শনিবারের গদ্যে অনিন্দিতা শাসমল

বৃষ্টিভেজা তালের গন্ধ

পয়লা বৈশাখ ছাড়া প্রায় সারাবছরই বাংলা মাসের তারিখ ঠিকঠাক মনে রাখতে পারিনা ; এই সীমাবদ্ধতার জন্য মনে মনে লজ্জিতও হই আমি। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন যে ভাদ্র মাসের সংক্রান্তি , এইটুকু মনে থাকে ; আর ভাদ্র মাস এলেই তালের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে বিভূতিভূষণের ‘তালনবমী’ গল্পের কথা , জন্মাষ্টমীর দিন ঠাকুমার হাতে বানানো তালের বড়ার কথা । আরো কত কথা মনে পড়ে ! মনে পড়ে, ভরা বর্ষায় সবাই মিলে তাল কুড়োতে গিয়ে , কাদার মধ্যে হাওয়াই চটি আটকে যাওয়ার কথা। কোনরকমে চটির ফিতে ছিঁড়ে তাকে এঁটেল মাটির কাদা থেকে উদ্ধার করে, ভিজে সপসপে হয়ে কোলে একটি করে কাদামাখা বড় আকারের তাল নিয়ে দাঁত বের করে বাড়িতে হাজির হতাম ভাইবোনেরা। ঠাকুমা , জেঠিমা আমাদের দেখে খুশি হলেও , মার মুখে বিরক্তি ফুটে উঠতো। প্রথম কারণ, ভিজে আমাদের ঠাণ্ডা লাগার ভয়, দ্বিতীয় চটির ফিতে ছেঁড়া , আর সর্বশেষ কারণ হলো — কাদামাখা এতগুলো তাল পরিষ্কার করে ,ছাড়িয়ে ঝুড়ির সাহায্যে মাড়ি বের করতে হবে মাকেই।ঢেঁকিতে চালের গুঁড়োও তৈরী করতে হবে সারারাত চাল ভিজিয়ে রেখে।কাঠের উনুনে বড় মাটির পাত্রে মাড়ি ফুটিয়ে ফুটিয়ে গাঢ় করতে হবে.. ইত‍্যাদি। অনেক ঝামেলা ! আমি মায়ের গম্ভীর মুখের দিকে না তাকিয়েই জেঠিমাকে বলতাম , আজ তালের মাড়ি ফুটিয়ে রাখো , কাল তালের বড়া , সরুচাকলি আর নারকেল দিয়ে তালের ক্ষীর করবে কিন্তু।
চিরদিন নস্টালজিয়া জ্বরে আক্রান্ত আমি, বিবাহসূত্রে শহরের বাসিন্দা হওয়ার পরেও ভাদ্র মাস শেষ হবার আগে তালের বিভিন্ন পদ খাওয়ার লোভ সামলাতে পারিনা । কয়েকদিন শরতের নীল আকাশ দেখে ভুলে গেলেও , নিম্নচাপের বৃষ্টি আর মুখ ভার করা আকাশ মনে করিয়ে দিলো ,ভাদ্র মাস এখনও শেষ হয়নি , আরও ক’দিন বাকি আছে ,আর এ বছর তালের কোনো পদও খাওয়া হয়নি । সুগার লেভেল বর্ডার লাইনে থাকা সত্ত্বেও, অগত‍্যা গুটি গুটি পায়ে বাজারের দিকে গেলাম একটি কালো তাদের আশায় ।একটি বড় কালো ‘হেঁড়ে তাল ‘ দেখে দাম জিজ্ঞেস করতেই চমকে উঠলাম — ৬৫ টাকা ! বুঝলাম করোনাকালীন উচ্চ বাজারদর অথবা কোনো অজানা কারণে তালের দামটিও বেশ চড়া ! আরও দু একজনের সঙ্গে দর কষাকষি করে , অবশেষে ৫০ টাকায় একটি বেশ বড় কালো তাল কিনে আনলাম। মনে পড়লো, গতবছরও পনেরো কুড়ি টাকায় তাল কিনে এনেছি ; মনে পড়লো তালনবমী গল্পে এক পয়সায় দুটো অথবা তিনটে তাল বিক্রির কথা , আর আমাদের বিনা পয়সায় তাল কুড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বাড়িতে আনার কথা।
যাই হোক,বাঁশের ঝুড়ি ছাড়াই কোনোরকমে হাত দিয়ে পাতলা তালের মাড়ি বের করে, অনেকক্ষণ ধরে গ‍্যাস পুড়িয়ে ফুটিয়ে তাই দিয়ে বড়া , সরুচাকলি বানিয়ে ছেলে মেয়েকে দিতে গেলাম। ছেলে কোনোরকমে একটি বড়া মুখে তুলে আমার মন রাখলো বুঝলাম। ছেলের বাবা আর আমি পরম আনন্দে সেদিন রাতে তালের বড়া আর পিঠে দিয়েই ডিনার সারলাম। আর মেয়ে দুটো তালের বড়া হাতে নিয়ে ,দাঁতে কাটতে গিয়ে, হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি আমার মেয়ের মনোজগৎটা খুব ভালো জানি ,তাই বললাম– কিরে ‘তালনবমী’ গল্পের গোপাল আর নেপালের কথা মনে পড়ছে ? ‘সহজ পাঠের গপ্পো’ সিনেমাটার কথা মনে পড়ছে ? তাই তো ! ও মাথা নেড়ে কোনোরকমে বললো–হ‍্যাঁ মা । ওদের দুই ভাইকে পেলে , বাড়িতে ডেকে এনে ,আসন পেতে বসিয়ে তোমার বানানো সব বড়া আর পিঠেগুলো খাওয়াতাম। আমার চোখ থেকেও দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো — আমার বুকে মুখ গুঁজে রাখা ওর মাথার খোলা চুলের ওপর । তালের পিঠে খাওয়ার সব আনন্দ মা-মেয়ের বেদনার অনুভবের অশ্রুতে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।