জীবন বড় রহস্যময়। এক মনের মধ্যে আরেক মন,এক সত্তার মধ্যে আরো এক সত্তা লুকিয়ে থাকে।তাকে ধরতে পারার জন্য আমরা আনচান করি,অথচ নাগাল পাই না।
এই যে একটু আগেও যারা কাঁদছিল প্রিয়জনের অন্তিম যাত্রায় -দেখ ভাগনি তারাই কেমন নিজেদের মধ্যে নানা আলোচনায় ব্যস্ত। আর যে চলে গেল সে একাই পুড়ছে।এটাই চরম সত্য। একাই যেতে হয়।
এই কথাগুলো বলে চোলাইয়ের বোতল থেকে দু ঢোক চোলাই মুখে ঢালল মীর মামা। তারপর বিড়ি ধরালো সামনের চিতার আগুন থেকে।
তার মীর মামা নামটা একমাত্র আমিই জানতাম। এটা তার আসল নাম।এক বৃষ্টির রাতে প্রচুর পরিমানে ভাঙ খেয়ে সে বলেছিল,আমি আদতে মুসলিম।কিন্তু এই কাজটা আমার ভালো লাগে।তাই মীর থেকে সত্য।
তারাপীঠ শ্মশানে তাকে সকলে সত্য বলে ডাকে।এখানে তার পরিচয় চন্ডাল।
হিন্দুদের মৃতদেহ দাহ হয়।সেখানে মুসলিম ডোম বা চন্ডাল তাকে দাহ করবে এটা মেনে নিতে সমাজ প্রস্তুত ছিল না।তাই নাম পরিবর্তন।
অথচ মীর মামা পরম যত্ন নিয়ে এই দাহর কাজটা করত।
আমি তখন হুট বলতেই শ্মশান।কখনো বাবার সঙ্গে কখনো একা।বাবা একভাবে ধ্যান করতেন সারারাত।আর এদের সঙ্গেই চলত আমার কথা, গল্প।সেই গা ছমছম অন্ধকারে, আগুনের কমলা লাল নীল আলোতে, লেলিহান শিখায় পুড়ে যাচ্ছে একটা মানুষের শরীর,তাপ পেয়ে হঠাৎ করে উঠে বসছে, প্রথম প্রথম ভাবতাম বুঝি বেঁচে উঠেছে মানুষটা।ক্রমশ জেনে গেলাম মরা মানুষ বাঁচে না।যারা একবার চলে যায় আর ফেরে না।
মীর মামা, ভোম্বল মামা নির্বিকার মুখে একটা লাঠি দিয়ে মেরে সেই অর্ধেক পুড়ে যাওয়া শরীরটাকে আবার শুইয়ে দিত।
আমার মনটা যন্ত্রণায় ফেটে যেত।বলতাম, মেরো না, মেরো না,লাগবে যে।
ভোম্বল মামা আমাকে কাছে টেনে নিত।তার গা দিয়ে চোলাই, বিড়ি, গাঁজার গন্ধ।
আমার সে গন্ধ নাকে কেন লাগত না জানি না।বলত- ওর আর লাগছে নারে।ওর যা যা কষ্ট ছিল তা বরং এখন আর হচ্ছে না।এখন ও মুক্ত।
আমি অবাক হয়ে শুনতাম।পাশ থেকে মীর মামা বলত,জীবনে একটা জিনিস ভালো করে বুঝে নে এখন থেকে,তাহলে কোনও লোভ,লালসা,গর্ব, উচ্চাশা তোকে স্পর্শ করতে পারবে না।
এই যে কোটিপতি থেকে ভিখারী সবাই একদিন মরবে আর তাকে এভাবেই পুড়তে হবে,লাঠির বাড়ি খেতে হবে।মাটিতে পড়ে থাকতে হবে।বাকি সবই মায়া।
মায়া শব্দটা বড় আদুরে।যেদিন দাদু চলে গেল, সেদিন বিশ্বভারতী এক্সপ্রেস ধরে রামপুরহাট পৌঁছবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বুঝতে পারিনি দাদুর নিথর শরীর পড়ে আছে ছ’ফুকোর সামনে বাঁধানো থানের ওপর।স্টেশনে ঢোকার আগে ব্রিজ পেরোবার মুখে দেখা যেত ট্রেন থেকে নিয়নের অল্প ঘোলাটে আলো আর প্রদীপের শিখা।
বোঝা যেত কারোর মৃত শরীর রাখা আছে।
সন্ধ্যা নামার পর গৃহস্থ বাড়িতে আর মৃতদেহ রাখা হয় না। অথচ আত্মীয় স্বজন হয়তো এসে পৌঁছাতে পারেনি।তাই এমন ব্যবস্থা।মা কালির মন্দিরের সামনে সেই থানে তাঁকে রেখে অপেক্ষা। এলেই একবার তার মুখ দেখিয়ে কাঁধে নিয়ে শ্মশান।
মামার বাড়ি গেলে এ দৃশ্য বহুবার দেখেছি।বারবার মনে হত, যে মানুষটা চিরকাল বাড়ি আকঁড়ে রইল তাকে সূর্য নামলেই এভাবে বের করে অনাদরে রাস্তায় রাখা!তবে কেন এত আমার আমার!
