গল্পে অংশু প্রতিম দে

খেলা
-“তোর যাওয়ার কী দরকার?”
ঋতিকার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করল অনিন্দ্য। রেগে গেছে ঋতিকা। দুম করে রেগে যায় বলেই ঋতিকাকে সমঝে চলে বন্ধুমহলের সবাই, অনিন্দ্য তো বটেই। অথচ কিছুক্ষণ আগে ঋতিকা ভালো মুডেই ছিল। কী যে হল! অনিন্দ্য শুধু বলেছে ও কাবেরীর বিয়েতে যাবে, ব্যস।
-“কেন যাবি বিয়েতে? একবার চোখের দেখা দেখবি সেইজন্য…এখনো এত ভালোবাসিস কাবেরীকে?”
অনিন্দ্যর উত্তরগুলো সব ঋতিকা নিজেই দিয়ে দিচ্ছে। অনিন্দ্য চুপ করেই আছে।
“বল, চুপ করে আছিস কেন!”
এটাই ওর দোষ, মুখ ফুটে সব কথা বলতে পারেনা অনিন্দ্য। কাবেরী যখন ওর বিয়ের কার্ড দিয়ে বারবার করে যেতে বলেছিল, অনিন্দ্য বলতে পারেনি, “যাবো না, অন্য লোকের পাশে তোকে আমি দেখতে পারবো না!”
কাবেরী অনিন্দ্যকে বিয়েতে নেমন্তন্ন করেছে শুনতেই ঋতিকার মুখটা রাগে লাল হতে দেখেছিল অনিন্দ্য। “কী চায় ও, দ্যট বিচ্…”
রাগের কারণ আছে অবশ্যই। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারেই অনিন্দ্যকে প্রপোজ করেছিল কাবেরী। সেই থেকে অনিন্দ্য আর কাবেরী কাপ্ল। হ্যান্ডসাম অনিকে অনেক মেয়ে পছন্দ করলেও অনিন্দ্য একদম কমিটেড। কাবেরী ছাড়া কাউকে পাত্তা দেয়নি। গ্র্যাজুয়েশনের পরে চাকরির জন্য স্ট্রাগল করছে অনিন্দ্য, সেসময়ই প্রেমের ঘুড়িটা ভোকাট্টা হয়ে গেল ওর।
-“চাকরির বাজার খারাপ, সামনে কঠিন সময়। এসময় তোকে বেশী করে পাশে চাই,”
বরাবরের চুপচাপ অনিন্দ্য কিন্তু মুখ ফুটে সেদিন কাবেরীকে ওর বাড়ীতে বসে কথাটা বলেছিল।
-“বাবা বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবো না বাড়ীতে। কী বলব বল তো বাবাকে? তোর তো কিছু হচ্ছেও না। ফাইনালের রেজাল্ট আরো ভালো হলে না হয়…”
ফাইনালের আগে রাতের পর রাত জেগে অনিন্দ্য নোটস বানিয়েছে কাবেরীর জন্য। নিজের পড়ার দিকে নজরই দেয়নি। দিলে রেজাল্ট ভালো হত নিশ্চয়। কাবেরীকে বলতে পারেনি সেকথা সেদিন। কাবেরী ঘুরিয়ে ব্রেকআপের কথা শুনিয়ে দিলেও কিচ্ছু না বলে কাবেরীর বাড়ী থেকে বেরিয়ে এসেছিল অনিন্দ্য।
-“বাবা উঠেপড়ে লেগেছে না ও নিজে! সেটা জিজ্ঞাসা করতে পারতিস? ম্যাট্রিমনি ঘেঁটে দামী পাত্র পেয়েছে। এখন তোর মত ছেলেকে জীবন থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে তো!”
ঋতিকার কথায় ধাক্কা খেয়েছিল অনিন্দ্য। কাবেরী তাহলে খেলা করেছে ওর ইমোশন নিয়ে এতদিন! ঋতিকাকে তবু জিজ্ঞাসা না করে পারেনি,
“দামী পাত্র? তুই দেখেছিস প্রোফাইল?”
