সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ২৪)

কু ঝিক ঝিক দিন

২৪.

ইজ্জত কলোনির বাড়িটা ছেড়ে আমাদের নতুন বাড়ি হল ডি গুপ্ত লেনে।এর আগের বাড়িটায় আমরা ভাড়া ছিলাম।যদিও একটা পরিবারের মতোই চারটে পরিবার থাকতাম।
একদিন জানতে পারলাম,আমাদের নতুন বাড়ি হচ্ছে। ভাড়াটিয়া অপবাদ ঘুচিয়ে নতুন বাড়ি,তাও আবার নিজেদের।এও এবার হচ্ছে। এর থেকে খুশির খবর আর কি হতে পারে!ফলে প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর ফোয়ারা মোড় থেকে আগে ডানদিকে বেঁকে যেতাম।এখন বাঁদিকে। কারন একটাই। বাড়িটা কেমন হচ্ছে দেখে আসা।
কিন্তু বাড়ি হবার আগেও একটা গল্প থাকে।জমি কেনা,ভিত পুজো,প্ল্যান…এসব আর কি!
একদিন রাতে বাবা বাড়ি ফিরে মাকে বললেন, তেজেন একটা জমি দেখেছে।একা পুরো জমিটা কিনতে পারবে না।তাই বলছে, যৌথ ভাবে কেনা হয় যদি তবে একসঙ্গে থাকাও হবে,আর খরচটাও কম হবে।
তেজেন কাকু বাবার রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলের সহকর্মী শিক্ষক।
এসব বিষয়ে মা সচরাচর কোনো কথাই বলতেন না। শুধু বললেন, যা ভালো বুঝবে করবে।
বাবা একদিন তেজেনকাকুকে নিয়ে যে ভদ্রলোক জমিটা বিক্রি করবেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।এই জমিটা ছিল রানী রাসমনীর জামাই আটাবাবুদের।যা তাঁরা যৌতুক হিসেবে পেয়েছিলেন রাসমনীর থেকে।এবং এখানে নাকি রামকৃষ্ণও এসেছিলেন। সত্যি মিথ্যা জানি না।তবে এই সিঁথি বরানগর অঞ্চলগুলো তাঁর যাতায়াত ছিল একথা সবাই জানেন ও বিশ্বাসও করেন।
যাহোক,এই জমিটার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল।চারপাশে পুকুর,মাঝখানে দ্বীপের মত অল্পখানি ফাঁকা জমি।তার পিছনে গোয়ালাদের গো শালা।পুকুরের একপাশে জেলেদের মাটির বাড়ি।এরা নাকি রাসমনীর সময় থেকেই বংশপরম্পরায় এখানে আছেন।ওই জমিটা দেবত্তর সম্পত্তি। তা কখনো বিক্রি করা যাবে না।পিছনের গোয়ালারাও নাকি ওভাবেই বংশ পরম্পরায় আছেন।
সামনের মেন রোড দিয়ে ঢুকলে পরপর চারটে বাড়ি,শেষ বাড়িটা আমাদের। তখন অবশ্য সবটাই মরা জলাশয়।অল্প জল।আর অল্প জমি।এখন এই শেষের জমিটা নিয়েই তেজেন কাকুর উৎসাহ।
বাবা জমি দেখার আগেই জমির মালিকের সঙ্গে কথা বলতে গেলেন।তিনি কিভাবে জমিটা বিক্রি করবেন, কত টাকা এসব আলোচনার জন্য।
পরের কথাটুকু হুবহু মনে আছে।তেজেন কাকু মাকে বলেছিলেন খুব উত্তেজিত হয়ে।
আমি জমি দেখলাম,ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে সব ঠিক করে এলাম।আর যেই দাদা গেলেন,উনি মত পালটে ফেললেন।
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,কেন উনি আর বিক্রি করবেন না বললেন?
করবেন।তবে আমাকে নয়,দাদাকে।উনি নাকি এত বছর দাদার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।
মা খুব অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন,এত বছর?তোমার দাদাকে উনি চিনতেন?
তাতো জানি না বৌদি।তবে যেভাবে দুজনে কথা বলছিলেন তাতে আমিও আশ্চর্য হয়েছি।কারণ দাদা আমার কাছে একবারও জানতেও চাননি কোন জমি,কার জমি।
সেদিন তেজেনকাকু একটু রেগেই চলে গেলেন।
আমি বিছানায় বসে কথাগুলো শুনলাম,কিন্তু জমি কিনে বাড়ি করতে হয়,বা জমি আসলে অন্য কারোর হয় এসব ধোঁয়াশার মতো লাগল।
যাহোক,কদিন মা বাবা আর এ নিয়ে কথা বললেন না।মা সম্ভবত ভেবেছিলেন জমি কিনে বাড়ি করার টাকা বাবা কি করে পাবেন!
