।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় আলোক মণ্ডল

না-মানুষের গপ্প

একটা পোস্টকার্ড যতবারই ঢুকতে যাচ্ছে ততবারই দমকা বাতাস এসে দুলিয়ে দিচ্ছে ডাকবাস্ক। ভাসছে তো ভাসছেই ঢুকতে পারছে না, কোন ভাবেই! একাটা না-মানুষ দূর ধোঁয়াশাছন্ন মেঘ সরিয়ে ডাকবাস্কটিকে চেপ ধরতেই পোস্টকার্ড টুপ করে ঢুকে পড়ল মুখ দিয়ে পেটে কিন্তু টুং করে শব্দ হোল কই! দেখি, ডাকবাস্কের তল দিয়ে পোস্টকার্ডটি বেরিয়ে আবার ভাসতে লাগল বাতাসে!
না-মানুষ ডাকবাস্ক ছেড়ে পোস্টকার্ডের পিছু নিল। কিছুদূর হাওয়ায় সাঁতার কেটে ডানা তার ধরে এল। এদিকে পোস্টকার্ডটি ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো একবার ডানদিকে আর একবার বামদিকে ভাসতে-ভাসতে খসে পড়ল এক বিশাল জলাশয়ে। সে নীল জলে ভাসছে দেখে না-মানুষটি এবার ডানা খুলে ঝাঁপ দিল জলে, জলে পড়তেই তার হাতে পায়ের আঙুলে গজিয়ে গেল হাঁসের মতো পাতলা চামড়া। না-মানুষ সহজেই সাঁতার দিতে-দিতে খুব সহজেই পোস্টকার্ডের সঙ্গ নিল। সাঁতরাতে-সাঁতরাতে দেখে চারদিকে জল শুধু জল, জল চিকচিক আয়নায় মুখটি দেখে সূর্যসোনা! ভাসতে-ভাসতে না-মানুষ দেখল দূরে একটা ছোট্ট নির্জন দ্বীপ। দ্বীপ নাকি ডুবন্ত পাহাড়ের চূড়া! দূর থেকে ঠাপর হয় না। পোস্টকার্ডকে ছেঁড়ে এসে মা-মানুষ দাঁড়ালো সেই দ্বীপভূমিতে।
পায়ের পাতলা চামড়া, হাতের সাঁতার খুলে না-মানুষ কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিল একটা জলছুঁই পাথরে বসে। দ্বীপটিতে গাছ আর পাথর ছাড়া কিছু নেই, চারদিকে জল আর জল! কিছু শামুকের খোল পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। না-মানুষ প্রথমে একটি বুদ্ধিদীপ্ত গাছের পাদমূলে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,” অনাদি অতীতসঙ্গী হে গাছ! তোমাকে কেউ পোস্টকার্ড দেয়?” প্রশ্ন শুনে গাছ সমস্ত শাখা নাড়িয়ে উত্তর দিল,”কেন দেবে না, দেয়ই তো!” না- মানুষ জানতে চাইল,” কে এনে দেয়”?
” কেন, বাতাস! সকাল আর বিকেলের বাতাস, দুপুরের ঝড়ো হাওয়া! ওরাই তো আনে কত সহস্র পোস্টকার্ড। ”
-” কে লেখে তোমায়?”
গাছ বলল,”কেন, শিকড়! সেই তো জলের খবর লেখে, ফুলের আগাম বার্তা জানায়, জানো না? ওদের সঙ্গে যে আমার নিবিড় সম্পর্ক! ” না-মানুষ এবার পাথরের কাছে গেল, পাথরকে বলল,” পাথর তুমি তো স্থির অচল, তোমাকে কেউ পোস্টকার্ড লেখে?” পাথর বিস্ময়ে ফেটে চৌচির হয়ে বলল,” কেন লিখবেনা? প্রতিদিনই তো চিঠি পাই!”
-” কে এনে দেয়?”
পাথর বলল, ” কেন দ্যাখো না, জলের ঢেউ এসে কেমন ছুঁয়ে যায়, দিয়ে যায় জললিপি!”
– ” কে পড়ে দেয়?”
-“ছলাৎ ঢেউ!”
না-মানুষ এবার দুঃখ-শোকে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। এক ঝাঁক মাছ কোথা থেকে এসে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল মাছেদের সংসারে। সেখানে তাদের সভা বসেছে। সভা ছেড়ে মাছেদের সভাপতি একটা বড় রুই মাছ এসে বলল,” দুঃখ কোর না ভাই, তোমাদের সব দুঃখ দ্যাখ আমরা গিলে ফেলেছি, পেটে পাথরের মতো জমে আছে তোমাদের হারনো দুখের আংটি! ফিরে যাও ডাঙায়, ওহো! কী করে ফিরবে? তুমি তো না-মানুষ! ডাঙায় কড়া রোদে বাস করে তো মানুষেরা- ওদের আজ আর বন্ধু নেই, হৃদয়ের কোন কথা নেই তাই বলিবার বা লিখিবার কোন ব্যাকুলতা নেই!”
না-মানুষ গুমরে-গুমরে কেঁদে ফুঁস করে কোথায় হারিয়ে গেল, কে জানে!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।