-“আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে এর ওর প্রোফাইল দেখব। শুনেছি। পাত্র আমেরিকায় সেট্লড। ম্যাডাম বিদেশ যাত্রার স্বপ্নে বুঁদ।”
খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন, নিজের সাদামাটা কেরিয়ারের জন্য আফসোসও হচ্ছিল অনিন্দ্যর। সময় লেগেছে ওর নিজেকে সামলাতে। আজ কাবেরীর বিয়ের দিনে অতীতের কোনো হ্যাংওভার নেই অনিন্দ্যর মনে।
-“কব্জি ডুবিয়ে খাবো আজ। রক্ত দিলাম বলে এখন যে ডেফিসিয়েন্সিটা হল সেটাও অনেকটা মেক-আপ হয়ে যাবে,”
জুতসই জবাবটা মুখে চলে এল অনিন্দ্যর। ঋতিকা বোধয় ভাবতে পারেনি অনিন্দ্য এরকম একটা কথা বলবে। একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।
-“কাবেরীর কী সৌভাগ্য! তোর অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছে, আবার বরের ভালোবাসাও পাবে। আর আমার দিদিটাকে দ্যাখ। ভালোবাসা পেয়েছিল কিন্তু সেটাও বেশীদিন কপালে সইল না।”
ঋতিকার মামাতো দিদি হসপিটালে ভর্তি। কয়েক মাস ধরে মানসিক টানাপোড়েন সহ্য করতে না পেরে সুইসাইড করতে চেয়েছিল কব্জির শিরা কেটে। বেঁচে গেলেও অনেকটা রক্ত বেরিয়ে গেছে শরীর থেকে। ব্লাড দিতে হচ্ছে, ফ্রেশ ব্লাড প্রেফারেব্ল। সেইজন্য অনিন্দ্য হসপিটালে এসেছে ব্লাড দিতে।
নিজের পছন্দের পাত্র অনির্বানকে বিয়ে করেছিল দিশা, ঋতিকার মামাতো দিদি। কাশ্মীরে হনিমুন চলাকালীন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল অনির্বান। সোন্মার্গ ঘুরে এসে হোটেলের ঘরে রেস্ট নিচ্ছিল দুজনে। ঘুমিয়ে পড়েছিল দিশা। ঘুম থেকে উঠে দেখে অনির্বান নেই। সিগারেট কিনতে মার্কেটে গিয়েছিল অনির্বান। আর ফেরেনি। তদন্ত করেও শ্রীনগরের পুলিশ কোনো হদিশ দিতে পারলো না। হনিমুন থেকে একা ফিরে এলেও দিশা আশায় ছিল পুলিশের থেকে কিছু খবর আসবে।
খবর আসলো ঠিকই। সেইসাথে এল অনির্বানের রক্তাক্ত জামাকাপড়ও। যা পুলিশ পেয়েছে শ্রীনগরের মেইন মার্কেট থেকে কিছুটা দূরের এক জঙ্গলে। লাশ বা অনির্বানের কাছে গচ্ছিত বেশ কিছু টাকাপয়সা কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে জামাকাপড় দেখে অনির্বানের পরিণতি নিয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশই রইল না।
-“সাবধানে যাস, অনেকটা রক্ত দিয়েছিস,”
অনিন্দ্য বেরিয়ে যাচ্ছে হসপিটাল থেকে। ঋতিকা তাকিয়ে রইল যতক্ষণ দেখা যায়।
(২)
সেদিনই সন্ধ্যেবেলা। ঋতিকা যথারীতি নার্সিংহোমে। ডাক্তারের অপেক্ষায় বসে আছে। মোবাইলে নেট চালু রয়েছে। ওয়াটসাপে মেসেজ ঢুকছে অনবরত। চেক করতেই দেখে অনিন্দ্য ছবি পাঠিয়েছে। কাবেরীর বিয়েতে বন্ধুরা গ্রুপ ছবি তুলেছে। বারবার বারণ করা সত্ত্বেও অনিন্দ্য সেই গেলই কাবেরীর বিয়েতে! এতটুকু সেলফ-রেসপেক্ট নেই ছেলেটার। সাদাসিধে আর মুখচোরা বলে অনিন্দ্যকে ইচ্ছেমত ব্যবহার করেছে সবাই। ওকে যতটা পারে আগলে রাখতে চায় ঋতিকা। ও যে খুব ভালোবাসে অনিন্দ্যকে। বোকা ছেলেটা সেটা জানেও না। কাবেরীর পাশে দাঁড়িয়ে কেমন হাসিমুখে পোজ দিয়েছে। উফফফ, মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে ঋতিকার।
আবার একটা ছবি এল। দেখবে না ভেবেছিল। তবু ছবিটা ডাউনলোড করে ওপেন করল ঋতিকা। একি! মাথাটা টলে গেল যেন ওর। ওদের বন্ধুবান্ধবের মাঝে এই লোকটা এল কী করে! বরের সাজে রয়েছে যখন নিশ্চয়ই কাবেরীর সেই ‘এনআরআই’ পাত্র ইনিই। কিন্তু এই মুখটা যে বড় চেনা ঋতিকার। হাজার মানুষের ভীড়েও এই মুখ চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়। ওরই জামাইবাবু অনির্বান অন্য পরিচয়ে সশরীরে বিরাজমান!
বুঝতে কিছু বাকি নেই থাকলো না ঋতিকার। এটাই তাহলে অনির্বানের খেলা। পরিচয় পাল্টে পাল্টে বিয়ে করে তারপরে টাকাপয়সা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যাওয়া। কাবেরীর মত অপরচুনিস্ট মেয়ের জন্য অনির্বানই হয়ত পারফেক্ট ম্যাচ। কিন্তু কাবেরীর পরে! নাহ, খেলাটা এখনি বন্ধ হওয়া দরকার। কাবেরীকে পছন্দ না করলেও প্রকারান্তরে ওর জীবনটা নষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল সে। ১০০ ডায়াল করল ঋতিকা।