কিন্তু কদিন পরেই এক রাতে শুনলাম,জমি কেনার টাকা যোগাড় হয়ে গেছে। এবার খাতায় কলমে কেনা।তাও হয়ে গেল।
এরপরই অবাক হয়ে গেলাম শুনে বাড়ি করার আগে ভিত পুজো করতে হয়।এর আগে এই শব্দটার সঙ্গে কোনো পরিচয় ছিল না।
এক বৃহস্পতিবার ঠিক হল ভিতপুজো হবে।তার কদিন আগে থেকে তুমুল ব্যস্ততা। ঠাকুর মশাই ফর্দ করে দিয়ে গেছেন।আমাদেরই এক বন্ধুর বাবা।তিনি কালিবাড়িতেও পুজো করতেন।বিশাল জটা তাঁর মাথায়।বাড়িতে তাঁর মা অন্নপূর্ণার বারোমাস পুজো হয়।তাদের বাড়িটা আমাদের বাড়ির জানলা দিয়ে সোজা তাকালেই চোখে পড়ত।
বাড়ির সামনে বিশাল বাগান।প্রশস্ত মাটির বারান্দা।দুই বোন তারা।সীমা আর তার দিদি।
সীমা আমার বোনের বন্ধু। জ্যেঠিমা মানে সীমার মায়ের পরনে কখনো ব্লাউজ থাকতো না।আর বারো মাস লাল পাড় সাদা শাড়ি।কেউ বলেছিল,ওগুলো জটাধারী জ্যেঠু পুজো করে পান।আর তাই অন্য শাড়ি কেনা হয় না।
ওদের বাড়িতে গেলে নাড়ু দিতেন জ্যেঠিমা। অনেক গুলো নারকেল গাছ ছিল ওদের।
ঠিক হল জ্যেঠুই ভিত পুজো করবেন।রামপুরহাট থেকে আমার দিদা দাদু চলে এলেন।দিদাই রান্না করবেন। পুজোর পর সবাইকে তাই খাওয়ানো হবে।মেনু লুচি,আলুরদম,পোলাও,মিষ্টি, ধোকার ডাল্লা।
মা জিজ্ঞেস করলেন,কতজন আসবে গো?
বাবা নির্বিকার মুখে বললেন,তা জানি না।সবাইকে বলে দিয়েছি।
এই সবাইটা কারা? এ প্রশ্নের উত্তর বাবা কোনোদিন কোনো অনুষ্ঠানেই দিতে পারেননি।
ফলতঃ প্রতিটি অনুষ্ঠানেই মা অনুমানের ওপর নির্ভর করে আয়োজন করতেন।
ভিতপুজোর আগের দিন মা নিজে গেলেন জমি দেখতে।তখনো জল পেরিয়েই যেতে হবে আমাদের জমিতে।মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়নি।
যথারীতি অনুমানের উপর ভিত্তি করে দিদা রান্না করলেন।সহকারী তুলসী দিদি।
বিশাল বিশাল হাঁড়িতে খাবার নিয়ে যাওয়া হল।
বাবা সামনের প্রোগ্রেসিভ ক্লাবের দাদাদের ডাকলেন মাটিতে প্রথম ইঁট পোঁতার জন্য। ওভাবেই নাকি ভিত পুজো হয়। ক্লাবের দাদা, বাবার ছাত্রও, শ্যামলদা,পাশের বাড়ির ভূজুন দা,আরও অনেক দাদা, সামনের,পিছনের,এমনকি গোয়ালা কাকু,জেলে দিদা সবাই ইঁট দিলেন পরপর। এমনকি আমরা যে বাড়িতে থাকতাম,সেখানকার কাকিমা ও জ্যেঠিমাও মাটিতে জল দিয়ে ইঁট দিলেন।
সবার শেষে জ্যেঠু বললেন,এবার বউমা আর আপনি দিন।
বাবা সেদিন নিজে একটা ইঁট ও দিলেন না।কেন দেননি জানি না।
তবে মনে আছে অনেকক্ষণ ধরে হোম যজ্ঞ চলেছিল।তারপর দিদা সেই অগুনতি মানুষকে খাইয়েছিলেন।
আমি আজ এত বছর পার করে এসেও বুঝতে পারি না কেন বাবা নিজে একটি ইঁটও পোতেননি,আমাদেরকেও পুঁততে দেননি,আর কিভাবে দিদা নির্দিষ্ট কতজন মানুষ হতে পারে না জেনেও সেই সমস্ত মানুষকে খাওয়াতে পেরেছিলেন। সেদিন লোক সংখ্যা কম করে দুশো তিনশোজন তো হয়েই ছিল।
সেই দিনটার পর প্রতি দিন স্কুল ফেরত,নাচের স্কুলে যাওয়া-আসার পথে আমরা পুকুরে একটু করে মাটি ফেলে আসতাম।কিংবা পাথর।রোজ দেখতাম ট্রাকে করে মাটি আসছে,আর সেই অল্প জলে ফেলা হচ্ছে। তখন বুঝতে পারতাম না,আশে পাশের জলা জমি বুজিয়েই তৈরি হবে আমাদের ইমারত।ভাবতাম এক প্রকান্ড জলাশয়ের মাঝে বিশ্বকর্মা এসে বানিয়ে দেবেন এক রাজ প্রাসাদ।নৌকো করে সেই জল পেরিয়ে আমরা পৌঁছাবো আমাদের বাড়িতে।পুকুরের জলে ফুটে থাকবে জলপদ্ম,শাপলা,কলাবতী ফুল।আমরা সেই রাজপ্রাসাদের রাজকন্যারা তাই দিয়ে ঘর সাজাবো।
না,নৌকা করে সেই বাড়িতে যেতে হয়নি।রাস্তা হয়ে গেছিল।তবে পাশের পুকুর থেকে পদ্ম,শাপলা,কলাবতী,তারপাশে বিশাল কদম গাছ থেকে কদম ফুল,আরও নাম না জানা নানা ফুল তুলে এনে ঘর সাজাতাম রোজ বিকালে।
বাবা সেই পুকুরে ক্রমাগত মাছ, হাঁস এনে ছাড়তেন।আর সেগুলো একটু বড় হলেই নাকি শেয়াল এসে নিয়ে যেত,অথবা মাছগুলো নাকি মরে যেত।
কিন্তু কখনো কোনো মরা মাছ ভেসে উঠতে দেখিনি।আর শেয়ালও দেখিনি।
অনেক পরে এক ভোর রাতে জানলার পাল্লা খুলে দেখলাম,জেলে দিদার ছেলে আর জামাই জাল ফেলে মাছ গুলো ধরে তাদের ঝুড়িতে রাখছে,আর হাঁসগুলোকে উল্টো করে ঝুলিয়ে সাইকেলে বেঁধে নিয়ে চলেছে।
অবশ্য বাবা তারপরও মাছ আর হাঁস মুরগির যোগান অব্যাহত রেখেছিলেন , এরপর মা বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, একটাও মাছ,ডিম কিছু ঘরে আসে না,আর গুচ্ছের টাকার এভাবে অপচয় হচ্ছে।কোনো বুদ্ধি নেই তোমার?
আমার এখনো বাবার সেই মুখটা মনে পড়ে, বাবা খুব ধীরে ধীরে বলছেন,জানি তো,এই মাছগুলো ওরা বাজারে বিক্রি করে,হাঁস মুরগীর ডিমও।ওরা যাতে খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারে তার জন্যেই তো আনি।এটাতে বাঁধা দিও না।
মা আর কিছু বলেননি। কিন্তু জেলে দিদার মেয়ে আর ছেলেরাই নিজেদের ঝামেলায় একদিন এসে বাবাকে জানালো,কাকাবাবু, আর এখানে মাছ ছেড়ো না।মুরগি হাঁসেরও দরকার নেই। আমরা এখন রিকশা চালাবে।আপনি বরং রিকশা কিনে দিন আমাদের।
সেই রিকশা চেপেই আমি ইংরেজি পড়তে যেতাম বেনীকলোনীতে,আর মাঝে মধ্যে বাবা দমদম যেতেন বাজার করতে।
অবশ্য মাছ,হাঁস মুরগি না এলেও এরপর এলো গরু। গোয়ালাদের জন্য। এবং তাদের থাকার জায়গা হল আমাদের বাড়ির একতলা।কারন গোয়ালঘরে তখন জল…।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।