সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব – ৮)

গোপনে গড়েছে কত স্বপ্নিল সাঁকো
ইশকুলে পা দিয়ে হতবাক ছুটি, অনেকটা দিশেহারা। বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে শৈবাল মাস্টারমশাইকে বলছেন -দিয়ে গেলাম। এখন আপনি দেখবেন।
মাস্টারমশাই বলছেন – চিন্তা করবেন না, আজ প্রথম দিন তো, একটু ভয় পাবে। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।
৷ দ্বিতীয় ভাগের দুটো বেঞ্চ পুরো ভর্তি। চওড়া ইশকুল বারান্দা। এই বড় ইশকুল কক্ষে ঢোকার জন্যে পর পর চারটি দরজা। একেবারে শেষ দরজার কাছে দ্বিতীয় ভাগের দু’খানা ডেস্ক বেঞ্চ। দুটোতেই বসার কোনও জায়গা নেই। দরজার একেবারে কাছে তার বসার জায়গা করে দিল একটি লাল ফ্রক পরা মেয়ে।তার হাতে একটা বেত, সারা ঘরে সে বেত হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেঞ্চের পাশে এসে বলল – এই তোরা চেপে বোস, ওকে জায়গা দে।
৷ জড়োসড়ো হয়ে ছুটি বসল। দারুণ হৈ হট্টগোল চলছে। এখনও ইশকুল পিরিয়ড শুরু হয়নি। এতবড় একখানা ঘর, এখান থেকে মাস্টারমশাইকে দেখাই যায় না। ছুটি লক্ষ করল, এখানে ছেলেমেয়েরা একসাথেই বসে। তার পাশে একটা মেয়ে বসেছে, কী চমৎকার ডিজাইন তার পরনের ফ্রকটির। খুব পছন্দ হলো ছুটির মেয়েটিকে। মেয়েটি হেসে বলল -তোমাকে তো চিনি, তোমার নাম ছুটি, তোমার বাবা তো সুধা স্যার, বড় ইশকুলের স্যার।
এখানে উইলসন ইন্সটিটিউটকে সবাই বড় ইশকুল বলে। মেয়েটিকে সে-ও দেখেছে, সম্ভবত তার নাম মণি। সে জিজ্ঞেস করল-তুমি কি মণি?
– হ্যাঁ রে। আমার বাবা সুজিতবাবু। টিলাবাবু।তোদের বাড়ি গেছি তো।
– হ্যাঁ আমরা একসাথে উঠোনে খেলেছি রে।
মেয়েটা খুশি হয়ে বলে – আমরা বন্ধু হব, কেমন? রাগ হলে আড়িও দেব না।
ছুটি খুশি হয়। তারপর ভয়ে ভয়ে বলে – মাস্টারমশাই কি বেত মারে?
-হ্যাঁ রে মারে তো। ভয়ে মরে যাই। ঐ যে ছেলেটা দেখতে পাচ্ছিস, গতকাল খুব মার খেয়েছে। হাত কেটে রক্ত পড়ছিল। ইশকুল তো, মারধর হবে। ভয় পাস না।
ততক্ষণে সেই লাল ফ্রক পরা মেয়েটি ছাত্র ছাত্রীদের কাছে গিয়ে বলছে- দাঁত দেখি, নখ দেখি। ঠিকঠাক না থাকলে বলছে হাত দে, কাঁদোকাঁদো মুখে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হাত মেলে ধরার পর সপাং। কেউ ভেউভেউ করে কেঁদে উঠছে, কেউ হাত ঝেড়ে ফেলছে। ভয়ে ছুটির বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটছে ঢিব ঢিব।
সে ভয়ে ভয়ে বলে – জানিস বাড়িতেই তো আমি অ আ ক খ শিখলাম, কিন্তু একদিনও মার খাইনি জানিস। আমাদের ভাইবোন কেউ মার খায়নি।
-তোরা দুষ্টুমি করিসনি তাই।
-তুই মার খেয়েছিস কখনও এখানে?
-একদিন মেরেছিল ধারাপাত আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। দেখি তুই কি কি বই এনেছিস? শুধু বর্ণবোধ দ্বিতীয় ভাগ? ধারাপাত আনিসনি?
-না। আমাকে মারবে?
