স্বামী আদর করে ডাকে পাগলি। আসল নাম রাধা। গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ হলেও তার শরীরের গঠন আর ডাগর ডাগর চোখ অনেক পুরুষের ঈর্ষার কারণ। দামোদরের বাঁধ আর পাশেই ওদের ছিটেবেড়ার ঘর। ডাক্তার বলে দিয়েছে সন্তান তাদের কপালে নেই। বন্ধ্যা। সন্তানের কারণে বারবার হরিকে বিয়ের কথা বললে উল্টে বলে – কেন আমাকে কি তোর পছন্দ হয় না রে পাগলি? রাধা চুপ করে যায়। জানে পৃথিবী উলটপালট হলেও তাদের ভালোবাসা অটুট বন্ধনে।
এখন বর্ষাকাল। হরি ইলিশ মাছ ধরতে যায় ছোটো মাছধরা নৌকো নিয়ে। কোলাঘাটের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জন্য দামোদরে ইলিশ খুব একটা আসে না ছাইয়ের কারণে। ছাই উড়ে আর নদীতে পরে। ইলিশ গভীর জলের মাছ। আগে অনেক মাছ পেত সে কারণে হরির অনেক টাকা জমানো ছিল। এখন দিনরাত এক করেও হয়তো জালে পড়ে একখান দুখান। তাতেই তাদের সুখ। রাধার শরীরটা এই আবহাওয়ায় ভালো নেই। রাতে শরীরের উষ্ণতা অনুভবে হরি ঠিক করে সে কাল ইলিশের খোঁজে যাবে না। রাধা বাধ সাধে। বলে – তুমি যাও আমার কিছু হবেনি । এটা সময় বদলানির জ্বর। সারারাত বাহুবন্ধনে। হরি ভাবে এসময়ের জ্বর নয় তো? রাতে জ্বর বেড়েই চলেছে। চাইলো হাসপাতালে নিয়ে যেতে। রাধা রাজি হয়নি। মন চাই না যেতে মাছ ধরতে। রাধা আজানের শব্দ শুনেই হরিকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেয়। জোর করে ধরিয়ে দেয় মাছ ধরার জাল। বলে চিন্তা করোনি। আমি সাবধানেই থাকবো। নিমরাজি হয়ে সাবধানে থাকিস বলে চললো মাছ সন্ধানে।
দিন বাড়ে। বিকেল হয়। ঝড় ওঠে। বেসামাল দামোদরের জল। উথালপাথাল। মাছ আজ জালে পড়েনি। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে – মাঝিরা চলে আসুন। বান আসছে। বাড়ির মেয়ে মরদরা ছেলেপুলেদের নিয়ে স্কুল ঘরে চলে যান। বান আসছে বান। ভাঙতে পারে বাঁধ। তারপর মিলিয়ে যায় ঘোষণার গাড়ি। হরি ক্ষিপ্র গতিতে মাছ নৌকো একটা গাছে দড়ি দিয়ে বেঁধে কাঁধে জালটা নিয়ে বাঁধের উপর দিয়ে দৌড়োতে থাকে। গভীর রাতের অন্ধকারের মতো চারিদিক। সময়ে পা হড়কে গেলেও আবার ছুটতে থাকে তার প্রাণের মানুষের অস্তিত্বে। জানে নিশ্চিত সে জিওল গাছের বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে আছে তার অপেক্ষায়।
….নেই।
এই দুর্ধর্ষ আবহাওয়া আর বিদ্যুতের ঝলকানিতে দেখে দরজার পাল্লাটা উলোটপালটে। জাল বাইরে রেখে ছুটে যায় অন্ধকার ঘরে। দূর থেকে দ্যাখে রাধা শুয়ে। বলে – উঠ, পাগলী উঠ, বান ডাকছে। স্কুল ঘরে যামু তু আর মুই। গায়ে হাত দিয়ে দেখে স্তব্ধ শরীর। ঠান্ডা শরীর মৃত্যুর কথা বলে। তুলে নেয় কোলে। বুকে চেপে ধরে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর চিৎকার করে বলে – কেও আছো? মুর পাগলিকে বাঁচিয়ে দাও না গো। বসে থাকে পাথর প্রতিমা। বাইরের মানুষের চিৎকার কানে পৌঁছায় না। বানের জল ঢোকে। ঘর নিমেষে শেষ।
সময় কালকে হারিয়ে এ বন্ধন অনন্তকালের যা ধরে রাখবে অজানা সময়কাহিনী।