সেই সত্তরের দশক। নকশাল আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশ জুড়ে মানুষের ঢল, বামপন্থী রাজনীতির বিভিন্ন বাঁক, চা বাগানে কোয়ার্টারগুলোতে আত্মীয়ের সমাগম যারা ছিন্নমূল হয়ে ভারতে এসেছে। আজ খাতায় বসে সেই সময়টাকে কাঁটাছেড়া করি আর বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ভাবায়। সভ্যতা কি এগোয় না কি পেছোয়? দেখি, ভাবি, চমকে উঠি, বিমর্ষতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। যাদের ভালবেসেছি একসময় তাদেরকে ভয় করি। রাজনৈতিক ক্ষমতার আস্ফালন ভীতির জন্ম দেয়, মানুষ খোলামেলা না হয়ে সতর্ক হয়ে ওঠে।
তবে সেই সময় হাতছানি দিয়ে ডাকে। সময় সময়, তার ভাষা বড় জটিল। কখন যে শৈশব দেহ থেকে খসে পড়ে, কেউ বুঝতে পারে না। হাসিখুশি শৈশব পেছনের ছায়া হয়ে দূর থেকে দূরে সরে সরে যেতে থাকে। ছুটি অতসব বোঝে না। তবে সে চায় না সে বড় হোক। একদিন কথাটা বন্ধু মণিকে বলল। মণি বলে – তোর বড়দের কথায় কথায় চোখ রাঙানো ভালো লাগে? আমি তো বড় হতেই চাই। জানিস, বাড়িতে বড়রা এলে মা বলে, প্রণাম কর। একদিন পায়ে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করেছিলাম, মা ধমকে উঠল, বলল, এ কেমন প্রণাম? গড় হয়ে প্রণাম কর। বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়ির সবাই বলবে, মা কিছু শেখায়নি। জ্যাঠাইমা, যাঁকে প্রণাম করলাম বলে উঠলেন – এ্যাই মণি, বড়দের সবসময় গড় হয়ে প্রণাম করবি। বিয়ের পর সবাই তো শুধু আমাদেরই দুষবে।
ছুটি অবাক হয়ে শুনল। তারপর বলল- আমরা সবাই তো পায়ে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করি। গড় করি না তো। তবে এজন্যে নয়, আমি বড় হতে চাই না, কারণ আমি এই ইশকুলকে খুব ভালবাসি। ক্লাশ সেভেন এ উঠলে অতটা পথ হেঁটে যেতে হবে রতনপুরে, আর জগমোহন ইশকুলে, ভাবতেই কী যে ভয় হয়।
কিন্তু সময়ের ঘড়ি যে ছুটেই চলে অক্লান্ত অক্লেশে। ক্লাশ সিক্স উতরে সেভেন এ উঠল ছুটি। রতনপুর জগমোহন ইশকুলে ভর্তি হলো সে। এই ইশকুলের বিজ্ঞান শিক্ষক বড়দাদা। তখন সত্তরের দশকের প্রথম পর্যায়। বাতাসে কেমন যেন যুদ্ধ যুদ্ধ গন্ধ।
বড়দাদা অনেক ম্যাগাজিন নিয়ে আসে। সেগুলো একদিন লুকিয়ে খুলে দেখল ছুটি। সেগুলো খোলা অবস্থায় রাখে না বড়দা। কিন্তু সেদিন বিছানায় তার বালিশের পাশে রাখা ছিল। ছুটি খুলে দেখল কয়েক পৃষ্ঠা, খুব কঠিন কঠিন কীসব লেখা। তার বোঝার মতো নয়। সে ভয়ে ভয়ে রেখে দিল। বড়দা এমনিতে খুব খোলামেলা। ভালো গানের গলা। ভরাট গলায় গলা ছেড়ে গান গায়। মা খুব খুশি হন, আর মন লাগিয়ে শোনেন। বলেন – এসব কি নতুন গান? বড়দা নাটক করে, ইশকুলে সরস্বতী পুজোয় একবার নিজে রান্না করল। কী সুস্বাদু লাবড়া খিচুড়ির সাথে। একবার আন্ত:জেলা ক্রিকেট খেলা হলো। বড়দা রেফারি। এমনকি একবার চা বাগানের স্টাফ থেকে যাত্রাপালা হলো, বড়দা রাজা। কণ্ঠস্বর ভরাট। খুব রাজা রাজা লাগছিল।
ছুটির ভারি কষ্ট। ইশকুল দূরে, তাছাড়া ইশকুলটা অনেক বড়, অনেক পড়ুয়া। সে একদিন যায়, তো পরদিন যেতে পারে না। তার কৃশদেহ আর চলতেই চায় না যেন। এরই মাঝে একদিন, সে ইশকুলে যায়নি, সে প্রথম ঋতুমতী হলো। মা তাকে আগেই সাবধান করে রেখেছিলেন। এত কষ্ট কেন সে বুঝতে পারল না। এমন কেন হয়, কেউ তাকে এই নতুন জেগে ওঠা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বুঝিয়ে দেয় নি। কেমন একটা লুকোছাপা ভাব। ছুটি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। মনে হয় সে ছাড়া পৃথিবীর সবাই সুখে আছে। মা-র কাছেও সে কিছু বলে না। একটা শারীরিক সমস্যা, অথচ অসুখ নয়, কিন্তু ভীষণ গোপনীয় কিম্বা লজ্জার। পৃথিবীটার আলো হাওয়া মানুষ এবং এই দেহ সবকিছুতেই কেমন যেন অজানা অন্ধকার, কিন্তু ব্যাপারটা তার ভালো লাগলো না। সেই উইলসন ইশকুল, খোলা মাঠ, নীলাভ বড়াইল পাহাড় শ্রেণী, সবুজ চা বাগানের প্রান্তর, মনে হলো এই কিছুই তার নয়, এমন কিছুই নেই তার, যার সাথে লগ্ন হয়ে যাওয়া চলে। এই যে গোপন রক্তপাত সে কি শুধু তার জন্যেই, না কি সব মেয়েদের জন্যে? এ তো ভালো নয়। কেন শুধু মেয়েরা এই অস্বস্তি ও কষ্ট পাবে? মা-কে এসব প্রশ্ন করতে পারতো, কিন্তু মনে হলো থাক। দু:খ তার নিজের জন্যেই তোলা থাক।
১৯৭১, পাকিস্তানে যুদ্ধের দামামা। বাবা অচিনপুর থেকে মারফি রেডিও কিনে আনলেন।
(ক্রমশ)