|| শাম্ভবী সংখ্যা ২০২১ || T3 শারদ সংখ্যায় দেবযানী ভট্টাচার্য

সাবেকি না থিম পুজো?

আকাশে বাতাসে অরুণ আলোর অঞ্জলি, পেঁজা তুলোর মতো মেঘের ভেলা উড়ে যাচ্ছে শরতের আকাশে।এসেছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব’শারদোৎসব’।কাশের ক্ষেতে উঠেছে শুভ হিল্লোল।শিউলি ঝরা শিশির ভেজা প্রভাতে আগমনীর সুর,’মা আসছেন’।এই উৎসব আনন্দ যজ্ঞে মেতে ওঠে আপামর বাঙালি সমাজ।বিকাশ ঘটে সৃষ্টিশীল সৃজনশীলতার।বাঙালি সংস্কৃতি,ঐতিহ্যের স্ফুরণ ঘটে সর্বত্র।দিকে দিকে এর সৌন্দর্য ময় উপস্থিতির প্রয়োগ চোখে পড়ে।সমস্যা দীর্ণ প্রাত্যহিকতার কালিমা মুক্ত হয়ে মনোজগত এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে জাগরিত হয়।আমরা বরণ করে নি মৃন্ময়ী ,শক্তিদায়িনী মা দুর্গা কে।তবে বদল এসেছে বাঙালি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।সেই পরিবর্তন চাক্ষুষ হয় পুজো প্রাঙ্গণেও।সাবেকি পুজো পরিবর্তীত হয়েছে থিম পুজোয়।বিতর্কের অবতারণা ঘটে সে ক্ষেত্রেও।

1985 থেকে সাবেকি পুজোর সাথে সাথে ব্যতিক্রমী কিছু পুজোয় এজটি বেসরকারি রং কোম্পানি শারদীয়া সম্মানের আয়োজন করে।তার হাত ধরে প্রতিযোগিতা ও আর্থিক পুরস্কারের প্রবেশ ঘটে পুজো প্রাঙ্গণে।রুচি ই দৃষ্টি নন্দনের ওপর জোর দেওয়া হয়।কোলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলা গুলিতে শুরু হয় নতুন রূপে দুর্গা পুজো।প্যান্ডেল এবং প্রতিমায় শিল্পীর ভাবনার উৎকর্ষতার ছোঁয়া পায়।এই পার্বণ হয়ে ওঠে বাণিজ্যের সঙ্গে শিল্পের মোড়ক।খুলে যায় নতুন উপার্জনের পথ। বাণিজ্যিক রূপের সহায়ক হতে শুরু হয় বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ,নারকেল মালা,পুঁথি,ভাঙা কাঁচের চুড়ি, প্লাস্টিকের বোতল,মাটির ভাঁড়,কাগজ,খড় -এই সমস্ত সামগ্রী র প্রয়োগ।কেরিয়ার গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন বিভিন্ন শিল্পী সম্প্রদায়।আমাদের বারোয়ারি পুজো গুলো সেজে ওঠে বিভিন্ন শিল্পের সাজে।কিন্তু কোথায় যেন এই বাণিজ্যিক রূপায়ণে হারিয়ে যেতে থাকে পুরাতনী ডাকের সাজের প্রতিমা বা আটচালার ঘরের উমার মায়াময় রূপটি।বাহ্যিক আড়ম্বরের ঠেলায় সনাতনী মায়ের অভয়া রূপটি হারিয়ে যেতে থাকে।পুজো মন্ডপ, আলোকসজ্জা, প্রতিমার গঠনের মধ্যে শুরু হয় প্রতিযোগিতার লড়াই, পুরস্কারের লড়াই।

সিপাহী বিদ্রোহ শেষ হলে শোভাবাজারের বাবু নবকৃষ্ণ দেব ঘটা করে পুজো করবেন মনস্থ করেন।জার্মানি থেকে ডাক যোগে আসে রুপোর তবক ।প্রতিমা সেজে ওঠেন এই সাজে।লোক মুখে এই সাজ হয়ে ওঠে ‘ডাকের সাজ’।পরবর্তী কালে তা বদলে আসে শোলা সজ্জা।সাবেকি প্রতিমা আমরা ডাকের সাজ ও শোলার সাজেই দেখতে অভ্যস্ত।পুজোর আসল সাজ ও আবেগ লুকিয়ে থাকে এই সাবেকি সাজেই,এ কথা অনেক শিল্পী মনে করেন।শিল্পী গোপালচন্দ্র একদা বলেছেন,”সাবেকি প্রতিমা অনেক বেশি জীবন্ত ,তার শিকড় ও অনেক গভীরে।থিম পুজো তো আসলে প্যান্ডেল পুজো।ওই প্রতিমা দেখে ভক্তি ভাব আসে না”।তবে এ কথা স্বীকার করতেই হয়, থিম পুজোর প্রচলন অনেক শিল্পীর জীবনে বাঁচার রসদ জুগিয়ে চলেছে।প্রচুর কর্মসংস্থান এর সুযোগ তৈরী হয়েছে।বিকল্প একটি কেরিয়ার তৈরিতে সাহায্য করেছে।যা এই উপমহাদেশের দরিদ্র জনগণকে স্বপ্ন দেখতে এবং পরিবর্তন এর পক্ষে রায় দিতে সাহায্য করেছে।আবার এ কথা সত্যি প্রচুর পুরাতন শোলা শিল্পী ও প্রতিমা শিল্পী কাজ হারিয়েছেন।পুরাতন শোলার বাজার অস্তিত্ব রক্ষায় ধুঁকছে।সরকারি সাহায্য নেই।সাবেকিয়ানা জড়িয়ে প্রাচীন শিল্পীদের বেঁচে থাকার লড়াই চরম সংকটের মুখে।

পরিশেষে বলি,ভিন্ন মত থাকলেও,দুই ধরণের শিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে বারোয়ারি পুজো গুলি হয়ে উঠুক একটি মিশ্রিত শিল্পের অঙ্গন।সাবেকিয়ানা যে অঙ্গে পরিধান করেও আধুনিক শিল্পকে বরণ করে নেওয়া যায়।আর প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংরক্ষিত হয়।তাই বাঙালির সর্বজনীন দুর্গোৎসবে মেল বন্ধন ঘটুক সাবেকি ও থিম পুজোর। করুনাময়ী মা সর্বত্র বিরাজমান।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *