• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় অমিত মজুমদার

গগনে গরজে মেঘ

কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আঁছড়ে পরার পর হাইস্কুলগুলোতে নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগেই গরমের ছুটি পড়ে গেছে। প্রাইমারী স্কুলগুলো তো একবছর আগে বন্ধ হবার পর এখনও পঠনপাঠন শুরুই হয়নি। হাইস্কুলেও ক্লাস হচ্ছিল এইট থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত। যদিও টুয়েলভের কেউ আর স্কুলে আসছিলো না। গত ফেব্রুয়ারিতে স্কুল খোলার পর দু মাসের মধ্যে আবার স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছেলেমেয়েগুলো বেশ দুঃখ পেয়েছে। পড়াশোনার ক্ষতি তো আছেই তার সঙ্গে আর একটা কারণ আছে। গতবছর লকডাউন থাকায় তারা স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করতে পারেনি। এইবছরও গরমের ছুটি পড়ে যাওয়ার জন্য তারা এবারেও তা পালন করতে পারবে না। বিষয়টা সুমনকে খুব ভাবাচ্ছে। ওদের স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী বেশ ঘটা করে পালন করা হয়। এইবছর পুরোপুরি না হলেও আংশিক লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। জমায়েত করা যাবে না। বাজারও নির্দিষ্ট সময় খোলা। স্কুল বন্ধ বলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অল্প ক’জন মিলে অন্য কোথাও সেটা করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা করা হবে কোথায় ? কোচিং ক্লাসে করা যায়। কিন্তু সেখানে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা অনেক বেশী বলে এই পরিস্থিতিতে স্যার রাজী হননি। এখন একটা রাস্তাই খোলা। অনুদিদের বাড়িতে। আট দশজন মিলে সেখানে অনুষ্ঠান করতে পারবে৷ ঘণ্টাখানেকের অনুষ্ঠান ওখানে দিব্যি করে দেয়া যাবে। অদিতির আবৃত্তির গলা খারাপ নয়। তানিয়াও সুন্দর গান করে। সম্প্রতি তানিয়ার জ্বর এসেছিলো। সবাই খুব ভয় পেয়ে গেছিলো। কোভিড টেস্ট করার পর তানিয়ার নেগেটিভ আসে। সে এখন অনেকটা সুস্থ। আসলে ঠাণ্ডা লেগেই জ্বর এসেছিলো। জ্বর আসার পর খুব ভেঙে পড়েছিলো তানিয়া। তানিয়া সুমন অদিতি সহ ওদের সব বন্ধুরা মিলে গ্রামের মানুষকে মাস্ক ব্যবহার করার বিষয়ে সচেতন করা শুরু করেছিলো। গ্রামের মানুষ তো মাস্ক ব্যবহার করছিলোই না। সুমনদের অভিযান অনেকটাই সফল হয়। গ্রামের লোকজন মাস্ক পরা শুরু করে। কিন্তু তানিয়া অসুস্থ হয়ে পড়ে। তানিয়ার বাবা মা সুমনদের সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করেন। সেই থেকে তানিয়ার সঙ্গে ওদের সাথে সেইভাবে যোগাযোগ নেই। মাঝেমাঝেই অদিতির সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তানিয়া অনুষ্ঠানে এলে আবার অনেকটা উৎসাহ পাবে সে। তাই রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করাটা খুব দরকার। কিন্তু সেই প্রস্তাব রাখতেই তানিয়ার মা মুখের ওপর না করে দিয়েছে। পরিস্কার বলে দিয়েছেন তাদের কোনো বিষয়ে আর তানিয়া থাকবে না। সুমন নিজে ওই দিন রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’র ওপর কিছু বলবে বলে ঠিক করে রেখেছে। এখন