মাহাবুব ভাইয়ের মুখ গোমরা। চেহারায় বিরক্তির ছাপ। বিরক্ত আকমল ভাইয়ের ওপর। কিন্তু আমরা সবাই আকমল ভাইয়ের ওপর মহাখুশি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে বেড়াতে পেরে আমরা খুশি।
মাহাবুব ভাই বললেন: মনে হচ্ছে, কপালে খারাপ কিছুই আছে।
আকমল ভাই বললেন: কপাল বলে কিছু নাই। সব কিছুই কাজের সাথে রিলেটেড। একটু ধৈর্য্য ধরো, তোকে মানকিগঞ্জ নিয়ে যাচ্ছি। এখানে আপসেট হওযার কিছু নেই।
মাহাবুব ভাই কিছু বললেন না। মানুষ বিরক্ত হলে বেশি কথা বলতে পারে না। থম মেরে থাকতে চায়।
আকমল ভাই বললেন: গাব্বু, তোর কঙ্কনা আপু যেন কোন সাবজেক্টে?
: নাট্যকলায়।
মাহাবুব ভাই বললেন: চারুকলায় হলে এখনই ঢাকায় ফিরে যেতাম।
আমি বললাম: চারুকলা মন্দ কী?
: চারুকলা যারা পড়ে, তাদের ভেতর কিছু সমস্যা থাকে।
: কে বলেছে আপনাকে?
: তুই ভ্যানগগের জীবনী পড়ে দেখিস। প্রেমিকাকে নিজের কান কেটে পাঠিয়েছিলেন।
আকমল ভাই বললেন: মাহাবুব, তুই কি বলতে চাচ্ছিস যে, আমার ভেতর কোনো সমস্যা আছে?
মাহাবুব ভাই কিছু বললেন না। নীরবতাই সম্মতি। আকমল ভাই ধরে নিলেন, মাহাবুব ভাই সেরকম কিছু বলতে চাচ্ছেন। আকমল ভাই একটু রাগত কন্ঠে বললেন: যাচ্ছিস নিজের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে। মেয়ে আবার আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে সে আমার ছাত্রী। শিক্ষক গুরুজন। শিক্ষককে অমান্য করলে কপাল খারাপ হয়।
: তুই কপালে বিশ্বাস করিস?
: না।
: তাহলে?
: এটা কমন কথা। সবাই বলে।
: স্যার, দয়া করে চুপ করে থাকেন। বেশি বকবক ভালো লাগছে না।
মাহাবুব ভাই আকমল ভাইকে ‘স্যার’ সম্বোধন করছেন। তার মানে তিনি রেগে গেছেন বেশ। আকমল ভাই চুপ করলেন। তখন একটা মাইক্রোবাস এসে থামলো আমাদের সামনে। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো: কোথায় যাবেন?
আকমল ভাই বললেন: মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড।
: আমি আরিচা যাবো। ওঠেন, নামায়া দিবো, ভাড়া বেশি দিতে হবে না।
মাইক্রোবাসে অনেক সময় কিডন্যাপ, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটে। আমরা এতগুলো মানুষ। যদিও গাড়িতে এক ড্রাইভার ছাড়া কেউ নেই, তবু পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় ন। সামনেই হয়তো তার লোকজন আছে। যথাস্থানে গিয়েই ধরে বসবে।
আমাদের দ্বিধা বুঝতে পেরে ড্রাইভার বলল: আমি মালিককে ঢাকায় নামিয়ে দিয়ে খালি গাড়ি নিয়ে ফিরছি।
এ কথার পর আমরা মাইক্রোবাসে উঠে পড়লাম। গাড়িতে উঠে আমরা আনন্দে মেতে উঠলাম। পুরো একটা গাড়িতে শুধু আমরা। পিকনিক পিকনিক আমেজ। ফেকু ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় গেয়ে উঠল: তিন পাগলে মিলছে মেলা নদে এসে, ভোলা মন নদে এসে/ তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের দেশে। রাতের বাউল গানের রেশ এখনও ওর ভেতর রয়ে গেছে।
এক সময় গাড়ি ব্রেক কষল। আমরা বুঝে নিলাম, মানিকগঞ্জ পৌছে গেছি। সামনে তাকিয়ে দেখি সাদামত বিস্তৃন কি যেন। প্রথমে ভাবলাম, মাঠের ওপর বৃষ্টির জন্য অমন সাদা। পরে দেখি ঢেউ ঢেউ। দূরে দূরে আলো নড়াচড়া করছে। ভালো করে কাছে তাকিয়ে আমাদের চোখ চড়ক গাছ। সামনে বিরাট বিরাট লঞ্চ। ছোট-বড় অনেক নৌকা। স্পীড বোট। মানিকগঞ্জ স্টেশনের আশেপাশে তো এসব থাকা সম্ভব না।
ড্রাইভাব বলল: দুঃখিত, আপনারাও খেয়াল করেন নাই, আমিও না। আপনারা হৈ-হুল্লোরে মেতে ছিলেন। আমি এক মনে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালিয়েছি। কখন যে মানিকগঞ্জ স্টেশন পার হয়ে এসেছি বুঝতে পারিনি। আরিচা ঘাটে এসে পড়েছি।
মাহাবুব ভাই বললেন: কপালে খারাপ কিছু আছে তা জানতাম।
আকমল ভাই বললেন: ভুল করে আরিচা চলে এসেছি, এখানে কপাল খারাপের কিছু নাই। বরং ভালো কিছুই হয়েছে।
আমরা তাকালাম আকমল ভাইয়ের মুখে। আমাদের চোখে বিস্ময়। এই বৃষ্টিমুখর অন্ধকার রাতে ভুল করে চলে এসেছি আরিচা ঘাট। এর সাথে কপাল ভালো হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
ড্রাইভার বলল: বলেন তো গাড়ি ঘুরিয়ে আবার মানিকগঞ্জ যাই। ভুলটা আমারই। আমি আপনাদের গাড়িতে উঠিয়েছি, আমার খেয়াল রাখা উচিত ছিল। আই এ্যাম সরি, ভেরি ভেরি সরি।
আমরা খুশি হলাম। ভেবেছিলাম, ড্রাইভার ফিরতে রাজি হবে না। কিন্তু সে নিজে থেকেই ফিরতে চাচ্ছে। আবার দোষ নিজের ঘাড়ে তুলে নিচ্ছে। দুঃখ প্রকাশ করছে। আসলে এই পৃথিবী কখনোই ভালো মানুষ শূন্য হবে না।
আমাদের সবাইকে এক যোগে অবাক করে দিয়ে আকমল ভাই বললেন: না, ফিরতে হবে না।
তারপর তিনি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ভাড়া দিয়ে দিলেন। মাহাবুব ভাই বললেন: এই অন্ধকার বৃষ্টির রাতে তুই এতগুলো ছেলে নিয়ে থাকবি কোথায়?
: ওদের ভেতর আছে দুর্দান্ত এ্যাডভাঞ্চার নেশা। এতদিন ওদের সাথে থেকেও তুই ধরতে পারিসনি। কোনো রেস্টুরেন্টে পদ্মার সতেজ ইলিশ মাছ ভাঁজা দিয়ে ভত খাবো। তারপর পদ্মার বুকে ইলিশ মাছ ধরা দেখবো। একটা রাত চোখের নিমিষে কেটে যাবে। কাল সকালে মানিকগঞ্জ গিয়ে হাজির হবো। এরমধ্যে যদি কঙ্কনা এসে পড়ে তো বিকালেই তোরা ঢাকায় ফিরতে পারবি।