কর্ণফুলির গল্প বলায় আনোয়ার রাশিদ সাগর (অন্তিম পর্ব)

রক্তাক্ত হাত
হেমন্তের গাস্বিভরা জ্যোৎস্নায় ঘরের চালে, আলো চালের কাঁচা পিঠা রেখে কুয়াশায় ভিজায়ে সকালে খাওয়ার ধুম ছিল। সে রাত আর খুঁজে পায় না মাসুদ। মনে মনে হেঁটে চলে আখভাঙা মাঠের পায়ে হাঁটা পথ ধরে। হাঁটতে হাঁটতে একটা আখ ভেঙে হাতে নিয়ে দাঁত দিয়ে ছুলে চিবায়। মুখের মধ্যে মিষ্টি মিষ্টি ভাব অনুভুত হয়। আখের মাঠের আল পেরিয়ে বেগুনের জমির ধারে যায়,একটা খোরগোশ কানখাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে।
ভীষণ গরম পড়ছে। এ যেন ভাদ্রমাস! অথচ আজ আশ্বিন মাসের একুশ দিন। শীতের আমেজ নেই,নেই কুয়াশা ভরা সন্ধ্যা। যেখানে পোয়াল গাঁদার আড়ালে পলানটুক খেলতে গিয়ে, গোপন খেলা খেলতো মর্জিনার সাথে। আজ আর পোঁয়ালগাদা নেই,নেই ধান মাড়াইয়ের খোলা। খোলায় গুড়ের খুরমা-সন্দেশ নিয়ে আসতো ময়রারা। মানে মিষ্টি ওয়ালা। যিনি মিষ্টি তৈরিও করতো এবং বিক্রি করতে আসতো খোলায়। মিষ্টির দাম হিসেবে ধান মেপে দিতো বাপজান। বাপজানও বেহেস্তবাসী হয়েছে,মা-দাদিও নেই পৃথিবীর আলোবাতাসে। মনে মনে তাদের বেহেস্তবাসী হওয়ার জন্য প্রার্থণা করে।
রাত এখন বারটা বাজে। এইমাত্র দূর কোথাও থেকে বিদ্যুতের পোলের সাথে নাইটগার্ড ধমধম করে বারটি লাঠির আঘাত করলো। আর ঢং ঢং করে বার বার শব্দ হলো। মনে মনে মাসুদ শব্দগুলো গুণলো। তারপর ফিরে এলো নিজের মধ্যে।
জ্যোৎস্নাভরা আকাশ। ঝরঝর ঝরছে মিঠা আলো। হঠাৎ জানালার পাশে মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পায়। ভালো করে কান খাড়া করে, খসখস শব্দটা শুনা ও বোঝার চেষ্টা করে। মনে হচ্ছে কোনো মহিলার পায়ের শব্দ।
দাদির কাছে উঠানের মাঝে খেঁজুরের পাতার তৈরি পাটিতে শুয়ে শুয়ে গল্প শুনেছিল,জানো ভাই এমনো জ্যোৎস্নারাতে আসমান থেকে পরী নেমে আসে। সে পরী এসে তোমার মত দাদুভাইকে পেলে আদর করে,মায়ের চিহারায় এসে। তারপর ঘুম পাড়িয়ে দেয়। যখন ঘুমিয়ে যায় তখন তাদের পাখার উপর তুলে নিয়ে উড়ে উড়ে আকাশ ঘুরায়। প্রথম প্রথম এই ধরণের গল্প শুনে মাসুদের বুকের ভিতর দুরুদুরু কাঁপতো। ভয়ে লোম খাড়া হয়ে যেতো। জড়ো-সড়ো হয়ে দাদির আঁচলের মধ্যে লুকিয়ে থাকতো। এভাবে কখন চোখে ঘুম এসে যেতো টের পেতো না।
বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর কৈশোর আর যুবকের মাঝামাঝি বয়সে মনে হতো, আহা পরী এসে যদি একবার আদর করে তুলে নিয়ে যেতো- ওই আকাশে নিয়ে গিয়ে, উড়ে উড়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাতো। এমন কৈশোরের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থেকেছে বহুদিন।
মাসুদ একদিন পরীর পাখায় সত্যি সত্যি উঠে পড়ে। উড়ে উড়ে মাঠ-ঘাট,নদী-নালা,সাগর-মহাসাগর এবং এদেশ সেদেশ দেখতে শুরু করে। মনে মনে দাদির সত্যবচনে মুগ্ধ হতে থাকে। বার বার দাদির পায় সালাম করে। আহা কী সুখের দিন-রে দাদি!
কিন্তু হঠাৎ দুষ্ট জিন এসে মাসুদকে পাগল বানিয়ে দিল। মর্জিনার জন্য মাসুদ পাগল হয়ে যায়। তখন লাইলী-মজনুর যুগ চলছিল। ববিতা আর রাজ্জাক অভিনিত লাইলীর জন্য মজনুর পাগল হওয়ার বিষয়ে যুবকরা উদ্বুদ্ধ হতো। মাসুদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু হয়নি।
মাসুদের কানে যেমন বাজে তেমন হৃদয়েও বাজে “লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আখি খোলো…”। দাড়িচুল রেখে উদাসীন মাসুদ ঘুরে বেড়ায়।
বন্ধুদের কাছে সে মাসুদ পাগল নামে পরিচিত হয়ে উঠে। কেন যেন মাসুদ পাগল বলেই ডাকলেই মাসুদের ভালো লাগতে থাকে। তার ভিতর ভিতর ও শিরা-উপশিরায় রোমাঞ্চ অনুভত হয়,বুঝতে পারে না।
একদিন ‘মাসুদ পাগল’ নাম দিয়ে লুকাল পত্রিকায় একটা প্রেমের কবিতা ছাপা হয়।
ছোট এই মহেশপুর বাজারে দুই পাতার পত্রিকা আসে বেশ সকালে। মাসুদ পাগলের লেখা অন্তমিল দিয়ে কবিতা ছাপা হয়েছে পত্রিকাটিতে। তাও আবার মর্জিনাকে নিয়ে লেখা প্রেমের কবিতা। মাসুদ বিকেলে বাজারে এলে, দোকানদাররা তাকে ‘ পাগল’ বাদ দিয়ে ‘কবি’ বলে ডাকা শুরু করে। মাসুদের আনন্দে বুক ভরে যায়। কবি মাসুদ নামটা ভালই তো।
ধীরে ধীরে কবি মাসুদ নামে পরিচিত হতে থাকে। মাসুদ কিছুই বুঝতে পারে না। লজ্জায় বলতেও পারে না যে, এ লেখা সে লিখিনি।
বরং মাসুদ মনে মনে ভাবে তার কৈশোরের সাথী মর্জিনা জানুক যে, আমি তাকে খুব-খুব ভালোবাসি।
বাজারের পাশে ফুটবলফিল্ড। সেখানে ফাঁকা জায়গায় বসে, বন্ধুরা মাসুদকে ডেকে আনন্দ করে,আরে মর্জিনার মজনু যে?
মাসুদ খুশিতে গদগদ হয়ে যায়। পাশের বটতলায় মুংলাচাচা বড়াভাজে। প্রতিদিন বিকেলে মাঠের কাজ-কাম শেষে মুংলাচাচা ছোলার আটা দিয়ে পিঁয়াজো ভাঁজে। বিক্রিও হয় প্রচুর। ধীরে ধীরে মুংলাবড়া নামে পরিচিত হয়ে যায় পিঁয়াজো ভাঁজা। মাসুদ বেশ খুশি মনেই সেখান থেকে কাগজে মড়িয়ে পিঁয়াজো কিনে আনে এবং সাথে থাকে নানা রকমের শুকনোঝালের গুড়োসহ ও মশলা।মুখোরোচক খাবার বটে! সকলেই মাসুদের নামে শ্লোগান দিয়ে মুখের ভিতর একটা একটা করে পিঁয়াজোর টুকরো ঢুকায় আর খোশগল্পে মেতে ওঠে। অনেকেই পিঁয়াজো গালের ভিতর দিয়ে গান ধরে, মর্জিনা তোমার এসেছে ফিরিয়া মাসুদ গো আঁখি খোল। কেউ কেউ হোঁহোঁ শব্দ করে হাসে এবং একেকে জন অপর জনের গায়ের উপর এলিয়ে পড়ে। এভাবেই অনেক আবেগ ও অনুভুতি নিয়ে কেটে যায় বহুবিকেল।
একদিন মাসুদের কানে এলো,মর্জিনাকে বরপক্ষ দেখতে আসছে। মাসুদ দৌড়াতে দৌড়াতে বন্ধুদের কাছে এসে ফঁসফঁস করে হাফাতে থাকে। তারপর ঘনঘন নিঃশ্বাসের সাথে বলতে লাগলো,জানিস আমার মর্জিনার বিয়ে হয়ি যাইছি।
কেউ কেউ মশকরা করে বললো,আহারে আমার মজনু,লাইলীর বিয়ি হয়ি যাইছি। শালা মর্জিনা তোকে ভালোবাসে তো?
মাসুদ হ্যাকাচ্যাকা খেয়ে আমতা আমতা করে বলে, বাসে-বাসে।
আরেক জন বলে,মর্জিনা যে তোকে ভালোবাসে তার কী প্রমাণ আছে তোর কাছে?
মাসুদ মনে মনে নিজের ভিতর হাতড়াতে হাতড়াতে কেঁদে ফেলে।
মাসুদের কান্না দেখে বন্ধুরা থ-হয়ে যায়।অবাক চোখে তাকিয়ে সকলেই মাথা নিচু করে ফেলে। আর কেউ মশকরা করে না। অনেকটা শান্ত স্বভাবের বন্ধু আঃ ওহাব বলে,দ্যাখ্ মাসুদ এতদিন আমরা যা করেছি সব ইয়ার্কী। তুই নিজেকে সংযত কর্। মর্জিনা বড় হয়েছে,তোকে ভালোবাসলে সে অন্য ছেলেকে বিয়ে করবে না। তোকেই বিয়ে করবে।
মাসুদ নিজেকে ঘুরিয়ে নিয়ে সোজা বাড়ি চলে আসে। রাতগভীরে দুঃশ্চিন্তায় অপেক্ষা করতে থাকে। সে রাতে মর্জিনার বিয়ে হয় না। বিয়ের প্রস্ততি নিয়ে বরপক্ষ আসেনি। তারা এসেছিল মেয়ে ও ঘরবাড়ি দেখতে। দেখে চলে যায়। মাসুদ অপেক্ষায় থাকে।
‘কবি মাসুদ’,লোকের মুখে মুখে হলেও পত্রিকায় কবিতা ছাপা হয় ‘মাসুদ পাগল’ নামে। রাতের গভীরে এ সব কথা ভাবতে ভাবতে মাসুদও একটা কবিতা লেখে। নাম দেয় ‘দেবদাস’। দেবদাস সিনেমার কথা মনে হতেই মনে হয়ে যায় পার্বতীর কথা। আহা পার্বতী,দেবদাসকে ভীষণ ভীষণ ভালো বাসতো।
পার্বতীর মতই মর্জিনারও বিয়ে হয়ে গেছে। তিন গ্রাম দূর থেকে গরুর গাড়ির ছঁইয়ের উপর মাইক বেঁধে গান বাজাতে বাজাতে এসে মর্জিনাকে বিয়ে করে নিয়ে যায়। মাসুদের মনে হচ্ছিল, মর্জিনা স্বামীর সাথে যাওয়ার সময় গাড়ির ভিতর ডানা ঝাপটানো পাখির মত ছটফট করছিল। কিন্তু কেন যে এ বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে বুঝতে পারে না। মর্জিনা তো এ বিয়েতে সম্মতি না দিলেও পারতো! তার সাথে কত খেলা করেছে সে। নদীতে ডুব খেলা খেলতে খেলতে পানির ভিতর চুমুও খেয়েছে দু’জন দু’জনকে। সন্ধ্যাঘোরে পলানটুক খেলতে গিয়ে ভুঁসিঘরে জড়াজড়িও করেছে। মানুষ এমন করে সব কিছু ভুলে যায়?
জানালার পাশে একটা পুকুর রয়েছে। পুকুরের ধারে ভরা টলটলে পানির কোল ঘেষে একটা সাতিয়ান গাছ রয়েছে। এ গাছের ফুলের গন্ধ ভেসে আসতে থাকে। আবার মনে হয়,কোনো মেয়ের মাথার এলোচুলের গন্ধ ভেসে আসছে। মাসুদ কবিতার অন্তমিল মিলাতে না পেরে, ভালোবাসার বিরহ আবেগ লেখে ফেলে গদ্যকারে। লেখে বেশ আত্মতৃপ্তি পেতে থাকে। তারপর ঘুমানোর চেষ্টা করে, ব্যর্থ হয়।
আশ্বিন মাসে ঝড়ের ঝাপট হয়,খাড়া আখ পড়ে যায়,মাঠে কলার গাছগুলো ভেঙে যায় অথচ গরম কমেনি,গুমসো গরম পড়ছিল। হঠাৎ দুমকা বাতাস বয়ে যায়। দপদপ শব্দে জানালার দু’একটা পাল্লা বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে গরম বাতাস বয়ে এসেছিল,তারপর শীতল ঠাণ্ডা হাওয়া এসে শরীরে একধরণের উষ্ণ আবেশ তৈরি করে দিয়ে যায়। নিজের লেখাটি আবার পড়তে চেষ্টা করে।
যেই খাতার উপর চোখ রাখলো ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকার যত গাঢ় হতে লাগলো তত কার যেন পায়ের আওয়াজ কানের পর্দায় এসে আঘাত করতে লাগলো। হাঁটার শব্দ ও চুলের গন্ধটা খুবই পরিচিত মনে হচ্ছে।
মাসুদের মায়ের কথা মনে হচ্ছে। মা প্রায়ই গল্প করতো,রাত জাগবা না,একা একা অনেক রাতে জিন আসে। ভুলিয়ে নিয়ে যায়। বড় বড় নদীর ভিতর নামিয়ে দেয়। তারপর ডুবিয়ে মেরে ফেলে। মা’র কথা শুনে বাবা প্রতিবাদ করতো,আরে না-না,বোকা আলাভুলা এসে ভুলিয়ে নিয়ে যায়। দেখো না দূরে মাঠের ভিতর দিয়ে আলো জ্বলতে জ্বলতে যায় ওটিই আলাভুলা। মাঠের মধ্যে অন্ধকার রাতে পথ হারিয়ে গেলে, আলাভুলা হাঁটতে হাঁটতে আলো জ্বেলে, চলতে চলতে সঙ্গে করে নিয়ে যায় বিলের মধ্যে। তারপর মেরে ফেলে। বাবার কথা মনে হতে হতেই আবার খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে তাকায়। আলাভুলা নয়। আলেয়া হয়তো। না আলেয়াও নয়,স্যার বলেছিল মাঠে জমির আলের উপর ঘাস রাখতে রাখতে পালা হয়ে যায়। পচে যায় এবং গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাস অক্সিজেনের সাথে ক্রিয়া হয়ে আগুন জ্বলে। সে ছোট ছোট আগুনের আলো বাতাসের সাথে ভেসে যায়। তখন মনে হয় কেউ আলো জ্বেলে নিয়ে যাচ্ছে। এটায় আলেয়া বা আলাভোলা। তারপরও কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। গা ছমছম করে। ভয়ে ভয়ে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে কাপতে কাপতে জানালা বন্ধ করতে গিয়ে আরো ভয় পেয়ে যায়। কোনো এক যুবতী মেয়ের পাঁচআঙ্গুল জানালার পাল্লা আটকিয়ে যায়। ফিনকি দিয়ে কয়েকফোঁটা রক্ত এসে মাসুদের গালে পড়ে। এটা কী মর্জিনা বিতাড়িত-প্রতারিত হাত। রক্তাক্ত যুবতী হাতের ছোঁয়ায় মাসুদ চিৎকার করে ওঠে। বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। জানালার সব কটা পাল্লা বিকট শব্দ করে খুলে যেতে থাকে।