T3 || আমার উমা || বিশেষ সংখ্যায় বাসুদেব দাস

শেষ দৃশ্য
মনোজ কুমার গোস্বামী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ
বিল্ডিংটার তেরো তলার বাইরের দিকের বেড়ার প্লাস্টিকের কাজ চলছে।সামান্তরাল বাঁশ দুটিতে এক থালা সিমেন্টের মিশ্রণ তৈ্রি করে রেখে কানু নিচের দিকে তাকাল।নিচে,অনেক নিচে ,শহরের ব্যস্ত রাস্তাটা—দুপাশে পুতুল ঘরের মতো সারি সারি দোকান,পিঁপড়ার মতো দলে দলে মানুষ,দিয়াশ্লাই বাক্সের মতো শত শত গাড়ি মোট্র।এই পর্যন্ত এমনকি নিচের রাস্তার শব্দগুলিও এসে পৌছায় নি।প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সাইনবোর্ড এবং এডভারটাইজিঙের হোর্ডিংগুলি অস্পষ্ট।সেদিকে সবসময় আসা-যাওয়া করার ফলে কানু কেবল অনুমান করতেই পারে ঐ যে সিগারেটের হোর্ডিং, ওটা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন, চৌরাস্তার কোণে সেটি কাপড়ের বিজ্ঞাপন এবং তার সামনে হাতে ক্যামেরা নিয়ে উলঙ্গ যুবতীর ছবি—সেটি একটি স্টুডিওর প্রকাণ্ড সাইনবোর্ড।
‘মশলা লাগা’ নিতাই রাজমিস্ত্রির কর্কশ কণ্ঠস্বরে সে চমকে উঠল। দ্রুত থালাটা এগিয়ে দেয়, দ্রুত হাতে আরও এক থালা সিমেন্ট প্রস্তুত করে সে।
নিচের মাটিতে, দেখা যাচ্ছে, মিক্সচারটা ঘুরছে, যেন নিঃশব্দে। দীর্ঘ চেইনটা দিয়ে সিমেন্টের মসলাটুকু ওপরে উঠে আসছে। ১৩ মহলার একটা বাঁশে ভর দিয়ে কানু অপেক্ষা করে থাকে। সহজ ভঙ্গিতে। অভ্যাস হয়ে গেছে, কারণ এই কাজ করতে করতেই তার জীবন কেটে গেছে। মাটি থেকে শত শত ফুট উচ্চতায়ও, যেখান থেকে নিচে সারি সারি স্তূপীকৃত শিল, ইট এবং বালু দেখা যাচ্ছে ।এখন আর কোনো ভয় বা দুর্ভাবনার অনুভূতি হয় না।
কিন্তু এক সময় এরকম ছিল না। অনেক বছর আগে যখন সে কাজ শুরু করেছিল, বা তার বিয়ের পরেও যখন সে কাজ করতে এল এর চেয়েও অনেক কম উচ্চতায় দাঁড়িয়ে সে কেঁপে উঠেছিল। জীবনে তখন মোহ ছিল প্রবল।সে ভেবেছিল পৃথিবী থেকে পাবার মতো তার অনেক কিছু বাকি আছে। এখনকার মতো এরকম সহজভাবে নিচের রাস্তায় তাকিয়ে দোকান, মানুষ গাড়ি গোনার চেষ্টা করার সাধ্য তার ছিল না। এখনকার মতো তার চোখে ছিল না নিচের সারি সারি বিজ্ঞাপনের রং, আর ছবি। হাতে ক্যামেরা নিয়ে স্টুডিওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা উলঙ্গ যুবতীটিও তার চোখে পড়েনি।সেটা ছিল এক অন্যরকম সময়। নিচে খসে পড়ার ভয়ে সে কাঠ হয়ে যেত, প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলত সাবধানে, সন্ত্রস্ত হাতে বারবার খামচে ধরত কোনো আশ্রয়…।
‘ মশলা’ রাজমিস্ত্রি আবার চিৎকার করে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে একটা মশলার থালা জোগাড় দিয়ে কানু সাংঘাতিকভাবে ব্যালেন্স করে দ্রুত পায়ে বাঁশটার অপর প্রান্তে পৌঁছে যায়।
মানুষের কত ইচ্ছাই অসম্পূর্ণ হয়ে থাকে। একটা বাঁশে শরীরটা হেলান দিয়ে বিশ্রাম করতে করতে কানু ভাবে। কত বিরাট বিরাট অট্টালিকা তার চোখের সামনে উঠে গেল, সে ভেবেছিল সেও তার নিজের মতো করে একটা ছোটো বাড়ি বানাবে— খড় বাঁশ দিয়ে তৈরি হলেও।ওই যে স্কুলটায় শত শত ছেলে-মেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলাধুলা করছে, সে ভেবেছিল সেরকম একটি ছেলে—মেয়ের বাবা সেও হবে। কোথায়, কিছুই তো হল না। সে ভাবা অনুসারে কিছুই হল না।এম কি কত সামান্য ইচ্ছাও সে জীবনে পূরণ করতে পারল না। তার স্ত্রী, একটি ছোট্ট নীরব শান্ত মানুষ। কখনও কোনো জিনিস তার লাগে বলে জানায়নি। কানু ভেবেছিল পয়সা কিছু জোগাড় হলে তাকে একটি ঠান্ডার সময় গায়ে দেওয়ার মতো কাপড় কিনে দেবে। সেই সামান্য বাসনা টুকু বাস্তবে রূপায়িত হল না। এমনকি বিয়ের ঠিক পরেই একদিন ওরা কথা বলছিল, দুজনেই একসঙ্গে একটি ফোটো উঠবে বলে, কতদিন শহরের সেই ফোটোর দোকানগুলির সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করেছে, কোথাও একটা ফোটো উঠা হল না।জোড়া-তালি দিয়ে দিনের ভাতটুকু খাওয়া ছাড়া সে কী করেছে?একে কি বেঁচে থাকা বলা যায়?
‘মশলা লাগা—’নিতাই রাজমিস্ত্রির বিকট চিৎকারটা শোনা গেল।
হায়, পৃথিবীতে এসে সে কী চিহ্ন রেখে গেল? একটা সন্তান সে সৃষ্টি করতে পারল না, এটা বাড়ি সে নিজের জন্য মাটিতে দাঁড় করাতে পারল না। এমনকি স্ত্রীর সঙ্গে তার একটি যুগল ফোটো—এই নগণ্য চিহ্নটাও সে রেখে যেতে পারল না।।
কে বিশ্বাস করবে,এক সময়ে স্ত্রীর সঙ্গে একটা ফোটো তোলার জন্য সে কম চেষ্টা করেনি।এখান সেখান থেকে একটা-দুটো পয়সা বাঁচিয়ে এমনকি তার স্ত্রীও এইজন্য কিছু টাকা সঞ্চয় করেছিল। কিন্তু জীবনে কত সমস্যা আসে, কত নিদারুণ মুহূর্ত আসে। নিয়তির কঠোর খেলা ওদের সেই আকাঙ্ক্ষিত ফটোটা তোলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কে জানবে,একসময়ে তার স্ত্রীর অবস্থা এরকম জীর্ণ-শীর্ণ ছিল না।এই যে এখন তার ভেঙ্গে যাওয়া গাল, লাল পাতলা চু্ল,শীর্ণ দেহ এসব বহু রোগ দুর্ভোগ এবং দুঃসময়ের ফল। এখন হয়তো কেউ বিশ্বাস করবে না যে এক সময়ে রাস্তা দিয়ে পার হয়ে গেলে এই মহিলার দিকে গ্রামের মানুষ তাকিয়ে থাকত।আর কানুর শরীরেও মাংস ছিল। সবল কাঁধ, প্রকাণ্ড বুক নিয়ে সেও ছিল এক সমর্থ জোয়ান মানুষ। ঠিক এসবের জন্য নয়,স্মৃতিচিহ্নের মতো কিছু একটা রেখে যাবার জন্য কানু আর তার স্ত্রী চেয়েছিল ওদের একটা যুগল ফোটো।ভয়াবহ দারিদ্র্যের জন্য সেই ফোটোটা তোলার সামর্থ্য ওদের হল না।
অট্টালিকাটার পশ্চিম দিকের দেওয়ালে প্লাস্টার করার প্রথম দিনেই ঘটনাটা ঘটল। নিতাই রাজমিস্ত্রির চিরাচরিত ‘মশলা লাগা—’বলে মৃত চিৎকারটার উত্তরে হুড়মুড় করে কিছু একটা খসে পড়ল।নিচ থেকে দেখা গেল, কাপড়ের পুঁটলির মতো কিছু একটা নির্মীয়মান বিল্ডিংটার সূচলোঁ লোহার রড গুলোতে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে ছিটকে খসে পড়ছে ।প্রত্যেকেই হৈ হৈ করে উঠল। রাজমিস্ত্রি-যোগালি আশেপাশের দোকানিরা প্রথমে দৌড়ে এল। তারপরে অন্যরা। এমনকি রাস্তা দিয়ে যেতে থাকা দু একটি প্রাইভেট কারও ঘটনাটা কী হয়েছে জানার জন্য থেমে গেল। কিন্তু তখন করার মত কিছু ছিল না। কানু পড়েছে রাস্তার ঠিক পাশে। ভেঙ্গে নতুন করে তৈ্রি করতে যাওয়া একটা বাড়ির একটা পাকা মেঝেতে।