• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় অসীম কুমার রায়

আলোর ভুবন

এক
ঘড়িতে যখন চারটা বেজে ত্রিশ মিনিট আমার তখন ঘুম ভেঙ্গে যায়। আগে এটা ছিল না। এখন বছর খানেক ধরে দেখছি এই নতুন অভ্যেসটা শুরু হয়েছে। সকালের আলো তখনও ফুঁটে ওঠে না। আবার অন্ধকারে বিছানার মায়াও ছাড়তে পারি না। কি যে করি! আবার নতুন করে ভাবি ঘুমিয়ে পড়ব, সেটাও পারি না। অগত্যা রবীন্দ্র সংগীত শুনি। নয়তো ঈশ্বর ঈশ্বরীয় নাম গান করি। এসময়ে ভগবানের নাম করলে নাকি শরীর মন দুই ভালো থাকে।
আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে৷
সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে৷৷
আমার এক ছেলে অ্যামেরিকায় নিউ যার্সিতে থাকে। বৌ ছেলে নিয়ে কালেভদ্রে কখনো আসে কখনো আসে না। বছরে একবার, কখনো দুবছরে একবার, কখনো আবার তিন বছরে একবার। আমার বুড়ি, শ্রাবনীর এই নিয়ে খুব ক্ষোভ, অভিযোগ। ছেলে আসলে বুড়ি শোনায়, “এত দূরে আমরা দু’জন একা একা থাকি। অসুখ বিসুখ তো লেগেই থাকে। তোদের কি মা বাবার কথা একবারও মনে পড়ে না, নারে? বছরে একবার আসা যায় না?”
ছেলের হয়ে বৌমাই উত্তর দেয়। “মা আমরা দু’জনেই চাকরি করি। তাছাড়া আপনার নাতি ওখানকার নামী একটা স্কুলে পড়াশুনা করে। আপনাদের বুঝতে হবে, সমস্ত দিক ম্যানেজ করে ছুটি নিয়ে আসা কী কষ্ট! কী অসুবিধা। সেজন্য প্রায়ই তো ফোনে আমরা খবরা খবর নিই। আর আপনার ছেলে প্রতি মাসে মাসে আপনাদের টাকা পাঠাতে ভুল করে না।”
– বৌমা, প্রতিমাসে আমার ছেলে আমাদের টাকা পাঠায়, একথাটা যদি বলবার খুব প্রয়োজন মনেকর তাহলে বাবুকে আর টাকা পাঠাতে বারণ কোর। কিন্তু ফোনটা কোর। এখন যেমন করছো। এটা যেন বন্ধ কোর না মা।
দেখলাম, মিতালি – আমার ছেলের বৌ, শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। মুখ খানায় মেঘ করে আছে। কোনো কথা বলল না।
পরেরদিন ওরা ছেলের শ্বশুর বাড়ি চলে গেল। ওখানে চারদিন থেকে যেদিন ফিরবে সেদিন সকালে এখানে আসবে। ফ্লাইট বিকেলে।
আমি আর বুড়ি, বুড়ি আর আমি, সোফায় বসে থাকি। আমার বুড়ি, বুড়ির আমি। বুড়ি ছাড়া আমার কেউ নেই। বুড়িরও আমি ছাড়া কেউ নেই। কোন এক জায়গায় পড়েছিলাম – এখন মনে নেই। বহুবছর সংসার জীবন অতিবাহিতের পর, নর নারীর মধ্যে বৃদ্ধবয়েসে অল্প একটু প্রেম জন্মায়। সেটা একটি ছুঁচে আগায় যতটুকু ধরে সেই ছুঁচাগ্র পরিমাণ। কেউ কেউ ঐ ঈশ্বরানুভূত ছুঁচাগ্র প্রেম মৃত্যুর আগে উপলব্ধি করতে পারে…। সবাই পারে না।
আমার বেলা যে যায় সাঝঁ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে৷৷
দুই
এখন আমার বয়স ষাট পেরিয়ে বাষট্টি ছুঁই ছুঁই। বছর দুই হল অবসর নিয়েছি। আমার বুড়িও বছরখানেক হলো একা একাই আকাশের উপরে উঠে গিয়ে তারা হয়ে গেছে। আমাকে নেয় নি। ছেলে ছেলের বৌ খুব ধরেছেল, ওখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি যাইনি। ছেলে বলেছিল, “তুমি এখানে একা থাকবে কিভাবে? কে দেখবে? কোথায় খাবে?”
– কেন মিনতি আছে তো। ও আগেও রান্না করতো এখনো করবে। টিনা আছে সকালে কাজ করে দেয়। অসুবিধা কিছু হবে না। আমি বললাম।
— না বাবা। আমরা ভাবছি অন্যকথা। আপনার অসুখ বিসুখ হলে কে দেখবে! ছেলের বৌ মিতালি বলল।
আমি মনে মনে খুব হাসলাম। এই কথাটা শ্রাবণী বেঁচে থাকাকালীন ওদের উদ্দেশ্যে বহুবার বলতে শুনেছি। তখন তো অজুহাতের পাহাড় নিয়ে এসে জড়ো করেছো তোমরা। শোনোনি। আজ এসব প্রশ্ন কেন? মরার আগে কী কষ্টটা না পেল শ্রাবণী।শ্বাষকষ্ট। কাশি। প্রায় বুক ধড়ফড় করত৷ থেকে থেকে জ্বর আসত৷ হাঁটাচলাও বেশি করতে পারত না৷ তাও মৃত্যুর দশ বারো দিন আগে থেকে, সেই আভাগী মেয়েমানুষটা তোমাদের একবার দেখতে চেয়ে কত কাকুতি মিনতি করে ফোন করেছে৷ তোমরা আসনি৷ এলে কখন — মা মরে যাওয়ার দু’দিন পর৷
বললাম,“ অসুখ হলে ডাক্তার আছে৷ হাসপাতালও বাড়ি থেকে বেশি দূর নয়৷ মিছিমিছি ওসব ভেবে লাভ কি? আর সময় হলে সবাইকে একদিন যেতে হবে৷ সুতরাং অত চিন্তা কোর না৷” ছেলে ছেলের বৌ দেখলাম গুম মেরে গেল৷কোনো কথা বলছে না৷ এর আন্তর্নিহিত কারণটা তো আমি বুঝতে পারছি৷ ওদের ইচ্ছে আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখবে৷আর এখানকার জায়গা জমি বাড়ি সব বিক্রি করে টাকা পয়সা বুঝে নেবে। মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিনই কেবল আমার আমার করে যাবে৷ আজ অনুভব করছি, আমার বলতে সত্যি কিছু নেই! ছিলও না কোনোদিন৷
ফাঁকা থাকলে এখন প্রায়ই তাস নিয়ে বসি। তাসের চারটি রঙ। চারটি রঙ নিয়ে রঙ মিলান্তি খেলা খেলতে থাকি। এটা একা একাও খেলা যায়। রুইতন ইস্কাপন চিরন্তন হরতন — চার রঙের চারটি সাহেব, চার রঙের চারটি বিবি, চার রঙের চারটি গোলাম।
শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। চোখটা সমস্যা করছে। চোখের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। চশমার পাওয়ার ঠিকই আছে। কিন্তু আলাদা করে কোনো রঙ – কমলা লাল, সবুজ বেগুনী – চিনতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। মনটা টেনশড্ হয়ে আছে। চিন্তা করছি। সত্যি সত্যি চোখ থেকে রঙই যদি চলে যায় তবে বাঁচবই বা আর কী নিয়ে…৷
আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা,
আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা৷৷
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।