সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব – ৪১)

গোপনে গড়েছে কত স্বপ্নিল সাঁকো

বুধুয়া থামলো। লটপটিয়ে একবোঝা ঘাস সিঁড়ির নীচে রেখে ফিটারবাবুর বাড়িতে আরেকটা ঘাসের বোঝা দিয়ে এলো। তারপর সিঁড়ির নীচে এসে বিরাট বড় ঘাসের বোঝা মাথায় তুলল, ল্যাকপ্যাকে পায়ে সিঁড়ি ভাঙল, গোয়ালঘরে মাচার ওপর ঘাসের বোঝা তুলল তারপর দাঁড়িয়ে রইল।
ছুটি পেছন পেছন আসছে। সে বুধুয়াকে বলল – এই দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
-ঠাকরান কোথা গেল? লাকড়ি গুলান তুলতে হবেক লাই?
– হঁ তুলতে তো হবেক। তোল।
বুধুয়া আঁটি আঁটি করে সব তুলে পেছনের বারান্দায় গুছিয়ে রাখে। তারপর লাল চা একগ্লাস, দুটো মোটা রুটির সাথে নুন আর কাঁচালঙ্কা।
পেছনের জঙ্গুলে খাদে কোলাব্যাঙ ডাকছে। ছোড়দি এসে জিজ্ঞেস করে- এই বুধুয়া,  কি ডাকছে রে?
বুধুয়া  চা খেতে খেতে বলে – ব্যাঙ।
ব্যাঙের আওয়াজটাও তেমনই। প্রথমে ডাকল ভোঁ…তারপর অল্প বিরাম নিয়ে -পোঁওওও। এই ব্যাঙটা ডাকলে ছোড়দি আর ছুটি হেসে কুটিকুটি হয়ে যায়। আজও এইভাবে হাসি চলছে। বুধুয়া সশব্দে চা খায় আর তাদের হাসি দেখে আরও জড়োসড়ো হয়ে যায়। ছোড়দি ফের জিজ্ঞেস করে – কি ব্যাঙ?
বুধুয়া বলে – ঢাঁশ ব্যাঙ।
ছুটি বলে – তোকে কামড়ায়?
বলতেই বুধুয়া বিপরীত পানে তাকিয়ে সজোরে নাক টেনে রোগা দুটো হাঁটু কাঁপাতে লাগলো। বুধুয়ার সবসময়েই নাকে চাপা সর্দি থাকে। এখন সে উত্তেজিত,  উদ্বেল, উদ্বিগ্ন। সুতরাং নাক টানা চলছে, বসে থাকা অবস্থায় হাঁটু নাচানো। হাতের চা চলকায়। ও এইমুহূর্তে চাইছে আমরা যেন এখানটা থেকে চলে যাই। কিন্তু এখন এখানটা ছেড়ে কে যায়! ব্যাঙ সংক্রান্ত আরও কিছু তথ্য আদায় না করা পর্যন্ত  আমরা নট নড়নচড়ন। তবে মা এসে আমাদের তাড়িয়ে দিলেন।  বেচারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
তাতে কী হলো! আজ না হয় বুধুয়া হাঁফ ছেড়ে বাঁচল কিন্তু এর পরের কাল? পরশু?
সবাই মিলে একদিন বুধুয়াকে চেপে ধরল।
-এই বুধুয়া তুই বিয়ে করেছিস?
– হঁ। লেকিন….
-লেকিন?
-লেকিন বউ হামার সাথে নাই থাকে। কেরুয়ার ঘরে উঠে গেল।
– কেরুয়া তো তোর ছোট ভাই, তাই না?
– হঁ হঁ – বলে বুধুয়া হাসল।
এখন বুধুয়ার ভয় কিছুটা কমেছে।
ছুটি বলে – তোর তো সবসময় সর্দি থাকে তাই থাকল না বউ তোর সাথে,  দু:খ করিস না।
–  দু:খ হামি লাই বুঝি। আমার গায়ে এচোড় আছে, তাই চইল্যে গেল।
– এঁচোড় কি?  ওটা তো খায়,  কাঁচা কাঁঠাল…
বুধুয়া তার শরীর থেকে চিমটি দিয়ে একটা পোকা এনে দেখায়। অনেকটা উকুনের মতো। তারপর ফট করে দু’আঙুলের নখে মেরে ফেলে।
ছুটি বলে – ছি: তুই এত নোংরা?
-লেকিন কেরুয়ার গায়ে উসব নাই। ওখানে বউ ভালো আছে। কিন্তু হামার শাদি হইয়্যে ছিল জব্বর।
লয়া জামাই, লয়া পোশাক,  ধুতি পাঞ্জাবী,  লয়া সাইকেল…
বুধুয়ার বিয়ের গল্পের গন্ধে সবাই বুধুয়াকে চেপে ধরে- বল বল!
– তুই সাইকেল চালাতে পারিস?
-উসবের দরকার কি?  টাইন্যে টাইন্যে লিয়ে যাবেক। মাথার ওপর ছাতা ধইরবেক।
– আর খানাপিনা?
– হঁ উ তো আছেই। হামরা গরীব।  তবে হইয়্যেছে। মাংস ছিল। খাসি কাইট্যেছিল। ধেনো ছিল।
– তুই খেয়েছিস বুঝি ধেনো?
– না না হামি নাই খাই উসব। ঐ শালাটা, বউএর ছোট ভাইটা জোর কইর‍্যে খাইয়্যে দিল।
– তো বিয়ে করতে পেরেছিস ঠিকঠাক?
– লাই লাই। হামার পা টইলছ্যে। কি যে হইল্য বইলতে লাই পারব। তবে কিন্তুক সাইকেল আর মাথার ওপর ঘাস নাইখে, ছাতা… অইটা মনে হইল্যে বহোত তাকত আইস্যে যায়, হামি বুইঝতে পারি। ঘাস কাইটতে কাইটতে মনে পইড়্যে গেল যখন তখন আরো বেশি করে ঘাস কাইট্যে লিলাম ব্যস, কাম হইয়্যে গেল।
মা বুধুয়াকে একটা পুরনো প্যান্ট দিয়েছেন।  বুধুয়া খুব খুশি।
এদিকে একদিন রাতে আমাদের রান্নাঘর চুরি হলো।
চুরি হলো শুধু খাবার, কাঁসার বাসনপত্র কিছু নেয়নি। চারটে রুটি ছিল আর ট্যাংরা মাছের ঝোল। আর মাটির পাত্রে জিইয়ে রাখা কুড়িটা কৈ মাছ,  এককৌটো চিনি। বড় বড় কাঁসার থালা বাসন কিচ্ছু নেয়নি।  চুরির চরিত্র দেখে বড়দাদা গম্ভীর হয়ে বলে- তোদের খিদে কতটুকু আমরা বুঝি। আর এই যে বুঝতে পারছি তার জন্যে এই খিদে তোদের থাকবে না একদিন দেখিস। ঠিক দেখিস তোরা পেট পুরে খেতে পাবি। সেই দিন আসবেই, সে আর দেরি নেই।
ক্রমস
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।