিয়ে কড়া করে চা বানিয়ে রাখতেন,আর ছুটির দিনে সারাদিন দুইভাই কয়লার উনুনে গরম করে করে সেই চা খেতেন।
সব ভাইদের আর মায়ের আলাদা আলাদা কাপ ছিলো, আমরা চিনতাম কার কোনটা কাপ! ছোটো জেঠু খুব সম্ভবতঃ এক্সাইড ব্যাটারীর অফিসে চাকরী করতেন। সম্ভবতঃ বলছি কারণ তখন আমাদের জীবন অনেক সহজ সরল ছিলো,বড়োরা কে কোথায় চাকরী করে তা জানতে চাওয়া, ধৃষ্টতা বলে মনে করা হতো, তাই তা সঠিক জানা সম্ভব ছিলো না। আর কাউকে জিজ্ঞাসা করার সাহসও ছিলো না।
সবার মুখে শুনেছি,ছোটো জেঠু প্রথম জীবনে চমৎকার বাঁশী বাজাতেন। অনেক ছোটবেলায় গভীর রাতে শুনতে পেতাম, জেঠু জানলায় বসে বাঁশী বাজাচ্ছে। অনেক ছোটো ছিলাম ঠিকই, তবে চাঁদনী রাতে করবীফুলের ম ম গন্ধের সাথে ছোটো জেঠুর বাঁশীর সুর ছোটো থেকেই এক ভালোলাগা বোধের জন্ম দিচ্ছিলো। মন আর কান বোধ হয় তখন থেকেই তৈরী হচ্ছিলো।ওই বাঁশী যারা শুনেছে, তারাও ভেসে যেতো এক অন্য জগতে। পরে অবশ্য শারীরিক কারণে আর বাঁশী বাজাতেন না,জেঠু।
ছুটির দিনে,বারবার চা খেতেন আর হৈচৈ করে মাতিয়ে রাখতেন সকলকে। ফটো তোলার নেশাও ছিলো ছোটজেঠুর।একটা শাটার টেপা কোডাক ক্যামেরা ছিলো ওনার, ছুটির দিনে সেটা দিয়ে আমাদের অনেক ছবি তুলে দিতেন। ছবি ওয়াশ করে দোকান থেকে আনার পর আমাদের ছবি আমাদেরকে দিয়ে দিতেন। সময়ের গতিপথের পরিবর্তনে সেসব ছবি আর নেই।
আমার ছোটো পিসীর কাছে শুনেছিলাম প্রথম জীবনে উনি নাকি পাশের বাড়ীর কোনো সুন্দরী মেয়েকে খুব পছন্দ করতেন, কিন্তু কোনোদিন সাহস করে কাউকে বলতে পারেননি।আর মাও ছেলেরা পর হয়ে যাবে বলে কখনো ছেলেদের বিয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপনই করেনি। বহুবছর বাদে বিয়ের বয়স প্রায় শেষ হবার মুখে হাসিপিসীমা একরকম জোর করেই ছোটজেঠুর বিয়ের ব্যবস্থা করাতে মনে হয়, মনে মনে জেঠু একটু বেশিই খুশী হয়ে ছিলেন।
প্রতিদিন দশটার মধ্যে খাওয়া দাওয়া সেরে অফিসে বেরিয়ে যেতেন জেঠু। ছুটির দিনে মেতে থাকতেন আমাদের নিয়ে। এই পরিবারটিকে আমরা কোনোদিন পাড়ার কারো সঙ্গে হৃদ্যতা করতে দেখিনি,তেমন কেউ আসা যাওয়াও করতো না ওবাড়ীতে। অথচ আমাদের সাথে এরকম সম্পর্ক দেখে অনেকেরই মনে অনেক জিজ্ঞাসা ছিলো।
একদম ছোটোবেলায় যখন দিদুর হাতে সংসার ছিলো, তখন থেকেই ওবাড়ীতে আমাদের খাওয়া দাওয়া চলতো। আমার পরের বোন টিংকু, আমার থেকে চার বছরের ছোটো ছিলো, আমরা দুজনেই একসাথে ওখানে যেতাম। আমাদের দুজনকেই দিদু লুচি পরোটা দিলে,ওরটা আবার ছোটো ছোটো টুকরো করে থালায় সাজিয়ে দিতেন দিদু,আর ছোটো জেঠু দাঁড়িয়ে আমাদের খাওয়া দেখতেন। একটু বড়ো হতেই ছোটোজেঠুর নির্দেশ হলো ছুটির দিনে আমাদের দুবোনের যেকোনো একজন দুপুরে কাকাতুয়া বাড়ীতে খাবে। যেদিন যার পালা থাকতো সে তড়িঘড়ি স্নান টান সেরে এগারোটার মধ্যে রেডী হয়ে ওইবাড়ীতে দৌড়! রান্নাঘরের মেঝেতে একটা বড়ো পিঁড়ি পেতে কি যত্ন করে আর সুন্দর করে যে, ওনারা তিনভাই অতিথি সেবা করাতেন, সে আর কি বলবো! একটা বড়ো থালায় অল্প একটু ভাত, সাথে গাওয়া ঘি, অনেক রকমারী ভাজা,ডাল, মাছ বা মাংস ছোট বাটিতে কি যত্ন সহকারে খাওয়াতেন! আমরা ছোটো বলে কাঁটাবিহীন মাছ, ঝালছাড়া নরম করে সেদ্ধ করা মাংস বানাতেন আমাদের জন্য। সত্যিকথা বলতে কি আমাদের বাড়ীতে, বাবা-মা দু’জনেই নিজেদের পড়াশোনা নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকতেন যে আমরা নিজেদের বাড়ীতে এতো পুতুপুতু করে বেড়েই উঠিনি।
আমাদের শৈশব সযত্নে লালিত হয়ে, ক্রমশঃ কৈশোরের পথে পাড়ি দিচ্ছিলো ওইবাড়ীর প্রিয় মানুষগুলোর স্নেহ, ভালোবাসা আর নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। ওনাদের ভালোবাসার উত্তাপে আমরা বেড়ে উঠছিলাম শরীরে ও মনে। শরীর তো বড় হচ্ছিলো প্রকৃতির নিয়মে, কিন্তু মন বাড়ছিলো জেঠুদের ভাবনার মননে। পূজোর আগে ছোটোজেঠু কিনে আনতেন ‘পূজোর গান’ নামে ম্যাগাজিনটা,নতুন গানের রেকর্ড, আমাদের কাছে বসিয়ে নিজেও শুনতেন। বেতারজগৎ,দেশ সব নিজে পড়ে আমাকে পড়তে দিতেন। ওনাদের গল্প শুনে অনেক ছোটোবেলাতেই আমাদের সামনে একটা অজানা ভালোবাসার জগৎ তৈরী হচ্ছিলো। আমাদের ওবাড়ীতে যাবার কোনো ধরাবাঁধা সময় ছিলো না। খুব ভোরে উঠে ফুল কুড়ানো থেকে শুরু করে সারাদিনে ফাঁক পেলেই একলাফে ওই বাড়ীতে, মাও জানতো কাকাতুয়া বাড়ী ছাড়া আমরা অন্য কোথাও যাবো না। ওইবাড়ীতে আমাদের সমবয়সী কেউ ছিলো না, তবুও এই অসমবয়সী মানুষগুলো নিজেদের শিক্ষা, স্নেহ, ভালোবাসা, আর মমতা দিয়ে এমন ভাবে বড়ো করে তুলছিলেন যে ওনাদের মনেই হতো না আমরা ছোটো আছি। ছোটো জেঠুর বন্ধু ছিলেন সেই সময়কার গায়ক অখিল বন্ধু । ওইটুকু বয়সে ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে আমাকে চেনাতেন পঙ্কজ মল্লিক,কে এল সায়গল, শচীন কর্তা, জগন্ময় মিত্র, বেগম আখতারকে। নির্মলা মিশ্র, ইলাবসু, হৈমন্তী শুক্লা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,শ্যামল মিত্র, মান্না দে, কিশোর কুমার, মহম্মদ রফিকে শুনতে শুনতে তৈরী হয়ে গেলো মন আর কান।
সেইসময় মায়েরাও অতো মানসিক জটিলতার মধ্যে সন্তানদের বড়ো করতেন না,আজো মনে পড়েনা ওই অসমবয়সী তিনজন পুরুষ মানুষের সঙ্গে গিয়ে যখন তখন গল্প করতে যাই জেনেও, কখনো আমার মা ঠাকুমার মনে হয়নি আমরা ওবাড়ীতে একমুহুর্তের জন্যও নিরাপত্তা হারাতে পারি!
সামনে বিয়ে শুনে বাড়ীঘর পরিস্কার করে চুনকাম করার কাজ শুরু হলো। কোডাক ক্যামেরা দিয়ে বাড়ীর প্রতিটি আনাচে কানাচের স্মৃতি গুলোকে বন্দী করে রাখছিলেন আমাদের শৈশবের দুর্লভ মুহূর্তগুলোকে! নীচের ছবিটিতে আমরা জেঠতুতো,খুড়তুতো ভাইবোনেরা- আমার মাসতুতো দিদি বুলাদিদির সঙ্গে, ছোটোজেঠুর ক্যামেরায় তোলা। বুলাদিদি সেসময় বনহুগলী সারদা মিশনের হোস্টেলে থেকে উঁচু ক্লাসে পড়তো আর কখনো সখনো ছুটিছাটায় আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতো। আমরা ওকেও টানতে টানতে ওবাড়ীতে যেতাম নির্দ্বিধায়। এটা ছিলো আমাদের অলিখিত অধিকার।
আমাদের মনে তো স্বপ্নের খৈ ফুটছে ছোটোজেঠুর বিয়েতে কি রকম আনন্দ করবো তা ভেবে ভেবে! আমার পড়াশুনাতেও তেমন মন নেই,ওবাড়ীতে গেলেই চলতো দিদুর সঙ্গে জল্পনা কল্পনা। এমনসময় সেবছর দুর্গাপূজোর আগ দিয়ে দুপুরে ছাদে জামা-কাপড় তুলতে গিয়ে, ছাদ থেকে দেখি কাকাতুয়া বাড়ীর সামনে বেশ ভীড়,একটা বড়ো রকম জটলা। ওইবাড়ীতে এতো লোক এসেছে, অথচ আমরা জানিনা,ভেবেই ভীষণই অভিমান হলো! ওই বাড়ীর সবকিছু জানার অধিকার মেনে আমাদের একার! ছাদ থেকে কাকে যেন জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হয়েছে গো ওখানে?”
কোনো উত্তর পেলাম না। একদৌড়ে নীচে গিয়ে শুকনো জামা-কাপড় গুলো খাটের ওপর ছুঁড়ে ফেলে, দৌড় দিলাম কাকাতুয়া বাড়ীর দিকে। বাবা গেটের সামনে আটকে দিলেন,”এখন ওবাড়ীতে যাবেনা।”
” কেন যাবো না শুনি? কি হচ্ছে ওখানে? যে এতো ভিড়!”
” তোমার এতো জানার দরকার নেই। ঘরে যাও।” মাকে চুপিচুপি কি বললেন, বাবা, শুনতে পেলাম না। শুধু বুঝলাম ভালো কিছু হচ্ছে না। চারদিকে একটা ফিসফিসানি শীতলতা।
ওদিকে বিকেল ঘনিয়ে আসছে,আরো দেরী হলে, চারদিকে অন্ধকার হয়ে গেলে ছাদ থেকেও কিছু দেখতে পাবোনা। আবারো ছুটে ছাদে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলাম,ওবাড়ীতে কি হয়েছে যদি জানা যায়! আস্তে আস্তে ওবাড়ীতে ভিড় আরো বাড়তে লাগলো, একসময় জেঠুদের মামাতো ভাই ডাক্তার ভোলানাথ সুর এলেন, যার কাছে বড়োজেঠু প্রায়ই যেতেন। এছাড়া পাড়ার ধন্বন্তরী ডঃ পোদ্দার তো আগে থেকেই ছিলেন! আমার সন্দেহ হলো, তাহলে কি কেউ অসুস্থ? আমার দিদুর কথাটাই সবার আগে মনে হলো। কিন্তু দিদুকে তো দেখতে পাচ্ছি ঘরের মধ্যে ঘোরাফেরা করছেন। তাহলে, দিদুর তো কিছু হয়নি, তবে কার কি হলো? জানলায় না দাঁড়ালে দিদু তো ডাকলেও শুনতে পাবে না।
এভাবেই অস্থিরতার মধ্যে ঘন্টা দুয়েক কাটার পর আমার ঠাকুমার কাছে জানতে পারলাম, ঘর রং হবার পর, দোতলার ছাদে কাঠের সিঁড়িতে (চওড়া মই) উঠে, ইলেকট্রিকের লাইন ঠিক করতে গিয়ে, ছোটজেঠু পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন,আর জ্ঞান ফেরেনি। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলো।
সন্ধ্যের মুখে বাবা এসে মাকে বললেন, “এবার সুনীলদাকে নিয়ে যাবো আমরা, ওদেরকে বলো, একবার দেখে আসুক ওদের ছোটজেঠুকে।”
আমি আর বোন দুজনেই খালি পায়ে দৌড়লাম- ওবাড়ীতে।সেই প্রথম কাছ থেকে প্রিয়জনের মৃত্যুকে দেখলাম। সেই প্রথম জানলাম ইন্টারনাল হেমারেজ কি হয়? তখন আমার ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেন।
একদম কাছ থেকে দেখলাম,কিভাবে মানুষ শেষবারের মতো ঘুমিয়ে পড়ে? যে ফুলের সাজে বিয়ে করতে যাবার কথা ছিলো জেঠুর, সেই ফুলের পাহাড়ের নীচে সুসজ্জিত হয়ে সবার কাঁধে চেপে, সিনেমার নায়কের মতো চলে গেলেন, ছোটজেঠু। পিছনে পড়ে রইলো, একরাশ সাদা খই আর অস্ফূট হরিধ্বনি,”বলো হরি! হরি বোল!”
ক্রমশ