-জানি না। আজ প্রথম এসেছিস, বলিস, আমি তো জানি না, বেশ কাল আনব।
-একটু পরেই নামতা শিখতে হবে এইরকম দুলে দুলে… বলে সে দুলে দুলে দেখায়, দুই এক্কে দুই/ দুই দুগুণে চার…
ছুটির দশের ঘর পর্যন্ত নামতা মুখস্থ আছে। জিজ্ঞেস করলে সে বলতে পারবে, মণিকে সে কথাটা বলল। মণি হেসে বলে – তাতে কি, ইশকুলে দুলে দুলে শিখতে হয়, সামনে বই মেলে ধরে, নাহলে মারবে।
ছুটির মুখ শুকিয়ে গেল।
এইসময় প্রচন্ড গর্জনে আমূল কেঁপে উঠল ছুটি। শৈবাল স্যার বেত দিয়ে মারছেন একটি লম্বা ছেলেকে।
গোটা ইশকুলের হৈ হট্টগোল চুপ। তার মধ্যে সে আনেনি ধারাপাত। তাকে মারবে নিশ্চিত। বাড়িতে এখন মা হয়ত শচীন দেব বর্মণের গান গেয়ে গেয়ে রান্না করছেন। বুধিয়া চ্যালাকাঠ চিরতে চিরতে এসে বলবে – ঠাকরান, একগ্লাস জল দিবি? গলাটা শুকায় গেল।
তাদের বড় ঘর ও রান্নাঘরের মাঝখানে বারান্দায় বুধিয়া বসবে। মা প্রথমে জল দিয়ে বলবেন, একসাথে চা খেয়ে যা। চা দিয়ে মা একটা বেতের মোড়া নিয়ে অদূরে বসবেন। মা – ও এককাপ চা খাবেন। বুধিয়াকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করবেন। ঐ বারান্দার ওপর বৃষ্টি আটকানোর জন্যে যে টিনের নাওরা বাঁধা হয়েছে সেখানেই বুড়ি মেনিটা বাচ্ছা দিয়েছে। মেনিটা লাফ দিয়ে ওপরে উঠবে, বাচ্ছাদের জন্যে মেনির ডাক অন্যরকম। ম্যাও মউু ররর….
মণি তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল -এই ছুটি, এদিকে আসছে রে।
ছুটির শ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়। না, শৈবাল মাস্টারমশাই নয়, আসছে হাতে বেত নিয়ে ঘোরা মন্ত্রী, দ্বিতীয় মানের ছাত্র।
মণি ফিসফিস করে বলল- শিক্ষামন্ত্রী।
-এই, সবাই ধারাপাত খোলো। আজ পাঁচ ছয়। বল, পাঁচ এক্কে পাঁচ
সবাই চেচিয়ে বলে – পাঁচ এক্কে পাঁচ
– পাঁচ দুগুনে দশ
সবাই চেঁচিয়ে – পাঁচ দুগুণে দশ
এবার শিক্ষামন্ত্রীর নজর গেল ছুটির দিকে। – এই, ধারাপাত খোল।
মণি বলে – ও আজ নতুন এসেছে, ধারাপাত আনেনি।
শিক্ষামন্ত্রী কথাটা কানে না তুলে চেঁচিয়ে বলে – মাস্টারমশায়, বই আনেনি।
– কে বই আনেনি?
ছুটির সামনেই দরজা। বাইরে উন্মুক্ত খোলা মাঠ। এক্ষুনি ছুটে বেরিয়ে তো যাওয়া যায়। সামনের ইশকুলেই বাবা আছেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ।
শ্লেট আর বইটা তুলে দে ছুট।
পেছন থেকে সমস্বরে চিৎকার -মাস্টারমশয় ভাগে ভাগে…
বাইরে কী সুন্দর খোলা পৃথিবী… চারপাশ রোদে ভাসছে। সে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে এসে উঠে পড়ে উইলসন ইন্সটিটিউটের লম্বা বারান্দায়। পেছনে কেউ কি আসছে?
শেষ ক্লাসরুমটাতে পড়াচ্ছেন সুধাময়। আগুপিছু না দেখে ছুটি সোজা ছুটে এসে সামনের বেঞ্চে বসে পড়ে। মেয়েদের বেঞ্চ। ওরা হাসে। ছুটির মনে হয় এরা তার বাড়ির মানুষের মতই ভারি আপন।শুধু মণির জন্যে একটু মনটা কেমন করে ওঠে।
ক্রমশ