এক ঘণ্টা ফুরিয়ে এল।সন্ধে নামার মুখে।এতক্ষনে আগুনটা ভালো করে ধরেছে।বর্ষাকাল।কাঠে জল টেনে রেখেছে।বিশু পুরো এক পিপে তেল ঢেলেছিল।তাতে প্রথম দিকটাই ধিকধিক করে জ্বলছিল। তারপর আবার লাটুদার মায়ের চেহারা ভালো। বেশি করে কাঠ চাপাতে হয়েছে। বিশু এসব ব্যাপারে এক্সপার্ট।প্যান্ট গুটিয়ে,কোমরে গামছা কষিয়ে লাঠি হাতে দাওয়ায় বসেই আছে।
দোকান খোলার মুখে খবরটা পেলাম।তালায় চাবি ঢুকিয়ে সবে একপাক দিয়েছি দেখি নাড়ু আসছে সাইকেল নিয়ে,অন্য দিনের থেকে একটু বেশি স্পীডে।তারমানে কোনো খবর আছে।
‘একজন গেলো ও পাড়ার”।
“কে রে?”
“লাটুদার মা”।
“অ্যাঁ সেকিরে।এই যে দিন কয়েক আগে দেখলাম বিশুর দোকান থেকে ময়দা নিতে এসেছে”।
“অ তা জানিনা।দু দিন পড়েছিল শুনলাম”।
“কি হয়েছিলো?”
“জ্বর”।
চাবিটা আবার উল্টোদিকে ঘুরলো।সেই যে গেলাম ,এখনো আছি।দুপুরে তিনবার ফোন এসেছে বাড়ি থেকে।ধুস্ বোঝেনা।কাটিয়ে যাওয়া যায় নাকি।এসব দিনে লোকের পাশে দাঁড়াতে হয়।আর তাছাড়াও লাটুদা ক্লাবের জন্য অনেক কিছু করে।সারাবছর তো টুকটাক লেগেই আছে,উপরন্তু পুজোর সময় প্রতিবার হয় তিরিশ নয় চল্লিশ দেয়।এবার দেড়শো বছরে শুনেছি পঞ্চাশ দেবে।তার জন্য নয় একবেলার ভাত গেলো।এ আর এমন কি।
বডির হাতটা খিঁচে গেছে।ওমনি বিশু বাঁশের খোঁচা দিলো।হুসহুস করে খানিকটা আগুন বেরলো।লাটুদা বসে আছে বটগাছের চাতালে।মুখ চোখ একেবারে পানসে মেরে গেছে।শ্মশানের গেটের কাছে একপার্টি কীর্তনওয়ালা সেই কখন থেকে ঘ্যানর ঘ্যানর করেই চলেছে।মাল গুলোর এনার্জি আছে। বৃষ্টিটা ধরেছে।নইতো এই খোলায় বসে থাকাও দায় হতো।গঙ্গার দিক থেকে ফুরফুরে হাওয়া আসছে।ঝিমুনি লাগছে।
-“চা খাবে?” লাটুদার পাশটায় গিয়ে বসলাম।
-“নাহ। তোরা খা।সেই দুপুর থেকে আছিস।খাসওনি তো কিছুতা
-“ধুর্। ও সব ছাড়োতো”।
-“ ওদিকে কদ্দুর?”।
-“আরো ঘন্টা দুই লাগবে”।
-“ডোমগুলোকে দেখিস কত নেয়।রফা করে নিস”।
-“বিশু আছে,চাপ নেই”।
-“কটা বাজছে?”।
-“পৌঁনে ছটা”।
অশান্তিটা শুরু হয়েছিল অনেকদিনই।লাটুদার বোনকে নিয়ে।পালিয়ে বিয়ে করেছে।তাও পাশের বাড়িতে।প্রথমে একটু আধটু তুলকালাম হলেও পরে সব মিটে গেছে।মেয়ে খুশি,বাড়ির সবাইও।তবে মেয়ের নিজের সংসারে চাল ,ডাল, তেল ,নুন ফুরোলেই “হ্যালো”। ওমনি লাটুদার মা পেটের শাড়ি আড়াল করে জিনিস পাচার।কাকে যে লুকোয় জেঠি জানিনা।এ পাড়ার,ও পাড়ার সবাই জানে।এসব মেয়েলি বুদ্ধি কি চাপা থাকে?এ ওকে সে তাকে বলে “দিব্যি রইলো,কাউকে বলবি না”।কথার পিঠেই কথা ছড়ায়। ছড়াতে ছড়াতে হাওয়ায় মেশে,ধুলোয় ওড়ে,খানিক চাপা পড়ে মাটিতে।কেউ বিষিয়ে যায়,কেউবা শুধু সমালোচনা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ে।
সংসার এক ধাঁচের নয়।ছোট থেকে বড়,তার থেকেও বড় হতে হতে বুঝেছি।নতুন মানুষ এলে,পুরোনো গেলে সংসার বদলায়।ভাঙে গড়ে।লাটুদাদের সংসারও বদলালো, বউ আনাতে।এক তলা থেকে দুতলা হলো। কাঁঠাল গাছ কেটে রুম বাড়লো।ছোটো গেট বড় হলো।লাটুদা বিয়েতে যৌতুক পেয়েছিলো লাল চারচাকাটা। নির্জীব হলেও সেটাও বদল ঘটালো সংসারে।আগের মতো তেমন করে উঠোন ঝাঁটানো যায় না।গাড়িতে নোংরা জলের ছিঁটে লাগলে রঙ চটবে। আরও কত কি চটলো।জং ধরলো। ভাঙলো,মচকালো,আস্তাকুঁড়ে ফেলা গেলো।
দু তিনবার দপ্ দপ্ করার পর লম্বা, ঢ্যাঙ্গা স্ট্রীট লাইটা জ্বলে উঠলো।আকাশে কালচে রঙ ধরেছে।বটগাছটার মাথায় হাজার পাখির বাসা। ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরছে সব।আগুনের আঁচ কমে এসেছে।আর আধঘণ্টা খানেক।তারপরেই সব শেষ।
সেই কবে,ছোটবেলা থেকে গন্ধটা লেগে ছিলো।বিপদ আপদ সবকিছুতেই আশেপাশে ঘুরঘুর করত ওটা।মা মা গন্ধ।ঘন্টাখানেকের আগুনে কোথায় হারিয়ে গেলো।এখন শুঁকলে শুধু পোড়া ছাইয়ের গন্ধ।তবু মেনে নেওয়া যায়না।মন থেকে সরানো কি এতই সোজা।
-“জানিনা বল্লামতো।জেঠিকে জিজ্ঞেস কর।মরার পর সবাই অন্তর্জামি হয়”।
-“তুই খুব জেঠি জেঠি করতিস।তোকেই উত্তরটা দেবে”।
কি জানি চলে যাওয়া মানুষে উত্তর দেয় কিনা,সব জানতে পারে কিনা।কতো কি বুকে চেপে রাখে মানুষ।চিতায় উঠলে সবটা রেখে আসতে হয়।ভেতরটা একেবারে ফাঁকা করে দিয়ে। ওগুলো থাক যেমন আছে।নইলে সংসার বড়ো বেমানান।শুধু ভালোটাই থাকবে খারাপটা নয়,তা কি হয়।সবই সাজন্ত।একে অন্যের পরিপূরক।
কথাগুলো কানে আসে ঝি মারফত।এরা সাংঘাতিক।এ বাড়ির কথা আড়ি পেতে শুনবে,তাতে নুন লঙ্কা লাগাবে তারপর ও বাড়িতে ডেলিভারি দেবে।ননদের কথা গুলো এভাবেই কানে আসে। লঙ্কার ঝালে গা জ্বলে লাটুদার বউএর।খানিক গালমন্দ তুলে দেয় ঝি এর কানে।ফ্রী র পোস্টাল সার্ভিস সকাল বিকেল নিযুক্ত।
বছরে বছরে জ্বালা বেড়েছে।মধ্যিখানে দেওয়াল উঠেছে।লুকিয়ে বাটি চালাচালি বন্ধ হয়েছে। যেদিন গলা বুক সব ডুবে যায় সেদিন চেঁচায়।লাটুদার বউয়ে আর মায়ে।দেওয়ালে কান পেতে কেউ কেউ শোনে।একের সংসারের ঝামেলা অন্যের সমালোচনার খোরাকি।এসবে লাটুদা সবথেকে বেশি গুবলেট হয়।কোন পার্টির হয়ে দাঁড়াবে ভেবে পায় না।
সেদিনও কি নিয়ে যেন লাগল।লাটুদার মায়ের গলা চড়লো কম,বউয়ের বেশি।মাঝে মাঝে সত্যি এসবে বড় ছেঁকা লাগে,জ্বালা ধরে।অফিস ফেরত কেউ এক গ্লাস জল দিলে প্রাণটা জুড়োয়।তা না,এসে থেকে সেই কিচকিচ।এত খেয়োখিয়ি তে কিযে সুখ পায় মেয়েরা কে জানে।দোকান বন্ধ করে ফেরার পথে সেগুলো কানে আসছিল।নিজেদের অজান্তেই কখন যেন এতখানি তিক্ততা ঢুকে পড়ে।
আগুন প্রায় নিভু নিভু।বডিটা পুড়ে ছাই। ডোমেদের একটা ছেলে বালতি করে জল ঢালছে।বিশুর হাতে মাটির খোলা।অস্থি নেবে, লাটুদা গঙ্গায় দেবে।
-“পেলি?”
-“দাঁড়া রে ।জেঠি এখনো গরম আছে”।
খোলাটা গরম। ধোঁয়া উঠছে অস্থি থেকে।মায়ের গন্ধটা আর কোথাও নেই।গঙ্গার জোলো হাওয়ায় ভিজে মাটি,পোড়া ছাই সব মিলেমিশে একাকার।
-“পায়ে টান ধরে গেছে বুঝলি”।অস্থি ভাসিয়ে স্নান সেরে লাটুদা বললো।
-“বাড়ি গিয়ে একটু শোও।সেই সকাল থেকে চলছে”।
-“ঘুম ধরবে না”।
-“জানি।তবু খানিকক্ষন চোখ বন্ধ করে থেকো।আরাম পাবে”।