১লা বৈশাখ। একলা থাকার নয়, সবাই মিলে থাকার।
বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণ। মাসে মাসে ওয়েবে মহা উদযাপন।
বাঙালির জীবন যেন উৎসবের এক অপূর্ব ছন্দে বাঁধা। ‘বারোমাসে তেরো পার্বণ’ কথাটি শুধুই লোকমুখে প্রচলিত কোনো কথার ছাঁচ নয়, বরং বাঙালির জীবনের আবেগ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সার্থক প্রতিচ্ছবি। আর এই পার্বণের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচেয়ে বর্ণিল ও সবচেয়ে প্রাণবন্ত দিনটি হলো — ১লা বৈশাখ। বাংলা বছরের প্রথম দিন, ১লা বৈশাখ, কেবল একটি পঞ্জিকার পাতা উল্টে যাওয়া নয়, এটি বাঙালির জীবনে এক নতুন সূচনা, নতুন আশার প্রতীক। কৃষি নির্ভর বাংলায় এই দিনটি চাষাবাদের নতুন বছরের সূচনা হিসেবে পালিত হতো। ‘হাল খাতা’ রীতিতে ব্যবসায়ীরা পুরনো দেনা-পাওনার হিসেব চুকিয়ে নতুন খাতা খুলে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতেন। এখনো বহু জায়গায় এই প্রথা রক্ষিত হয়। পহেলা বৈশাখ মানেই গান, শোভাযাত্রা, গ্রামীণ মেলা, আলপনা, রঙিন শাড়ি-পাঞ্জাবি আর ‘এসো হে বৈশাখ’ ধ্বনিতে মুখরিত এক প্রভাত। শহর হোক বা গ্রাম, এই দিনে প্রতিটি মানুষ যেন ভুলে যায় তার দুঃখ-কষ্ট, একসাথে মেতে ওঠে আনন্দে। এই মহা উৎসবে ধর্ম-বর্ণ-জাতির কোনো ভেদাভেদ নেই – এ এক নিখাদ বাঙালিয়ানা।
আধুনিক যুগে সামাজিক মাধ্যম আর অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও বৈশাখের ছোঁয়া সমানভাবে বিদ্যমান। ফেসবুকে বিশেষ কাভার ছবি, ইনস্টাগ্রামে রঙিন শাড়ির পোস্ট, ইউটিউবে বৈশাখী গান – সব মিলিয়ে ১লা বৈশাখ এখন বাস্তবের পাশাপাশি ভার্চুয়াল জগতেও মহা উৎসব। দোকানপাট থেকে শুরু করে ই-কমার্স সাইটেও চলে বৈশাখী অফার, যা পুরো উৎসবকে আরও রঙিন করে তোলে।
এটি স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের শেকড়, আমাদের সংস্কৃতি, আর আমাদের একসাথে চলার অঙ্গীকার। বৈশাখের হাওয়ায় ভেসে আসে নতুন সম্ভাবনার সুবাস, যা বাঙালিকে বারবার নতুনভাবে বাঁচতে শেখায় – হৃদয়ে গেঁথে যায় বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণের চিরন্তন ধ্বনি।
বাংলা সংস্কৃতির ভান্ডার এতই সমৃদ্ধ যে, সেখানে প্রতিটি মাসে কোনো না কোনো উৎসব লেগেই থাকে। তাই বলা হয়, ‘বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণ।’ আর এই উৎসবের রাজা নিঃসন্দেহে ১লা বৈশাখ। এটি শুধু নতুন বছরের সূচনাই নয়, বাঙালির আত্মপরিচয়ের এক গৌরবময় প্রতীক। ১লা বৈশাখের উৎপত্তি মূলত মুঘল আমলে। সম্রাট আকবরের রাজস্ব ব্যবস্থার সুবিধার্থে হিজরি চন্দ্র পঞ্জিকার সঙ্গে সৌর বছরের সমন্বয় করে বাংলা সন প্রচলন করা হয়। তখন থেকেই কৃষি নির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতিতে এদিনটির বিশেষ গুরুত্ব তৈরি হয়। আজ তা কেবল প্রশাসনিক দিন নয়, এক গভীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বাহক। বৈশাখের সকালে সবাই পরেন নতুন পোশাক। মেয়েরা পরে লাল-পাড় সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোঁপায় ফুল; ছেলেরা পরে পাঞ্জাবি ও পাজামা। গ্রামের মেলায় লোকশিল্প, হস্তশিল্প, নাগরদোলা আর মধুর কণ্ঠে পালা গান যেন অতীত বাংলাকে টেনে আনে বর্তমানের রঙিন চৌকাঠে। শহরে এই উৎসবের রূপ আরও আধুনিক। ১লা বৈশাখ আমাদের শেকড়ের স্মরণ করিয়ে দেয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এই দিনে একসাথে হাসে, গায়, আনন্দ করে। এই মিলনই বাঙালির আসল শক্তি। বৈশাখ যেন বলে – চলো পুরনো ভুলে নতুন করে শুরু করি। ১লা বৈশাখ কেবল একটি দিন নয়, এটি একটি অনুভব, একটি ঐতিহ্য, একটি আত্মগর্ব। বছরের শুরুতে বাঙালি যেভাবে প্রাণভরে আনন্দে মেতে ওঠে, তা পৃথিবীর বুকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। সত্যিই, এই উৎসবের মাধ্যমে বোঝা যায়, বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণ – আর বৈশাখ তার হৃদয়।