• Uncategorized
  • 0

হৈচৈ ভ্রমণ কাহিনীতে অনিন্দিতা শাসমল

অরণ‍্যে ঘেরা চিল্কিগড় আর সুন্দরী ডুলুং নদীর টানে 

চিল্কিগড় আমার কাছে এক নস্টালজিয়ার নাম—১৯৯৪ সালে প্রথম কলেজ ট‍্যুরে যাওয়া অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার জামবনী ব্লকের চিল্কিগড়ে।সুন্দরী ডুলুং নদী বয়ে চলেছে এখান দিয়ে।তার পাশেই ঘন অরণ‍্যের মধ‍্যে অবস্থিত কনকদুর্গার মন্দির।এত ভালো লেগে যায় জায়গাটা তখন থেকে,
সুযোগ পেলেই চলে যাই ,অনেক মধুর স্মৃতি বিজড়িত এই চিল্কিগড়ে।
বিগত বছরটার অনেক যন্ত্রণা ও কষ্ট থেকে,বদ্ধ জীবন থেকে একটু মুক্ত আলো বাতাস আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের টানে,গত ৪ঠা জানুয়ারি,২০২১ এ সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলাম বর্তমান ঝাড়গ্রাম জেলার (পূর্বে পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্তর্ভুক্ত মহকুমা ছিল) চিল্কিগড়ে। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরে অবস্থিত সুন্দরী ডুলুং নদী।আর এই নদীর তীরেই ঘন অরণ্যের মাঝখানে অবস্থিত চিল্কিগড়ের কনকদুর্গা মন্দির।এই অরণ‍্যাঞ্চল মূলত শাল পিয়ালের হলেও ,উদ্ভিদ গবেষকদের মতে,এখানে প্রায় ৪৩৩ প্রজাতির ওষধি বৃক্ষ ও লতাগুল্ম পাওয়া যায়।এবারে গিয়ে দেখলাম,সমস্ত বনাঞ্চল সুন্দর করে সাজানো ও প্রতিটি ওষধি বৃক্ষের গায়ে তাদের সাধারণ নাম ও বিজ্ঞানসম্মত নাম লেখা আছে। মন্দির চত্বরের প্রবেশদ্বার থেকে মূল মন্দির পর্যন্ত এই ওষধিবৃক্ষ ও লতাগুল্মের ছায়াঘন রাস্তায় ঢুকেই অদ্ভুত এক ভালোলাগার শিহরণ অনুভব করলাম।মূল মন্দিরের চারপাশে অনেক সাজানো দোকান,মিস্টি নারকেল ও অন‍্যান‍্য সামগ্রীসহ পুজোর উপকরণ সাজিয়ে বসে আছে । মন্দিরের মাথায় বিষ্ণুর চক্র চোখে পড়লো।মন্দিরের স্থাপত‍্যশেলী বেশ আধুনিক। একরত্ন মন্দিরে রয়েছে গর্ভগৃহ ও চারদিকে খোলা বারান্দা।সামনের দিকের খোলা টিনের চালা,যে প্রশস্ত জায়গায় আছে হোমকুন্ড আর বলিদানের স্থান।করোনা পরিস্থিতির জন‍্য একজন রক্ষীর তদারকিতে , দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে একজন একজন করে মন্দিরে প্রবেশ করে পূজো দিচ্ছেন।স্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারণ ও নামগোত্র সহ বেশ ভক্তিভরে ভক্তদের পুজো দেবীর কাছে উৎসর্গ করছেন পুরোহিত।দেবী অষ্টধাতু নির্মিত দুর্গার বিগ্রহ এবং অশ্বারোহীনি চতুর্ভুজা।
কথিত আছে যে,চিল্কিগড়ের সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহ মত্তগজ ১৭৪৯ সালে এই মন্দির নির্মাণ করেন এবং স্বপ্নাদেশ পেয়ে স্ত্রীর হাতের কাঁকন দিয়ে এই মূর্তি তৈরী করান। স্থানীয় লোকেরা বলেন,প্রতি অমাবস‍্যায় এখানে নাকি নরবলি হত।দেবীর আদেশে নরবলি বন্ধ হয়।এখনও প্রতি বছর দুর্গাপুজার সময় নবমীর দিন পাঁঠাবলি হয়।প্রাচীন পঞ্চরত্ন মন্দিরটি জরাজীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর একই চত্বরে তৎকালীন রাজা জগদীশচন্দ্র দেও ধবলদেবের উদ‍্যোগে পাশেই নতুন মন্দির নির্মিত হয় ১৯৩৭ খৃষ্টাব্দে। ১৯৬০ সালে রাজতন্ত্র বিলোপের পর এই মন্দির থেকে সোনার বিগ্রহ চুরি যায় ।তারপর তিনদশক ধরে মূর্তি ছাড়াই পুজো হত।রাজার বংশধরেরা পরবর্তীকালে কনকদুর্গার অনুরূপ একটি অষ্টধাতুর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন।তারপর থেকে তিনিই মহাসমারোহে পূজিত হয়ে আসছেন।শহরের কোলাহল থেকে বহুদূরে প্রাচীন রীতিতে আড়ম্বরহীন এই পুজো।মন্দির চত্বরে চোখে পড়লো কল্পতরু গাছ। ভক্তদের মনস্কামনা পুরণের জন‍্য গিট বাঁধা অজস্র কাপড় গাছের ডালে ঝোলানো।মন্দিরের ডানদিকের সরু ছায়াঘেরা রাস্তা নেমে গিয়ে মিশেছে ডুলুং নদীতে। এই সরু রাস্তায় অসংখ্য ব়াঁদর অপেক্ষায় আছে,পর্যটকদের হাত থেকে কলা ,বাদাম ইত‍্যাদি খাওয়ার জন‍্য।
নদী থেকে ফিরে আবার মন্দিরের পাশ দিয়ে গিয়ে প্রবেশ করলাম ঘন জঙ্গলে।আশ্চর্য হয়ে দেখার মতো , মন্দির সংলগ্ন প্রায় ৬৮ একর বনভূমি ওষধি গাছ ও লতাগুল্ম দিয়ে ঘেরা। সমগ্র ভারতের উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা গবেষণারয় কাজে এই বনভূমিতে আসেন।এই মন্দিরের একটু দূরেই বহু প্রাচীন নাক্সভোম বৃক্ষের সন্ধান পাওয়া গেছে।এছাড়াও আছে অর্জুন ,পীপুল ,গুলঞ্চ,মৃতসঞ্জীবনী ,অতসী,পুনর্নবা,নিম,বাবলা,বাঁদরলাঠি ইত্যাদি গাছ।রাজার উত্তরসুরীরা আয়ুর্বেদ স্বাস্হ্যচর্চার জন‍্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে এমনকি বিদেশ থেকেও ওষধি বৃক্ষ সংগ্রহ করে এই ওষধি বনভূমি তৈরী করেন।পরিচর্যার অভাবে দামী দামী ওষধি গাছ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের জন‍্য রক্ষী রাখা হয়েছে। মন্দিরের মূল গেটের বাইরে একটি হোটেল দেখলাম, যা আগে ছিলনা। যত্ন সহকারে মাছ ডিম সবজি ও গরম ভাত পরিবেশন করছেন স্থানীয় মহিলা।যদিও মন্দিরে ঢোকার মুখে পর্যটন দপ্তরের উদ‍্যোগে নবনির্মিত কংক্রিটের রাস্তা , বিশাল কংক্রিটের তৈরী ‘অশ্বদুয়ার’,স্থানে স্থানে সৌন্দর্যায়ন চিরচেনা সেই প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে একটু আলাদা লাগলো এবার গিয়ে।
গেট থেকে ডুলুং নদী পেরিয়ে প্রবেশ করলাম চিল্কিগড় রাজবাড়িতে। বিশাল লোহার দরজা পেরিয়ে বড়সড় চত্বর।আছে প্রাচীন একটি অশ্বত্থগাছ ও তার পাশেই একরত্ন মন্দির। ডানদিকে রাজপ্রাসাদ ও বামদিকে কালাচাঁদের একরত্ন মন্দির।এই দুটি মন্দিরের স্থাপত‍্যশেলী বেশ অন‍্যরকম। প্রাসাদের ঘরগুলি তালাবন্ধ,ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই।নীচের তলায় সরকারী অফিস ভাড়া দেওয়া আছে। প্রাসাদ চত্বরে আছে এক নিসঙ্গ কুয়ো।
ফেরার পথে অরণ‍্যসুন্দরী ঝাড়গ্রাম শহরের প্রান্তে অবস্থিত মিনি জুলজিক‍্যাল পার্কে (ডিয়ার পার্ক নামে খ‍্যাত) গিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখলাম, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে শাল জঙ্গলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ‍্যে বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ,ব়াঁদর,হনুমান, সাপ,নীলগাই,ভালুক,খরগোশ পাখি এমনকি চিতাও।সন্ধে ছটা পর্যন্ত চিড়িয়াখানা খোলা। শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত বসে ছিলাম ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ঝকঝকে সুন্দর বাঁধানো বসার জায়গায় ; গেটের বাইরে বেরিয়েই প্রায় অন্ধকার নেমে আসা রাস্তায় ঠিক উল্টোদিকের চায়ের দোকানে বাঁশের বেঞ্চে বসে শীতের আমেজের মধ‍্যে উনুন থেকে সদ‍্য নামানো গরম চপ ,ওমলেট আর চা। অবশেষে অ্যাডভেঞ্চার !রাতের অন্ধকারে কাঁসাই নদীর ওপর ব্রীজ পেরিয়ে ধেড়ুয়া,গুড়গুড়িপালের জঙ্গলের হাতির ভয় অতিক্রম করে পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরের মেদিনীপুর শহরের আলোর দিকে যত এগোতে থাকলাম , মন কেমন করা অনুভব থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এল অস্ফুটে….এমন অপার সৌন্দর্যের আকর্ষণে খুব তাড়াতাড়ি আবার তোমার কাছে আসবো প্রিয় চিল্কিগড়।ততদিন খুব ভালো থাকো অরণ‍্যের গাছ,ফুল ,পাখিরা…. ভালো থেকো অরণ্যসুন্দরী….
“ভালো থেকো ফুল,মিষ্টি বকুল,
ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান,ভাটিয়ালি গান,
ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ,মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি,সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।”
—হুমায়ুন আজাদ

কলকাতা থেকে কিভাবে যাবেন — রেলপথে কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১৫৪ কিমি।হাওড়া থেকে সকালবেলায় ছাড়ে ইস্পাত এক্সপ্রেস ও বিকেলে স্টীল এক্সপ্রেস।এছাড়াও রয়েছে কিছু প‍্যাসেঞ্জার ট্রেন।আড়াই -তিনঘন্টা মধ‍্যে ঝাড়গ্রামে পৌঁছে ,স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে চিল্কিগড় ঘুরে বিকেলে ডাউন ইস্পাত এক্সপ্রেসে হাওড়া ফেরা যেতেই পারে।সড়কপথে কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১৭৮ কিলোমিটার,সময় লাগবে সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টা। তাছাড়া ঝাড়গ্রামে সরকারি আবাসন ছাড়াও রয়েছে অনেক বেসরকারি হোটেল।যেমন — ঝাড়গ্রাম টুরিস্ট কমপ্লেক্স -৭৪৭৭৪২৪৮৫৪ ,অরণ‍্যসুন্দরী গেস্ট হাউস — ৯৫৪৭৬৬৮৯৬৬ ।এছাড়াও আছে অনেক ছোটো বড় হোটেল ,যেমন শান্তিনিকেতন ,ডুলুং গেস্ট হাউস ইত্যাদি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *