সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব – ১৫)

গোপনে গড়েছে কত স্বপ্নিল সাঁকো

প্রীতমের মেধা আছে। তবু সে খুব ভালো কিছু করতে পারবে কি?  পারিবারিক এই অবস্থায় একমাত্র ইশকুলই ভরসা। যেভাবে “বিনি পয়সার ভোজ” সে এত তাড়াতাড়ি শিখে নিল নিজেই ভারি আশ্চর্য হয়ে গেলাম।
মধুরিমাদি বলেন – আমরা সবাই মিলে ওকে একটু বাড়তি যত্ন দিয়ে দেখতেই পারি।
কিন্তু এই মেধাবী ছেলেগুলো শেষ অবদি টিঁকে থাকতে খুব কমই দেখা যায়। একেবারে ব্যতিক্রম ছাড়া। উচ্চশিক্ষার জন্যে অর্থ জোগানো পরিবারের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই সাধারণ ধারায় পড়াশোনা করে চাকুরি জোটে না। একটি ছেলেকে তো মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হতেও দেখেছি। অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েশন করে চাকুরি না পেয়ে অটোরিকশা চালাত আর উল্টোপালটা বকত। অনেকটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল।
– ম্যাম, চোখ তুলে দেখি প্রীতম। আপনি আমাকে রবীন্দ্রনাথ পড়াবেন? আমি রবীন্দ্রনাথকে জানতে চাই।
-আগে বলো তুমি কতদূর জানো কবিকে?
-ম্যাম “দুই বিঘা জমি”, “দেবতার গ্রাস” আর “পোস্টমাস্টার”।
-বাহ কোথায় পেলে? ওগুলো তো সিলেবাসে নেই?
-ম্যাম লাইব্রেরি থেকে নিয়েছি।
-কবিতাগুলো  শেখা হয়ে গেছে?
-হ্যাঁ ম্যাম।
আমার হাতে আপাতত তেমন জরুরি কাজ নেই। বললাম- “দুই বিঘা জমি ” টা বলতে পারবে?
– হ্যাঁ ম্যাম।
প্রীতম নির্ভুল বলে গেল। তারপর লাজুক হেসে বলে – এটা কী সুন্দর ম্যাম – “তাই লিখে দিল বিশ্ব নিখিল দু’বিঘার পরিবর্তে”।
-বাহ। পোস্টমাস্টার পড়ে কেমন লাগল?
-রতনের জন্যে কেঁদেছি ম্যাম। অই পোস্টমাস্টার লোকটার ওপর খুব রাগ হচ্ছিল।
-আচ্ছা?
-ওর মনে কোনও মায়াদয়া নেই ম্যাম। অই যে বলল-“জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে,  ফিরিয়া ফল কী, এই পৃথিবীতে কে কাহার!”
চমৎকৃত হয়ে বলি – এটাও শেখা হয়ে গেছে নাকি? অতটা নয়। যে সব জায়গা ভাল লেগেছে বেশি সেইসব শিখে নিয়েছি।
-“জীবনস্মৃতি ” পড়েছ?
-না ম্যাম.।
,-বেশ আগামীকাল একবার কাল এসো। আমি তোমাকে “জীবনস্মৃতি “দেব। তোমার ভালো লাগবে। তবে আপাতত তোমার একক অভিনয়ের দিকে মন লাগাতে হবে।
– হ্যাঁ ম্যাম। ওটা পারব।
-শুধু পারব নয়,  খুব ভালো পারতে হবে।
-খুব ভালো পারব ম্যাম। তবে আমাকে পুরোটা বুঝিয়ে দিলে আরো ভাল হবে। মধুরিমা ম্যামকে জিজ্ঞেস করলে ম্যাম বিরক্ত হয়ে যান।
-উনি তো রিহার্সাল করাচ্ছেন। তুমি একা নও তো,  অন্যরাও আছে তাই না?
-বুঝেছি ম্যাম।
-তুমি রিহার্সাল শেষে একবার আমার এখানে এসো। যদি হাতে কাজ না থাকে তাহলে বুঝিয়ে দেব। তবে কাজ থাকলে তো পারব না।
– হ্যাঁ ম্যাম,  আমি বুঝতে পেরেছি। রোজ একবার করে এসে দেখে যাব আপনি ফ্রি আছেন কিনা।
৷  ফিরতে ফিরতে আজ সন্ধ্যে। ইশকুল ফেরত আজ একটা মিটিং ছিল। খিদে পেয়েছে নিদারুণ। আজ রান্নার দিদি আসেনি। শুধু একটা প্রাতরাশ করে তড়িঘড়ি বেরিয়ে এসেছি। এত দেরি হয়েছে যে কখন দুপুরের খাবার সময় পেরিয়ে গেছে।
. পাশের ফ্ল্যাটের শোভনাদি দরজায় দাঁড়িয়ে, আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, আজ তো তোমার রান্নার মেয়ে আসেনি, তাই না?  রান্না করে গেছিলে?
ক্লান্ত হেসে বললাম – সময় করে উঠতে পারিনি।
শোভনাদি বললেন – হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছি, তোমাকে তো তাড়াতাড়ি বেরোতে হয়। সময় কোথায়।
৷ শোভনাদির বাড়ি থেকে খাবার এল। মনে হলে ঈশ্বর এই মুহূর্তে ছুঁয়ে আছেন শোভনাদিকে।
ভারি তৃপ্তি পেলাম। মনে হল যাবতীয় গল্পের উৎসমুখে কোথাও না কোথাও এই ঐশ্বরিক ছায়া ছুঁঁয়ে থাকে তাই কি বারবার কলম হাতে তুলে নিতে হয়। কোথাও তো কিছু আছে যা ঐশ্বরিক।
(ক্রমশ) 
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *