সুন্দরী আর সৌন্দর্যের প্রাচুর্যে সুন্দরবনের অপরূপ শোভা…
ঝড়খালী শুনলেই বেশ মনটা অফুরান হাওয়ায় ভরে ওঠে। চারিদিকে ঘন সবুজ গাছেরা আর তাদের বুক চিরে এগিয়ে চলেছি অপার জলরাশি সমুদ্রের সন্ধানে। যদিও বা খোরখালী তে ঠিক সমুদ্র নয়। মাতলা নদীর সঙ্গম। ঝড়খালী যেটি ঘাট থেকে নৌকায় প্রায় ১ঘন্টা জলপথে গেলে তারপর দেখা মিলবে সমুদ্রের। সমুদ্র যেমন দু-পার নিঃশেষ করা অমোঘ জলরাশি নিয়ে বয়ে চলে, এখানে তার রূপ ভিন্ন। ঐপারে তাকালে দেখা মিলবে ঘন জঙ্গলের।
সে যাই হোক, ট্রেকারে করে ক্যানিং স্টেশন থেকে ঝড়খালী পৌঁছাতে একদম ঘড়ির কাটায় কাটায় ১ঘন্টা তিরিশ মিনিট লেগেছিল। আমি আগেই বলেছি যে যাত্রাপথ টা বেশ সু-দীর্ঘ। তাই এখানে নেমেই দেখা মেলেনি স্বপ্নের জলরাশি কিংবা ঘন জঙ্গলের। এরপর ওই ট্রেকার স্ট্যান্ড থেকে অটো তে করে আরও প্রায় ১৫মিনিট গেলে তারপর দেখা মিলেছিল সৌন্দর্যের।
এই ট্রেকার পর্যন্ত রাস্তার চারপাশ জুড়ে ছিল কেবলই গাছপালা, আর মাঝখান দিয়ে সরু পথ। মাঝে কিছু কিছু জায়গায় ছোট জনবসতি।
আমরা যখন অটো তে করে যাচ্ছিলাম সেই দৃশ্য ছিল অপূর্ব। তখন আমরা প্রায় চলেই এসেছি সুন্দরীর সান্নিধ্যে। তাই সেই রাস্তার চারপাশ জুড়ে ছিল গুচ্ছ গুচ্ছ সুন্দরী গাছ। আর তার স্বাসমূল ওপরের দিকে উঠে এসে বেশ সুন্দর শোভা তৈরি করেছিল। আমরা যখন যাচ্ছিলাম তখন জোয়ার চলছিল, তার জন্য প্রায় অনেকদূর পর্যন্ত জল চলে এসেছিল। রাস্তার সেই সব সুন্দরী গাছের মধ্যেই সমুদ্রের জল এসে পড়েছিল। প্রথম দর্শনে মনে হবে জলের মধ্যেই যেন জঙ্গলটা। অপরূপ চোখ জুড়ানো শোভা।
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, ট্রেকার থেকে নেমে পাশেই অটো স্ট্যান্ড, সেখানে গিয়ে বলতে হবে জেটি ঘাট যাবো। সুন্দরবন বলতে তারা সেই পুরো অঞ্চল টাই বোঝে।
আমরা প্রায় যখন ঝড়খালী জেটি ঘাট পৌছালাম তখন সূর্য্য ঠিক মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে। যেহেতু আমরা ভরা গ্রীষ্মে গেছিলাম, তাই গরমে বেশ হাঁসফাঁস অবস্থাই হয়েছিল। তাই মনোরম সময় হিসাবে শীতকাল ই ভালো।
যেহেতু অফসিজিন এই সময়টা তাই দোকান পাট ও সেরম ছিল না। ওই যেটি ঘাটের পাশে প্লাস্টিক ছাউনি দিয়ে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা ডাব, শরবত, বিস্কিট, কেক ইত্যাদির যৎসামান্য দোকান খুলে বসেছিল।
সারাদিনের জন্য যাওয়ার হলে নিজেদেরই বেশ খাবার ব্যবস্থা করে নিয়ে যেতে হবে। ওখানে সেরম কোন খওয়ারের দোকান নেই। ট্রেকার স্ট্যান্ড এ কয়েকটা মিষ্টির দোকান আছে।
জেটি ঘাট টি বেশ মনরোম। এই রোদের দাবদাহের মধ্যেই প্রাণ যেন জুড়িয়ে যায় উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া বাতাসে। সামনে অপার জলরাশি। আর জলরাশির ওপরের চোখ গেলেই দেখা যাবে ঘন সবুজের। আর সুন্দরীর জলের মধ্যে বেড়ে ওঠার সুন্দর দৃশ্য। যেহেতু অফসিজিন ছিল তাই লঞ্চ বা নৌকার সংখ্যা কম ছিল।
যারা নদীর ওপর ১-২ থাকতে চান, তাদের জন্য লঞ্চগুলি। ওগুলো আগে থেকে বুক করতে হয়। সেখানে শোয়ার ব্যবস্থা ও রান্নার ব্যবস্থা আছে। আর দিন বা ঘন্টা বেসিস এর জন্য ছোট নৌকা গুলি। ওগুলো ঘন্টা হিসাবে টাকা নেয়। লঞ্চে থাকলে ওরা জঙ্গলের মধ্যে কয়েকটি দর্শনীয় স্থান দেখায়। যেমন গভীর জঙ্গলের মধ্যে টাওয়ার এ উঠে সুন্দরবন দর্শন। এখানে বেশ আকর্ষণীয় তথ্য পাই এক স্থানীয় এর কাছ থেকে। তিনি বলেন নদীর ওপারে অনেক ছোট ছোট গ্রাম আছে। সেখানেরই একটা গ্রামের নাম বিধবা গ্রাম। এরকম নামের কারণ হিসেবে তিনি বর্ণনা করেন যে বাঘ নাকি সেই দু, তিন দিন ছাড়া ছাড়াই সেই গ্রাম থেকে একজন করে মানুষ নিয়ে যায়। লঞ্চে কয়েকদিন দিন থাকলে এসব দেখার সুযোগ মিলবে।
এই সুন্দরবনের সব থেকে আকর্ষণীয় বস্তু হলো রাস্তার চারধারে ভরে থাকা জবার গাছ। বিভিন্ন ধরণের জবা। কি অপরূপ প্রেত্যেকটার গড়ন আর রং।
জেটি ঘাটের পাশেই রয়েছে একটি ন্যাশনাল পার্ক। সেটি বিকেল ৪টে পর্যন্ত খোলা থাকে। আমাদের হাতে সময় থাকার দরুন জেটি ঘাট থেকে একটু ডাবের জলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে, ন্যাশনাল পার্ক এ ঢুকলাম।
প্রবেশ মূল্য হিসাবে ৩০টা প্রত্যেকের লাগবে। ন্যাশনাল পার্ক এ আকর্ষণীয় কিছুই নেই। আর গরমে তো আরও অস্বস্তিকর। তবে দেখার মতন রয়েছে বিভিন্ন ধরণের জবার গাছ। গোলাপি, লাল, কমলা, কি অপরূপ। কোনটা পাঁচ পাপড়ির জবা, কোনটা ঝিরি জবা, আবার জবার মাথায় আরেকটা ছোট জবা, এরকম বিভিন্ন সব প্রকৃতি তাদের।
এছাড়া রয়েছে খাঁচা বন্ধী ২টি বাঘ, কয়েকটি কুমির ও দুটি হরিণ। খুব ভাগ্য ভালো থাকলে শুনতে পাবেন বাঘের ডাক।
আরও একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো লাল কাঁকড়া। আমরা জেটি ঘাটে থাকাকালীন জোয়ার কমে ভাটা শুরু হয়। ফলত চারিদিকের জল নামতে থাকে। তখনই দেখা মেলে এই কাঁকড়াদের। কি অসম্ভব সুন্দর। ছোট ছোট লাল কাঁকড়া চারিদিক জুড়ে জেগে ওঠে। চোখ জুড়ানো দৃশ্য।
মোটামুটি একদিনের জন্য এই দেখার। আর নদীতে থাকলে সে আলাদা কথা।
আমরা আবার অটো তে করে যখন ট্রেকার স্ট্যান্ড এ আসলাম তখন ঘড়িতে ২টো বাজে। খিদে তৃষ্ণায় তখন প্রাণ ওষ্ঠাগত অবস্থা। তাই ট্রেকারে ওঠার আগে আসে পাশের মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি আর ঠান্ডা পানীয় তে চুমুক দিয়ে, মন ও প্রাণ দুইই শান্ত করে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্যেশ্যে।