কি হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে খুব জেদ চাপছে সুমনের৷ ওদের বাড়ি একটা অজ গ্রামে। প্রত্যন্ত এলাকা। পড়াশোনা থেকে খেলাধুলো অনেক বিষয়ে সুযোগ সুবিধা ওরা পায় না। এলাকার ছেলেমেয়েদের নাচ, গান, ছবি আঁকা, আবৃত্তি বা অন্যান্য বিষয় শেখানোর মতো ভালো প্রশিক্ষক নেই৷ ওরা যা শিখেছে তা স্কুল শিক্ষক শিক্ষিকা আর বড় দাদা দিদিদের কাছ থেকে। বেশীরভাগই স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান অংশ নিতে নিতে শিখেছে। কিন্তু সে সবই নিজেদের মধ্যে কাজ চালানোর মতো।
অদিতি সুমনের প্রস্তাবে এক কথায় রাজী হলো। আগেই বলে দিলো সে ‘প্রশ্ন’ কবিতা আবৃত্তি করবে। কিন্তু তানিয়াকে নিয়ে সমস্যা হলো খুব। তার বাড়ি থেকে এই মুহূর্তে তাকে বেরোতে দেবে না। কিছুদিন আগেই ভয়ানক উৎকণ্ঠায় দিন কাটিয়েছে তারা। সুমনদের বন্ধুদের মধ্যে আর কেউ নেই গান বা কবিতা আবৃত্তি করতে পারে। রণদেবকে বলা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের একটা ছোটোগল্প পাঠ করতে। সম্ভবত আবদুল মাঝির গল্প পড়বে। সে যথেষ্ট খারাপ রিডিং পড়ে। কিন্তু এ ছাড়া আর অনুষ্ঠান করার লোক নেই। এরপর তানিয়া অনুপস্থিত থাকলে অনুষ্ঠান চালানো কঠিন হবে।
অনুষ্ঠানসূচী সুমন করে ফেলেছে। কিন্তু অনুষ্ঠান কোথায় হবে সেই জায়গাটাই ঠিক হয়নি। অনুদির সঙ্গে কথা বলেনি এখনো। অনুদি ওদের ইংরেজিটা মাঝে মাঝে দেখিয়ে দেয়। গ্রামের ছেলেমেয়েরা অংক আর ইংরেজিকে যমের মতো ভয় করে। সুমন অদিতিরও ইংরেজিতে ভয় ছিলো খুব। এখন কিছুটা কাটছে৷
অনুদিদের বাড়ি যাবার পরই চরম হতাশাজনক কথাটা শুনলো সুমন অদিতি। পঁচিশে বৈশাখের আগের দিনই মায়ের সঙ্গে অনুদিকে খুব দরকারে মামার বাড়ি যেতে হবে। ফিরতে ফিরতে তিন দিন। অনুদি বললো, “সুমন এই সব বিষয়ে তো তোমাদের সবসময় উৎসাহ দিই তোমাদের। কিন্তু এই বছর পঁচিশে বৈশাখ আমি বাড়িতে থাকছি না। থাকলে আমাদের বাড়িতেই আয়োজন করে দিতাম। কোনো অসুবিধা হতো না। আমারও খুব ভালো লাগতো। তবে অন্য কোথাও অনুষ্ঠান করলে রবীন্দ্রনাথের ছবিটা আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে যেও।”
সুমন অদিতির শেষ আশার প্রদীপটাও নিভে গেলো। এর আগে তাদের যে কোনো অভিযানেই সঙ্গী ছিলো অনুদি। এবার অনুদি থাকতে পারছে না। মন খুব খারাপ করে ওরা বাড়ি ফিরলো।
আর মাত্র দু’দিন বাকি। এই বছরও ওরা রবীন্দ্রজয়ন্তী করতে পারবে না। জায়গাই পাওয়া গেলো না। বাইরে কোথাও জমায়েত হওয়া যাবে না। ‘জীবনস্মৃতি’ বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে সুমন। ঘুম ঘুম ভাব এসে গেছিলো। হঠাৎ মাথার পাশে রাখা ছোটো বোতাম ফোনটা বেজে উঠলো। তানিয়ার ফোন। ফোন অন করে সুমন বলল, “হ্যালো।”
“সুমন তোরা রবীন্দ্রজয়ন্তী করছিস। আমাকে নিবি না ?”
“তোর মা তো বললো আমাদের কোনো কাজে তুই আর সঙ্গে থাকবি না।”
“মা তো রাগের মাথায় বলেছে। মায়ের কথা ধরলি কেনো ?আমার সঙ্গে একবার কথা বলতে তো পারতি।”
“অনুষ্ঠান হচ্ছে না রে। জায়গা পাওয়া যায়নি। কোচিং স্যার রাজী হননি। আবার অনুদি ওই দিন বাড়ি থাকছে না। থাকলে ওখানে করা যেতো।”
“তাহলে হবে না ?”
“নাহ। তুই নিজের খেয়াল রাখিস। তাড়াতাড়ি পুরো সুস্থ হয়ে ওঠ।” বলেই ফোন কেটে দিলো সুমন। তার আর এই বিষয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
রবীন্দ্রজয়ন্তীর আগের দিন সারাদিন ঘরে বন্দী থাকলো সুমন। মন ভালো নেই। সে ভেবেই পাচ্ছে না ছোট্টো একটা অনুষ্ঠান করার জন্য জায়গার এত অভাব ? কিছুদিন আগে রাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের সময় মিটিং মিছিল করার সময় তো জায়গার অভাব হয়নক। ও শুনেছে আগে পড়ায় পাড়ায় মঞ্চ করে রবীন্দ্রজয়ন্তী হতো। এখন এসব দেখা যায় না। খুব মন খারাপ করে শুয়েই দিনটা কাটালো সে। বিকেলের দিকে অদিতি ফোন করলো, “সুমন ভালো খবর আছে।”
“কি হলো ?”
“কাল অনুষ্ঠান হবে।”
“কি বলছিস ?”
“ঠিকই বলছি। তুই প্রোগ্রাম সেট কর।”
“কোথায় অনুষ্ঠান হবে ?”
“তানিয়াদের বাড়িতে। ওদের উঠোনে বিকেলে অনুষ্ঠান হবে। ওর বাবা মা বলেছে অনুষ্ঠান করতে৷”
“মানে ?”
“মানে এখন আর বুঝতে হবে না। পরে বুঝিয়ে বলবো। তানিয়াই সব ব্যবস্থা করেছে৷ তুই অনুষ্ঠান রেডি কর। কাল সকালে অনুদিদের বাড়ি থেকে ছবিটা নিয়ে আসিস। আর একটা সুন্দর দেখে মালার ব্যবস্থা কর। আমি কবিতা মুখস্থ করে ফেলেছি। তানিয়াও গান করবে। মোট দশ বারো জন হবে। খারাপ হবে না আমাদের অনুষ্ঠান।”
“আচ্ছা বেশ।”
“খরচ যা হবে সব তানিয়ার বাবা দেবেন৷ তবে কোনো মাইক থাকছে না। খালি গলায় সব করতে হবে। দু একটা বাচ্চা নাচ করবে। তানিয়াদের ব্লুটুথ স্পিকারে ফোন থেকে গান বাজানো হবে। দেখিস দারুণ অনুষ্ঠান হবে।”
অদিতি মাঝেমাঝে খুব হড়বড় করে কথা বলে। বিশেষ করে উত্তেজিত থাকলে। আজও তাই বলছে। মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেলো সুমনের। ফোন কেটে সে আবার ‘জীবনস্মৃতি’ হাতে নিলো। কাল ওকে জমিয়ে বলতে হবে রবীন্দ্রনাথের ছোটোবেলায় গল্প।
এত আয়োজনের পরেও অনুষ্ঠানের দিন বিকেলে আকাশ মেঘে ভরে উঠলো। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে কালবৈশাখী নতুন কিছু নয়। তানিয়াদের উঠোনে সব রেডি হয়ে গেছে৷ ঘনঘন মেঘ ডাকছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে একমনে মেঘের গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করছে সুমন। বিকেলেই দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে। “আজকের দিনেই এমন কালো মেঘ জমতে হলো ? একটা দিন রক্ষা করা গেলো না।” আপন মনে বলে উঠলো সে৷
তানিয়া পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অস্ফুটে বলল, “মেঘ কেটে যাবে। তারপর আমরা অনুষ্ঠান করবো। না হলে ঘরে নিয়ে যাবো সব। ঘরে পালন করবো।” ঘরে অনুষ্ঠান করার কথাটা বললো বটে তানিয়া কিন্তু দু বছর আগে একটা কালবৈশাখীতে তাদের ঘরের চাল উড়ে গেছিলো। খুব দুর্দশা গেছে সেই সময়।
মেঘ ডেকে চলেছে। বিদ্যুৎ চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। হাওয়া শুরু হয়েছে। ধুলো উড়ছে। আর এত কিছুর মধ্যেও ছোটোছোটো কয়েকটা ছেলেমেয়ে ভীষণ আশা করে আছে সব মেঘ কেটে খুব তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *