গুচ্ছ কবিতায় চয়ন ভৌমিক

ক্লান্ত চাঁদের ছায়ায়
১)
প্রচন্ড বজ্রের আস্ফালনেও
লেখা হয়ে যায় লুকানো সূর্যের প্রভা।
আলো জ্বলে ভিতরে ভিতরে।
আশা জাগে নিভৃতে, প্রদীপ
শিখার মতো কাঁপে স্বপ্নজাল।
বাস্তবের রূঢ় রাগ,
উপেক্ষা করতে আশ হয়।
‘একদিন মেঘ কেটে যাবে’, লেখা হয় বেলাভূমিতে।
ষড়যন্ত্রী জল, মোছে সেই নিদাঘ অক্ষর।
পদছাপ পড়ে থাকে, গভীরে পিছুটান।
পড়ে থাকে অকাল বোধন।
খোঁজ বাড়ে। তোমার অশ্রুর
গভীরে, চিকচিক করে সুবর্ণরেখা।
‘কবে ছোঁব তোমায়?’ এই প্রশ্নে
বিচলিত হতে নেই, হে নিধিরাম সর্দার।
একদিন সত্যি হয়তো কেটে যাবে তুমুল বাদল।
দেখা হবে আমাদের বসন্তের অগ্নিশিখায়।
২)
প্রকৃতি সবজান্তা যেন। তাই,
আজ তোমার দেশে রোদ, আর,
আমি বৃষ্টির ছায়ায় বসে আছি, ব্যাকুল শরীরে।
ওখানে কী শুকিয়ে যাচ্ছে সব,
মেলে দেওয়া কাপড়? রোদের
তেজে কী, উষ্ণতা ফেটে পড়ছে –
ফুলে, ফলে আর টবের মাটিতে?
আমি দিব্যচক্ষুতে দেখছি,
ফুটিফাটা প্রাণও ধারাজল চায়।
আর, এ’ জীবন চায় প্রখর আগুন।
প্রকৃতি সবই জানে। তাই,
দূরে করে রাখে বৈপরীত্যে।
অভাবের তাড়নায় হিলিয়ে দেয় সাম্য।
তোমার ওখানে যতটা রোদ,
ঠিক ততটা বারিশ নিয়ে,
এই দেখো আমাদের ব্যবধান সময়-
কিরকম লিখিয়ে নিল সে…
৩)
এক টুকরো নখের মতো চাঁদের উপর পা ঝুলিয়ে বসেছিলাম কয়েক বছর। তারপর কে যেন ধাক্কা মেরে ফেলে দিল আমায়। আমি পড়ছি তো পড়ছি… তারাদের পাশ দিয়ে, ছেঁড়া মেঘের পাশ দিয়ে, ছায়াপথের পাশ দিয়ে, আমি নেমে আসছি পৃথিবীর মাটির দিকে। আমার দৃষ্টির সামনে থেকে বদলে যাচ্ছে রং। নীল থেকে সবুজ, সবুজ থেকে মেটে… আমি হাত ছড়িয়ে দিয়েছি আকাশে, যেন বিমান এক নেমে আসছে রানওয়ের দিকে। আমাকে টানছে মা। ইচ্ছাগাছের ডানায় আমার ছেড়ে আসা ফুলেরা বড় হচ্ছে ক্রমশ। কিন্তু এই যা:! কে যেন শূন্যেই আটকে দিল আমায়। ওমা আমার জামা আটকে গেছে, সেই গত শ্রাবণের বজ্রাহত মৃত নারকেল গাছে। আমি ঝুলছি এখন। কে আমায় নামাবে বলো? বলো দেখি, এই মধ্যবর্তী, নিরুপায় জীবন থেকে, কে আমায় নামিয়ে দেবে আমার বাড়ির ছাদে দাঁড় করানো ভাঙা এন্টেনার উপর।