অনুগদ্যে অমিত মুখোপাধ্যায়

পিউ কাঁহা

নাম শুনেছি সেই ছোট্ট বেলায়। কিন্তু তার সঙ্গে ঠিকঠাক পরিচয় অতিক্রান্ত আটান্নয়। সে পরিচয় ঝাড়্গ্রামের কুটুমবাড়িতে। অভিজিৎ রায়ের কুটুমবাড়ি রিসর্টের ফুল ফোটা শালবন, গন্ধে মাতাল করা ভাঁটফুলের ঝোপ, বাতাসে ভেসে আসা মহুয়ার ঘ্রাণ এসব যদি ভুলেও যাই, ভুলব না সেই পাখিটির সঙ্গে পরিচয়ের কথা। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা কুটুমবাড়ি ও তার আশপাশ মুখরিত হয়ে থাকত’চোখ গেল,’ ‘চোখ গেল,’ ‘চোখ গেল’ ডাকে। সন্ধ্যা যত রাতের দিকে গড়াত ততই বাড়ত তার ডাকেত তীব্রতা। হ্যাঁ, ‘চোখ গেল’ পাখির কথা বলছি। ইংরেজি নাম ‘কমন হাক কুক্কু।’ বৈজ্ঞানিক নাম, ‘হাইরোকক্সিস ভেরিয়াস।’ পাখিটির অন্য নাম ‘পিউ কাঁহা।’ পুরুষ পাখিটির তীব্র ডাক অনেকটা ‘চোখ গেল’ বা ‘পিউ কাঁহা’র মত শুনতে লাগে। চৈত্রে প্রজননের কালে পুরুষ পাখিটির ডাকে তীব্রতা বাড়ে। পাখিবিদরা জানাচ্ছেন, ‘চোখ গেল পাখির ঠোঁট তীক্ষ। ঠোঁটের ডগা কালো, বাদবাকি হলদেটে সবুজ। মাথা থেকে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত ধূসর। তবে লেজের ওপর কিছু কালো বলয় রয়েছে। গলার নিচ থেকে বুক পর্যন্ত লালচে বাদামি। বুকের দু’পাশে সরু বাদামি দাগ। চোখের তারা, বলয় হলুদ। পা, আঙুল হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম।’ সাধারণত কীটপতঙ্গ ও পাকা ফল খেয়ে বাঁচা এই পাখি কোকিলের মত অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। চোখ গেল, পিউ কাঁহা ইত্যাদি ডাক অনুসারী নাম ছাড়াও বাংলায় এই পাখির আর একটি নাম আছে। সেটি হল ‘পাপিয়া।’ গত চৈত্রে ঝাড়্গ্রামের পর এই চৈত্রে চোখ গেলর সঙ্গে দেখা হল ঝাড়খণ্ডের দেওঘরে। প্রখর তপন তাপের দুপুরে ও স্নিগ্ধ সমীরের সন্ধ্যায় দীঘরিয়া, ত্রিকূট, ফুলজোরি পাহাড়, শালবন, পলাশ, মহুয়া ফোটা মাঠ প্রান্তর মুখর হয়ে থাকতো এই চোখ গেলর ডাকে। কয়েক দিন হল ঝাড়খণ্ডের দেওঘর থেকে বাংলার উত্তর চব্বিশ পরগনার বাড়িতে ফিরে এসেছি৷ কিন্তু এখনও যেন সেই ডাক শুনতে পাচ্ছি।
মস্তিষ্ক জুড়ে কেমন এক জ্বর ছড়িয়ে পড়েছে।। কেমন এক ঘোর লেগে আছে। সে যেন ডেকেই চলেছে। ‘ব্রেইন ফিভার,’ ‘ব্রেইন ফিভার,’ ‘ব্রেইন ফিভার,’……সারা দিন সে বলে চলেছে ‘ব্রেইন ফিভার’… ‘ব্রেইন ফিভার’…..। বিজ্ঞান বলে, ‘ব্রেইন ফিভার’ বা ‘মস্তিষ্কের জ্বর’ আদতে মস্তিষ্কের একটি অংশের প্রদাহ। এই পাখির ডাক শরীরের কোনও অংশে প্রদাহ না ঘটালেও মনে প্রদাহ চলতেই থাকে। মন পোড়ে। আর মনের বাস তো শরীরেই হে। তাই এক অদৃশ্য দহন চলতে থাকে শরীরে ও মনে। সেই দহন আক্রান্ত মন তবু বলে, সবাই ভালো থাক।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।