লোহার রড গুলি সমস্ত শরীরে আঁচর বসিয়ে দিয়েছে। অনেক ওপর থেকে ছিটকে পড়ার জন্য মাথাটা চুরমার হয়ে গেছে।রাজমিস্ত্রি নিতাই নিজেই এগিয়ে এসে কানুর স্ত্রীকে ডেকে পাঠাল, রাস্তার মানুষগুলি ইতিমধ্যে একটা ছোটো খাটো ভিড়সৃষ্টি করেছে। পুলিশ এল।পাশেই খবরের কাগজের অফিসটা। ক্যামেরা নিয়ে একজন রিপোর্টার দৌড়ে এল।
কানুর স্ত্রী নির্বাক, মুখ বোবা, ডেড বডিটার কাছে নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইল। কান্নার নামে একটা শব্দও তার মুখ দিয়ে বের হয়ে এল না।
পরের দিন দুপুরবেলা পাশ থেকে ছোটো একটি ছেলে দৌড়ে এসে কানুর স্ত্রী কে বলল—‘মাসি এখানে আপনাদের ফোটো ছাপা হয়েছে। ছেলেটির হাত থেকে কানুর স্ত্রী খবরের কাগজটা নিল,সে পড়তে জানে না।শুধু দেখল খবরের কাগজটার মাঝখানের একটি পৃষ্ঠায় কানু এবং তার ফোটো। বেশ বড়ো করে তুলেছে, স্পষ্ট এবং উজ্জ্বল। মাটিতে শুয়ে আছে কানু—শার্ট ছিঁড়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু শরীরটা অটুট। কেবল মাঝে মধ্যে সূচলোঁ লোহার আঁচর। শুকিয়ে কালো হয়ে যাওয়ার রক্তের দাগ। গলার ওপরের দিকটা চেনা যাচ্ছে না। মাথার পরিবর্তে স্তূপীকৃত কিছু মাংস খণ্ড পড়ে আছে বলে মনে হয়। মাথার খুলিটা ফেটে চুরমার হয়ে গেছে। চোখ কানের কোনো চিহ্ন নেই।। চুলের মধ্যে মধ্যে সাদা তরল পদার্থের মতো কিছু একটা ছড়িয়ে পড়ছে ।সেখান টাতে একজন মহিলা কনুইতে থুতনি রেখে চুপ করে বসে আছে— তিনিই কানুর স্ত্রী। চারপাশে সারি সারি রাস্তার দর্শক মানুষ—তাদের শুধুমাত্র পা গুলি দেখা যাচ্ছে।
লেখক পরিচিতি-১৯৬২ সনে অসমের নগাঁও জেলায় গল্পকার,লেখক,সাংবাদিক
মনোজ গোস্বামীর জন্ম হয়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র শ্রীগোস্বামী
অসমের প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র ‘নতুন দৈনিক’,‘আজির বাতরি’, ‘আমার অসম’, ‘দৈনিক
জনসাধারণ’ ইত্যাদি পত্র পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।বর্তমানে ‘আমার
অসম’পত্রিকার মুখ্য সম্পাদক।‘সমীরণ বরুয়া আহি আছে’,‘মই রাজেন বরুয়াক সমর্থন
করো’,’এলুমিনিয়ামর আঙ্গুলি’লেখকের অন্যতম গল্প সংকলন।‘ভুল সত্য’গল্প সংকলনের
জন্য ২০২২ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
অনুবাদক পরিচিতি -১৯৫৮ সনে অসমের নগাঁও জেলার যমুনামুখে বাসুদেব দাসের জন্ম হয়। আজ পর্যন্ত অসমিয়া অনূদিত গল্পের সংখ্যা পাঁচশো পঞ্চাশটিরও বেশি।সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিয়মিত ভাবে অসমিয়া গল্প,কবিতা,প্রবন্ধ এবং উপন্যাস অনুবাদ করে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত সন্থা NEINADএর পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Distinguished Life
Membership এর দ্বারা সম্মানিত করা হয়।প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা একত্রিশটি।