কেমন ছিলেন অগ্নিযুগের কন্যারা ? তাঁদের স্বপ্নের স্বাধীনতা কেমন ছিল —
প্রথমেই যদি আমরা আলোচনা করি কোন সময়কালকে বলা হয় অগ্নিযুগ ? তবে দেখি এটি কোনো নির্দিষ্ট সাল বা সময় দিয়ে মাপা যায় না। বেশ কিছু সময় ধরে চেতনায় অগ্নিযোগ যেমন অগ্নি শক্তি নির্দেশিত চেতনা যোগ প্রবাহিত হয় মানুষের চেতনায় সে সময়কালকেই ধরা হয়।এটি একটি রূপক অর্থ।তবে এটি ভারতবর্ষে বিপ্লবের প্রতীক স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কালকে নির্দেশ করে।
যে সমস্ত অগ্নিকন্যারা ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহসী ও দৃঢ়তার সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁদের জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় ,নারীর স্থান সে সময় প্রধানতঃ ছিল অন্তঃপুরে, অনালকিত নারীদের জীবন মোটেই ফুল্লোকুসুমিত ছিল না, একে তো সার্বিক পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই ! অপর দিকে প্রবল প্রতাপশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই । যে আন্দোলনের রাশ প্রধানতঃ ছিল পুরুষের হাতে, আর এখানেই তাঁরা ব্যতিক্রমী অগ্নিকন্যা হয়ে রুখে ওঠেন। দুটি প্রবল চাপের দ্বায়িত্ব ন্যস্ত হয় তাঁদের কোমল স্কন্ধে। ঠিক যখন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে পুরুষের হাত ধরে আলোকপ্রাপ্তি ঘটছে নারীর চেতনায় সেই অগ্নিক্ষণে সময় যেন মেলে দিয়েছিল তার করতল, উঠে এলেন কিছু অগ্নিকন্যা যেমন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, রবীন্দ্র নামাঙ্কিত অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্ত,স্বর্ণকুমারী দেবী,সরলা দেবী, আশালতা সেন,সরোজিনী নাইডু, লীলা রায়, ননীবালা দেবী, বাসন্তী দেবী,দু কড়ি বালা, পটিয়া ধলঘাটের,সাবিত্রী দেবী প্রমুখ —।
অগ্নিকন্যারা মূলত ছিলেন বিপ্লবী দলের সদস্য , পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন আন্দোলনে সাথে, পুরুষ আন্দোলকারীদের পিছন থেকে সহায়তা করা, অস্ত্রশস্ত্র ও তথ্য, চিঠি পৌঁছে দেওয়া, তাঁদের গোপন আস্তানায় আশ্রয় দেওয়া, অর্থের যোগান দেওয়া , খাদ্য সরবরাহ ও সেবা শুশ্রূষার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন। প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্ত ছিলেন সশস্ত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত । স্বদেশী আন্দোলন চলাকালীন নীরবে বহু নারী চরকায় সুতো কাটার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন ও বিদেশী বস্ত্র পরিত্যাগ করেন । অপূর্ব এক আলোক শক্তি রূপে নারীর আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে। তাঁরা হয়তো প্রকাশ্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন নি, কিন্তু সেই শক্তি কিছু নারীকে ব্যতিক্রমী অগ্নিকন্যা রূপে আত্মপ্রকাশ করতে সাহায্য করে, তাই তাঁদের অবদানও অস্বীকার করার নয়।
ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাই সিপাহী বিদ্রোহের সময় যে আগুন জ্বালিয়েছিলেন ,সে আগুনে বহুবছর মন সেঁকে ছিলেন আপামর ভারতীয় নারীর হৃদয় , জন্ম নেয় এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ , যাঁরা ভারতমাতার শৃঙ্খল মোচনে নিজেদের উৎসর্গীকৃত করেন । তাঁদের স্বপ্নের স্বাধীনতা ছিল দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করার উদ্যেশ্যে আপামর ভারতবাসীর মনে স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করা থেকে অন্তরের ধিকি ধিকি জ্বলে ওঠা আগুন কে প্রজ্জ্বলিত আগুনে রূপান্তর করা। চেতনায় স্বাধীনতার বোধ নির্মাণ করা। ‘আজাদ হিন্দ বাহিনী ‘ র- নারী বাহিনীর ক্যাপ্টেন লক্ষী সায়গলের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে আজও। নারী আবহমান কাল ধরেই শক্তির প্রতীক, সর্বকালেই সেই শক্তিকে পূজিত করেছে মানুষ । তাই এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে প্রণাম জানাই সেই সব অগ্নিকন্যাদের। তাঁদের পায়ে অঞ্জলীর পুষ্প অর্পণ করে জানাই ‘ হে আগুনের মতো তেজস্বী কন্যারা, আজও যেন তোমাদের চেতনার শক্তির কাছে সেঁকে নিতে পারি হৃদয় , উদ্বুদ্ধ হই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, মৌলবাদের বিরুদ্ধে, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে।’