মীর মামার কথায় আমার সেগুলোই মনে হচ্ছিল। দাদু সবসময় বলত,আমার বাড়ি,আমার জিনিস, আমার সিদ্ধান্ত… সবই তাঁর,কিন্তু যেই আত্মা চলে গেল অমনি তাঁর বলে আর কিছু রইল না?
সাড়ে দশটায় ট্রেন রামপুরহাট স্টেশনে ঢোকা মাত্র ছোটো মামা মেজমামাকে দেখে মা মাসিরা কাঁদতে শুরু করল।তখন বুঝতে পারলাম ওই যে ফুকোর নিচে শোওয়া মানুষটার কাছে প্রদীপ জ্বলছিল তা আমার দাদুর নিথর শরীর।
ওখানেই দাদুকে সাজানো হল ফুল দিয়ে। তারপর তিনছেলে তিন জামাইদের কাঁধে চেপে দাদু চলল।
ভোম্বল মামা আগুন টা আরেকটু খুঁচিয়ে দিল কতগুলো কাঠ দিয়ে।
আমার সেই মুহূর্তে রাজা হরিশ্চন্দ্রর কথা মনে হল।তিনিও একদিন রাজা থেকে ডোমে পরিণত হয়েছিলেন বিশ্বামিত্রের কথা রাখতে।স্ত্রী পুত্র সবাইকে তিনি হারিয়ে ছিলেন।আর বেনারসের ঘাটে একের পর এক চিতা সাজিয়ে দাহ করার কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন।
যে হরিশচন্দ্র রাজা ছিলেন তাঁর যদি এমন পরিনতী হয় তবে কোনও কিছুই স্থায়ী নয়।
একটু দূরে কিছু সাধক সাধনা করছে।মাঝে মাঝে অদ্ভুত সুরে তীব্র ভাবে ‘জয় মা’ বলে উঠছে।মড়ার খুলিতে তরল পানীয় ঢেলে তার সঙ্গে কি যেন মিশিয়ে পান করছে।তাদের চোখ লাল।পরনে লাল ধুতির মতো কিছু জড়ানো।
তাঁরা মায়ের শিষ্য। কিন্তু মীর মামা বা ভোম্বল মামা কেউ আমাকে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে দিত না রাতে।
আমার খুব ইচ্ছে করত সেই চরণামৃত যা তারা খুলিতে ঢেলে খাচ্ছে, খেতে।
অথচ এরা যেতে বাধা দিত।
বলত,মায়ের সাধক যে সে হয় না।এরা কেউ বামাখ্যাপা নয়,সব ভন্ড।কোনও ক্ষমতা নেই মানুষের ভালো করার।
আমি তাদের পাশে বসেই দেখতাম একটার পর একটা শরীর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। সেই ছাই আমার কপালে ঠেকিয়ে দিত তারা।বলত,তোর মুক্তি হোক সব তামসিক জিনিস থেকে।দেখে রাখ এটাই সত্য। বাকি সব মায়া।
আমি দেখতাম প্রিয় জনকে ছেড়ে ঘরমুখো মানুষের দলকে।একটু আগেও যারা বাবাগো মাগো কোথায় গেলে গো বলে বুকের ওপর পড়ে চিৎকার করে কাঁদছিল,তারাও একসময় কান্না থামিয়ে কেমন চলে গেল।
তাহলে কি সত্যি কোনো কিছু স্থায়ী নয়!এই শরীরে যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ তার দাম!প্রাণ চলে গেলেই সে আর বাবা মা ভাই বোন স্বামী স্ত্রী সন্তান নয়!কেবল একটা বডি!
কি অদ্ভুত এই পৃথিবী! চাঁদের আলোয় খানিক দূরের দ্বারকা নদীর ক্ষীণ ধারা কেমন আলোকিত। একমাত্র বর্ষা কাল ছাড়া কখনো সেখানে আমি জল দেখিনি।অথচ এই নদীর ধারেই একদিন সাধক বশিষ্ঠ মহাশ্মশানের শ্বেত শিমূলের তলে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে তারামায়ের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।যুগ যুগ ধরে তাই সাধনক্ষেত্র এই মায়ের পীঠ।
এই পীঠেও বসে দেখি, শ্মশানে দেহ নামিয়ে তার সম্পত্তি কে পাবে সেই আলোচনায় মত্ত আত্মীয় পরিজন।দেখি ছোটো বাচ্চা কোলে নিয়ে অসহায় মায়ের হাতের শাঁখা ভাঙা হল,সিঁদুরে রাঙানো মাথা,যেন সারা মুখ জুড়ে রঙের খেলা চলছে সেই রঙ ধুয়ে যাচ্ছে জলে,আবার দেখি পায়ে আলতা,মাথায় সিঁদুর লাল পাড় শাড়ি পরে যে মহিলা নিষ্প্রাণ শরীরে দুটো বাঁশের মাঝখানে শোওয়ানো তার পা মাথায় নিয়ে শাঁখা সিঁদুর অক্ষয় রাখার জন্য কি ভীষণ হুড়োহুড়ি।
তার মাঝেই চিতার আগুন থেকে বিড়ি ধরালো মামারা।তারপর আবার আগুন খুঁচিয়ে মুখে চোলাই ঢাললো।
আমার মনে হতো সেই মুহূর্তে তাহলে এই যে আমি বেঁচে আছি এটাই একমাত্র সত্য? বাকি সব মিথ্যা?
আমিও আমার প্রিয়জনের মুখে আগুন দিয়ে ফিরে যাব শূন্য বাড়িতে একদিন!কি হবে তবে মায়া বাড়িয়ে!এখানেই থেকে গেলে হয় চিরদিনের জন্য।
আমিও সাধনা করব,তন্ত্র সাধনা।তবে তা মানুষের ভালো কাজে লাগাবো।
সেই রাতগুলোতে নিজের হাতের থেকে সামান্য দূরে চিতা জ্বলছে, আর একটু দূরে শিয়ালের দল পরিত্যক্ত মাংসের খোঁজে, আরও একটু দূরে সাধকের চিৎকার,আর সব কিছুর মাঝে কি ভীষণ নির্লিপ্ত গলায় আমার ডোম মামারা জীবনের চরম সত্য শেখাচ্ছে তাদের বছর বারোর ভাগনিকে,আর পালা করে পাহারা দিচ্ছে যাতে অঘটন না ঘটে।
আর সেই ভাগনি ভাবছে,এভাবেই যদি সব শেষ হয়ে যায় চিতায় তবে কিসের আমি!কে আমার!
তবে তো কৃষ্ণের অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মৃতদের দিকে তাকিয়ে বলা কথাগুলো, যা মহাভারত পড়ার সময় বার বার পড়ে মানে বোঝার চেষ্টা করেছে সে তাই সত্য। কি তুমি নিয়ে এসেছিলে,কি তুমি নিয়ে যাবে?কেউ তোমার নয়,তুমিও কারোর নয়।তাই মায়া নয়, সত্যের জন্য নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা আর তার জন্যেই বাঁচা।বাকি সব মিথ্যে।