কবিতায় চিরন্তন ব্যানার্জি

সাইকেল

চাকরি পেয়ে মাকে কিনে দিয়েছিলাম গরদ;
লাল পাড়ে জরির ফুল, যেমন সিনেমায় হয়-
বাবাকে একটা সাদা কাশ্মিরী শাল, পিসিকে ঘড়ি,
মামার জন্য নিয়েছিলাম পছন্দের স্কচ;
খালি বুড়ি ঠাকুমার জন্যই কি নেব ভেবে পেলাম না।

বুড়ির লাগেটাই বা কি? সরু পাড় সাদা শাড়ি,
খানিক পান আর দোক্তা, কটা গল্পের বই-
চোখের কারনে সে সময় তাও পড়তে পারত না বুড়ি।

অফিস থেকে ফিরে, একদিন বুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম,
“তোমায় কি দেবো বলো তো –
ফুলতোলা লেসের চাদর?
ছেলেবেলার গল্পে শোনা বাহারি পানের ডিবে, মিনে করা?
জুঁইফুলের আতর, নাকি সোনার জল করা চশমা?”

হঠাৎ চোখ তুলে ঠাকুমা বলে উঠল
“আমায় একটা সাইকেল কিনে দিবি মানু?”

সাইকেল? মাথাটা গেল নাকি?
বুড়ো বয়সে সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে
হাড়গোড় ভাঙে শেষে কি মরতে চায় নাকি?
এই বয়সে কেউ সাইকেল শেখে – পাগল।

“কোন বয়সে মেয়েরা সাইকেল শেখে রে মানু?
ছেলেবেলায় দাদারা সাইকেল নিয়ে যেত গোয়ালপাড়ার মাঠে-
দিনেও সেখানে ঘুপচি অন্ধকার, তক্ষক ডেকে ওঠে থেকে থেকে
সন্ধার পরে বটের আঠার মত জোৎস্না ঝরে পড়ে পাতার থেকে;
মাঝরাতে নেমে আসে পরি, যাদের দেখলে অন্ধ হতে হয়;
মেজদা বলেছিলো দেখাতে নিয়ে যাবে সাইকেল শিখলে-
শেখার আগেই একদিন বাড়ি বদল হয়ে গেল।

নতুন বাড়ি, নতুন সিঁদুর, নতুন মানুষ, নিয়ম কিন্তু একই
মেয়েরা আবার সাইকেল চালায় নাকি?
মেয়েরা মিষ্টি করে সেজে, উঠোন থেকে দেখে
তার বর সাইকেলে নিয়ে চলে যায় দূরে, আরো দূরে;
দুটো চাকা বনবন করে ঘোরে, ঘোরে, শুধু ঘুরেই যায়।

মেয়েরা কখন সাইকেল শেখে রে মানু?
ছোটবেলায়? যখন মা বিয়ের জন্য রান্না শেখায়?
বিয়ের পর? বর শ্বশুরের ফরমাস খাটতে খাটতে?
এখন যখন আমার সব কাজের কাজ শেষ-
এখনো কি শেখার সময় হয় নি?”

ঠাকুমার সাইকেল শেখা হয়নি-
শেখার আগেই বুড়ি শুকনো নদীর চর পেরিয়ে,
ঝুমঝুমি গ্রাম পেরিয়ে, বাঁশবাগানের শেষ পেরিয়ে
গোয়ালপাড়ার মাঠ পেরিয়ে,পরী হয়ে গেল।

আমার মেয়েকে তাই সাইকেল শিখিয়ে দিচ্ছি-
ডাক্তারবাবু বকেন,
ওর শরীরে যে রক্তের রাজরোগ
কেটে গেলে রক্ত বন্ধ হবে না,
তবুও যত্নে শেখাই- সময়টা যে বড্ড বড্ড কম।

কদিন পর ও যখন কলকাতা পেরিয়ে,
বাংলা পেরিয়ে, ভারত পেরিয়ে, এশিয়া পেরিয়ে
পৃথিবী পেরিয়ে, দিগন্ত পেরিয়ে, সব পেরিয়ে-
মহাকাশে যাবে
সেখানে ঠাকুমাকে সাইকেল শিখিয়ে দেবে-

আর আমি চোখ তুলে মাঝরাতে দেখব
তারাঝরা অন্ধকারে, আকাশগঙ্গার মাঝখানে
দুজনকে নিয়ে একটা সাইকেল ছুটে চলেছে-
পাঁইপাঁই পাঁইপাঁই পাঁইপাঁই।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *